১০ অক্টোবর ২০২০, শনিবার, ১০:১৯

দামি হলেও জুতা দেখানো বিপজ্জনক

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী : জুতা আবিষ্কারের কাহিনী নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা কবিতা নিশ্চয়ই অনেকে পড়েছেন। না, আজ আমি সেকথা নিয়ে কিছু বলবো না। তবে জুতা যে একজোড়া খুব প্রয়োজনীয় জিনিস তা আর বলবার অপেক্ষা রাখে না। শুধু প্রয়োজনই নয়, অনেকের শখেরও বস্তু হয় এ জুতা বা পাদুকা। ‘পাদুকা’ নামকরণ কে করেছিলেন তা জানি না। তবে পায়ের সঙ্গে এর নিবিড় সম্পর্ক বলেই এমন নামকরণ হতে পারে বলে আমার ধারণা।

আধুনিক যুগের যে চকচকে ও ঝকঝকে সাদাকালো বা বর্ণিল পদযুগল আবৃত করবার চামড়া বা অন্য কোনও বস্তু দিয়ে প্রস্তুতকৃত পাদুকা নামক পণ্যটি প্রাথমিক অবস্থায় এমন পরিপাটি ছিল না। এবড়ো-থ্যাবড়োভাবে কোনওরকমে পায়ে আটকিয়ে রাখা যেতে পারলেই হতো। কেউ কেউ চামড়া দড়ি দিয়ে পায়ের সঙ্গে কোনওরকমে বেঁধেও ব্যবহার করতেন। এখনকার মতো সাজানো-গোছানো চমৎকার সাইজ ও ডিজাইনের জুতা আগে ছিল না। বেশিরভাগ লোক খালিপায়ে দিব্যি চলাফেরা করতেন।

আগের দিনে পশুর চামড়া দিয়ে জুতা প্রস্তুত হতো। তারপর ধীরেধীরে রাবার, কাপড় ইত্যাদি আসে জুতা তৈরিতে। এর আগে কাঠ দিয়েও জুতা বানানো হতো। কাঠের জুতাকে অবশ্য খড়ম বলা হয়। কাঠ পায়ের সাইজমতো কেটে সামনের দিকে কাঠেরই একটা খুঁটি লাগিয়ে দেয়া হতো। এতে পায়ের বুড়ো আঙ্গুল আর এর পাশের আঙ্গুল দিয়ে খড়মের খুঁটি চেপে ধরে মানুষ খটস খটস শব্দ করে হাঁটতেন। তবে খড়ম পায়ে দিয়ে বেশিদূর হাঁটা যেতো না। শুধু বাড়ির আঙ্গিনায় হাঁটবার জন্যই খড়ম পায়ে দেয়া হতো। এরপর খড়মে রাবার বা সাইকেলের পুরনো টায়ার কেটে ফিতা বানিয়ে লোহার পিন দিয়ে আটকিয়ে কাঠের খড়ম পায়ে দেবার চল হয়। কাঠের খুঁটির চেয়ে রাবার বা সাইকেলের টায়ার কেটে ফিতা লাগিয়ে খড়ম পায়ে দেয়া অনেক সুবিধেজনক।

খড়মের চল এখন নেই বললেই চলে। তবে জুতা, স্যান্ডেল, চপ্পল যাই বলা হোক না কেন, এসবই হচ্ছে খড়মের আধুনিক সংস্করণ। ১৫-২০ বছর আগেও স্পঞ্জের চপ্পল বা স্যান্ডেল ১০-২০ টাকায় সহজেই কিনতে পাওয়া যেতো। এখন তা ২০০-৩০০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। আগে এগুলো দেশেই তৈরি হতো। এখন বিদেশ তথা চিন, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান থেকে আসে এসব প্লাস্টিকের স্যান্ডেল বা চপ্পল। এগুলোর ব্যবহার স্বাস্থ্যসম্মত কিনা তাও পরীক্ষানিরীক্ষা করা হয় না। বিষয়টির ওপর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজর দেয়া উচিত।

