২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, মঙ্গলবার, ১২:৩৯

মিলার সিন্ডিকেটের কারসাজিতে ফের বাড়ছে চালের দাম

এইচ এম আকতার : আবারও অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে চালের বাজার। বাজারে পর্যাপ্ত চালের সরবরাহ থাকলেও মিলার সিন্ডিকেটের কারণেই বাড়ছে চালের দাম। প্রায় সবরকম চালের দাম বেড়েছে কেজি প্রতি দুই টাকা করে। ক্রেতা ও খুচরা বিক্রেতারা দায় চাপাচ্ছেন চালকল মালিকদের ওপর। যদিও অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মিলাররা। তাদের দাবি, ধানের দাম বৃদ্ধিসহ, বন্যা ও করোনার প্রভাবে বেড়েছে চালের দাম। আর বাজার অস্থিরতা তৈরি করলেই কঠোর ব্যবস্থার হুঁশিয়ারি বাজার মনিটরিং কর্মকর্তাদের।

ঈদুল আযহার পর ফের অস্থির হয়ে উঠেছিলো দেশের চালের বাজার। তখন মান ভেদে কেজিতে বেড়েছিলো ৪ থেকে ৫ টাকা। এখন এর সাথে যোগ হয়েছে আরও দুই টাকা।

চালের এমন ঊর্ধ্বমুখীতে নাভিশ্বাস নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের। বাজার তদারকি না থাকাকে দূষছেন তারা। তবে বরাবরের মতো মিলারদের ওপরই দায় দিচ্ছেন খুচরা বিক্রেতারা। আর চালকল মালিকদের সেই পুরনো অজুহাত ধানের দাম বাড়ায় বেড়েছে চালের দর। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে দফায় দফায় অভিযান চালাচ্ছে মনিটরিং টিম। চালকল মালিকদের সাথে করছেন নিয়মিত বৈঠক।

চালের দাম বেড়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও দিনাজপুরের হিলিতেও। প্রতি বস্তায় তিনশো থেকে পাঁচশো টাকা বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে খেটে খাওয়া মানুষ। অভিযোগ, ধানের দাম বাড়ার অজুহাতে, চাল গুদামজাত করে রেখেছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী।

দেশে চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত চালের মজুত থাকলেও একটি সিন্ডিকেটের কারসাজিতে বারবার চালের বাজার অস্থির হয়ে উঠছে। গত দুই-তিন দিনের ব্যবধানে রাজধানীসহ সারা দেশে সব ধরনের চালের দাম কেজিতে ২ থেকে ৪ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর চার দফা বাড়ল চালের দাম।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মূলত মিলার বা মিল-মালিকদের কারসাজিতেই বারবার চালের দাম বাড়ছে। দেশে চালের সবচেয়ে বড় মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগর। এই মোকামের চাল মিলারদের গত বৃহস্পতিবার এক বৈঠকে ডেকে হঠাৎ আবার চালের দাম বাড়ানোয় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসন।

কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মো. আসলাম হোসেন চালকল মালিকদের বলেন, আপনারা খেয়াল-খুশিমতো চালের দাম বাড়িয়ে সরকার ও প্রশাসনকে বিব্রত করার অপচেষ্টা করবেন তা সহ্য করা হবে না। হঠাৎ কি কারণে চালের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে তার ব্যাখ্যা চায় জেলা প্রশাসন। এ সময় ইচ্ছামতো চালের দাম বৃদ্ধি করায় চালকল মালিকদের কঠোরভাবে সতর্ক করা হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কুষ্টিয়ার এই মোকামে প্রতি কেজি মোটা চালে ২ থেকে ৩ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। বর্তমানে এই মোকামে মোটা চালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৪২ টাকা দরে। এছাড়া মিলগেটে মিনিকেট, পাইজাম, কাজললতা ও বাসমতি চালের দাম কেজিতে ৩ থেকে ৪ টাকা বেড়ে মিনিকেট ৫৫ টাকা, কাজললতা ৪৭, বাসমতি ৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। মোকামে দাম বাড়ানোর প্রভাব পড়ছে সারাদেশে।
গত শুক্রবার রাজধানীর খুচরাবাজারে প্রতি কেজি মোটা চাল ইরি/স্বর্ণা কেজিতে ২ থেকে ৪ টাকা বেড়ে ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা, মাঝারি মানের চাল পাইজাম/লতা ২ টাকা বেড়ে ৪৮ থেকে ৫০ টাকা ও সরু চাল মিনিকেট/নাজিরশাইল ৫৪ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হয়।

সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) গতকালের বাজারদরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এক বছরে দেশে মোটা চালের দাম বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। এ সময় স্বল্প আয়ের মানুষের এই চালটির দাম বেড়েছে ২৪ দশমিক ৩২ শতাংশ। মাঝারি মানের চাল পাইজাম/লতা বেড়েছে ২ দশমিক ১৩ শতাংশ। আর নাজিরশাইল/মিনিকেটের দাম বেড়েছে ৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ।