আগে জুতা তৈরি হয়েছিল কাদাপানি, ধুলোবালি, গরম ও ঠাণ্ডা থেকে বাঁচবার জন্য। এখনও জুতার কাজ প্রধানত এগুলোই। তবে শখের জন্য কেউ কেউ আজকাল অনেক দামি জুতা পরিধান করেন। জুতায় সোনা, হীরা, জহরত ইত্যাদি মূল্যবান ধাতুও ব্যবহার করেন। পৃথিবীর অনেক ফার্স্টলেডি হীরা-জহরতখচিত জুতা পরিধান করে যেমন সুনাম-সুখ্যাতি অর্জন করেছেন, তেমনই কেউ কেউ একই কাজ করে যথেষ্ট নিন্দিতও হয়েছেন। একসময় ফিলিপাইনের ইমেলদার বাসভবনেও মূল্যবান ধাতুখচিত কোটিকোটি টাকার জুতা পাওয়া গিয়েছিল। অর্থাৎ জুতা কেবল কাদা-ময়লা বা শীত-গরম থেকে বাঁচবার জন্য পোশাকের মতো পণ্যই নয়। মূল্যবান অলঙ্কার হিসেবেও গণ্য।

যা হোক, এক জোড়া জুতা বা পাদুকার দাম কত টাকা হতে পারে? এর জবাব দেয়া বেশ কঠিন। কারণ, এক জোড়া জুতা যেমন ১০০-২০০ টাকায় পাওয়া যায়, তেমনই তার মূল্য শত কোটি থেকে দেড়-দুইশত কোটি টাকারও হতে পারে। বিশ্বাস করতে পারছেন না, তাইতো?
বিশ্বস্ত সূত্রে প্রকাশ: এমনই এক জোড়া পাদুকা বাজারে আনে সংযুক্ত আরব আমিরাতের একটি কোম্পানি, যার দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৪২ কোটি টাকারও বেশি। দীর্ঘ ৯ মাস অক্লান্ত পরিশ্রম করে জাদা দুবাই নামের এক কোম্পানি এ পাদুকা জোড়া বাজারে আনে। গত ২০১৮ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর বিশ্বের একমাত্র সেভেন স্টার হোটেল বুর্জ আল আরবে পাদুকা জোড়ার মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছিল। এ পাদুকা জোড়ার বাজারমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৪২ কোটি ৯৭ লাখ টাকার সমপরিমাণ। ‘দ্য প্যাসন ডায়মন্ড সু’ নামের এ পাদুকা প্রস্তুত করেছিল যৌথভাবে জাদা দুবাই ও প্যাসন জুয়েলার্স।

কী দিয়ে তৈরি এ জুতা? কোন মহারাণী ভিক্টোরিয়া অথবা সম্রাট-সম্রাজ্ঞী এ পাদুকা পরিধান করেছেন তা জানানো হয়নি বা আমরা জানতে পারিনি। তবে কী সব ধাতু দিয়ে এ পাদুকা প্রস্তুত তা জানা গেছে। এতে আছে: হীরা ও খাঁটি স্বর্ণ। আছে শতশত হীরার টুকরোসহ ১৫ ক্যারেটের দুটো বড় হিরকখণ্ড। জাদা দুবাই জানায়, প্রদর্শনীর পর গ্রাহকদের চাহিদার ভিত্তিতে নতুন নতুন জুতা তৈরি করে দেয়া হবে।

কোম্পানিটি আরও জানায়, ‘দ্য প্যাসন ডায়মন্ড সু’ ছাড়াও হীরা, সোনা, মুক্তা ও মূল্যবান রক্তাভ পাথরের তৈরি আরও তিনটি মডেলের পাদুকা প্রদর্শনীতে রাখবার কথা ছিল। এগুলোর মূল্য যথাক্রমে ১৭, ২৫ ও ২৭ হাজার মার্কিন ডলার করে।