খাদ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, বর্তমানে সরকারের গুদামে ১৩ লাখ ৯৭ হাজার টন খাদ্যশস্য মজুত রয়েছে। এর মধ্যে চালের পরিমাণ ১০ লাখ ৯১ হাজার টন। আর গমের পরিমাণ ৩ লাখ ৬ হাজার টন। এই মজুত সন্তোষজনক বলে তারা জানিয়েছে।

এদিকে সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)-এর এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা দেশে যে পরিমাণ ধান-চালের মজুত রয়েছে তা দিয়ে আগামী নভেম্বর পর্যন্ত চাহিদা মিটিয়ে ৫ দশমিক ৫৫ মিলিয়ন টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে। তাই দেশে খাদ্যঘাটতির কোনো আশঙ্কা নেই।

এ গবেষণায় দেখা গেছে, চালের উৎপাদন গত বছরের তুলনায় প্রায় ৩ দশমিক ৫৪ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বোরো ও আমন মৌসুমের উদ্বৃত্ত উত্পাদন থেকে হিসাব করে, জুন পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরে ২০ দশমিক ৩১ মিলিয়ন টন চাল ছিল। আগামী নভেম্বর পর্যন্ত ১৬ দশমিক ৫০ কোটি মানুষের চাহিদা মিটানোর পরেও ৩৬-৭৮ দিনের চাল উদ্বৃত্ত থাকবে। এছাড়া, নভেম্বরের মধ্যে দেশের ফুড বাস্কেটে নতুনভাবে আউশ ও আমনের উত্পাদন যুক্ত হবে।

উত্তরবঙ্গে হাজার হাজার টন ধান মজুতে সৃষ্ট সংকটেই চালের দাম বেড়েছে বলে মিলারদের অভিযোগ। তারা বলেছেন, ধান মজুতের ফলে দাম বেশি, এ কারণেই চালের দাম বাড়ছে। এছাড়া দেশে ৩৫টি জেলায় চার দফা বন্যার একটা প্রভাব পড়েছে। তবে পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, বোরো মৌসুমে উৎপাদিত ধানের বড় অংশ মিলাররা নিজেরাও কিনে মজুত করেছেন। এছাড়া এখন প্রান্তিক কৃষকের হাতে ধান নেই। তাই ধানের দাম বাড়ার অজুহাতে চালের দাম বাড়ছে এই অজুহাত ঠিক না।

এদিকে কুষ্টিয়া জেলার গোয়েন্দা সংস্থার এক প্রতিবেদনে মিল মালিকদের খেয়াল-খুশি মতো চালের দাম বাড়ানোর বিষয়টি উঠে এসেছে। তবে এ বিষয়ে কুষ্টিয়া মোকামের চাল উৎপাদনকারী বৃহৎ প্রতিষ্ঠান রশিদ এগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের স্বত্ব্বাধিকারী ও বাংলাদেশ অটো মেজর এন্ড হাসকিং মিল মালিকদের কেন্দ্রীয় সংগঠনের সভাপতি আব্দুর রশিদ জানান, চালের দাম বৃদ্ধিতে কুষ্টিয়া চালকল মালিকদের কারসাজি কিংবা সিন্ডিকেট বলে কিছু নেই। তবে উত্তরবঙ্গের চালকল ও চাতাল মালিকরা হাজার হাজার টন ধান মজুত করায় ধান সংকটে বেড়েছে চালের দাম। ধান মজুতের পাশাপাশি উত্তরবঙ্গের বহু চাতাল মালিক চাল উত্পাদনও বন্ধ রেখেছে। ফলে কুষ্টিয়া মোকামে চালের বাড়তি চাহিদাসহ উত্পাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে তারা চালের দাম বাড়িয়েছেন। তিনি উত্তরবঙ্গসহ দেশের অন্যান্য জায়গায় যেখানে ধানের মজুত গড়ে সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে সেখানে প্রশাসনের হস্তক্ষেপের দাবি জানান।

এদিকে চালের প্রকৃত দর নির্ধারণসহ ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরতে কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. সিরাজুল ইসলামকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন।

কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক তানিমুল সিরাম, বাজার মনিটরিং কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম, দাদা রাইস মিলের মালিক জয়নাল আবেদীন, দেশ এগ্রো ফুডের মালিক আবদুল খালেক, মিল মালিক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও ওমর ফারুক। কমিটি ধান ক্রয় থেকে চাল উৎপাদনে সমুদয় খরচ নিরূপণ করে চালের দাম নির্ধারণ করবে। এছাড়া কমিটির অনুমোদন ছাড়া চালের দর বৃদ্ধিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।

https://dailysangram.com/post/428927