এক জোড়া জুতা বা পাদুকার দাম প্রায় ১৪৩ কোটি টাকা। তা ভাবা যায়? যারা পৃথিবীটাকে ভোগবিলাসের একমাত্র জায়গা মনে করেন, তাঁরাই কেবল এমন দামি পাদুকা পরিধান করতে পারেন। যাদের এক জোড়া জুতার দাম এতো বিপুল পরিমাণ টাকা, তাঁদের অন্য ভোগ্যপণ্যের দাম কী হতে পারে? ভাবতে পারেন কেউ? অথচ মৃত্যুর পর একদম খালিহাতে বিদায় নিতে হবে তাঁদেরও। মুসলিমসহ কাউকে কাউকে কবরে গিয়ে ঢুকতে হবে। অন্য কাউকে আগুনে পুড়ে ছাইভস্ম হতে হবে। উল্লেখ্য, পৃথিবীতে এমনও দেশ আছে যেখানে কোনও কোনও ধর্মবিশ্বাসের লোক বুড়ো দাদাদাদি অথবা মা-বাবা মারা যাবার আগেই তাদের আগুনে পুড়িয়ে কিংবা বড় কড়াইয়ের ফুটন্ত তেলে হাতপা বেঁধে ফেলে দিয়ে ভেজে খেয়ে নেয়। পাপুয়া নিউগিনিতে এমন নির্মম কাণ্ড ঘটতো বলে আমি পড়েছি। এমন বর্বর কাণ্ড জঙলি ব্যতীত কেউ অবশ্য করতে পারে বলে আমার মনে হয় না।

যা হোক, জুতা নিয়ে কথা শুরু করেছিলাম। জুতা হচ্ছে একটি অতীব প্রয়োজনীয় বস্তু। এটি আমাদের পা বা পদযুগলকে কাদাপানি, ময়লা-আবর্জনা থেকে রক্ষা করে। কিন্তু একসময় মানুষ জুতার ব্যবহারই জানতো না। খালিপায়েই শতশত মাইল পথ পাড়ি জমাতো। ৫০-৬০ বছর আগেও গ্রামাঞ্চলের অনেক মানুষ জুতা পায়ে না পরে তা হাতে নিয়ে ২০-৩০ মাইল পথ অতিক্রম করে আত্মীয়বাড়িতে গিয়ে পা ধুইয়ে তারপর জুতা পায়ে দিতেন। এমন কাণ্ড কেউ দেখেছেন কিনা জানি না। তবে আমি দেখেছি।

আধুনিক যুগে জুতা জীবনযাপনের জন্য অপরিহার্য উপকরণ হিসেবে গণ্য। তবে তা শতকোটি টাকা ব্যয় করে বানাতে হবে তেমন অনিবার্য নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, একশ্রেণির মানুষ পাদুকা পরিধানকেও শৌর্যবীর্যের প্রতীক ভাবতে শুরু করেছেন। কিন্তু সভ্যতার দাবি এমন নয়। শতকোটি টাকার মূল্যবান ধাতু দিয়ে পাদুকা বানালেও তা পায়েই থাকে। আবার মাত্র ১০০-২০০ টাকার স্পঞ্জের স্যান্ডেলও পায়ে থাকে। তবে শতকোটি টাকার জুতা হলেও তা কেউ মাথায় নিতে চায় না। আসলে জুতা সবসময় জুতাই। জুতা কখনও টুপি বা পাগড়ি হয় না। মাথায় কেউ ধারণও করে না।

আরেকটা বিষয় খেয়াল করুন, জুতা যত দামিই হোক না কেন, তা কেউ দেখতে চায় না। কাউকে জুতা দেখানো মানে তাকে মারাত্মক অপদস্থ করা। দ্য প্যাসন ডায়মন্ড সু’র প্রায় ১৪৩ কোটি টাকার জুতা দিয়ে যদি কাউকে মারতে যান কিংবা বিশেষ ভঙ্গিতে দেখান তাতে কি ওই লোক খুশি হবেন? নিশ্চয়ই না। বরং নির্ঘাত উল্টোটাই ঘটবে। ভদ্রলোকেরা জুতা পরতে পছন্দ করলেও জুতা দেখা বা খাওয়া কেউ পছন্দ করেন না, তা যত দামিই হোক। জুতা দেখা বা খাওয়া নিশ্চিতরূপেই অমর্যাদাজনক এবং ভীষণ মানহানিকর।

https://dailysangram.com/post/430130