সিলেটের এমসি কলেজে ধর্ষণের ঘটনায় গতকাল অভিযুক্ত প্রধান আসামি সাইফুর রহমানকে ছাতক থেকে এবং অর্জুন লস্করকে হবিগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ।
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, সোমবার, ৬:৫১

ধর্ষণের সঙ্গে বারবার কেন ছাত্রলীগের নাম

শিক্ষা, শান্তি, প্রগতি—এই তিনটি হলো ছাত্রলীগের মূলনীতি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম ছাত্রসংগঠনটি তাদের গঠনতন্ত্রে ঘোষিত তিন মূলনীতি থেকে যেন যোজন যোজন দূরে সরে যাচ্ছে। দেশের প্রতিটি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে যে সংগঠনটি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে, এখন তারাই প্রতিনিয়ত নানা অপকর্মে জড়িয়ে বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে।

১৯৯৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন মানিক ধর্ষণের সেঞ্চুরি উদ্যাপন করে সারা দেশে সমালোচনার ঝড় তুলেছিলেন। আর সর্বশেষ গত শুক্রবার সিলেটে ছাত্রলীগকর্মী সাইফুর রহমানসহ ৯ জন দল বেঁধে এক নারীকে ধর্ষণ করে সারা দেশে নিন্দার ঝড় তুলেছেন।

ধর্ষণের অভিযোগের বৃত্ত থেকে যেন ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা বের হয়ে আসতে পারছেন না। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে চলতি মাসেই দেশের বিভিন্ন স্থানে সংগঠনটির নেতাকর্মীদের নামে অন্তত পাঁচটি ধর্ষণ মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। এর আগেও বছরজুড়ে ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নামে ধর্ষণের মামলা হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। সংগঠনটির নেত্রীদেরও ধর্ষণের অভিযোগে মামলার আসামি হয়েছেন নেতারা। সবচেয়ে বেশি দায়ের হয়েছে বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের মামলা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বুদ্ধিজীবীদের মতে, জাতীয় রাজনীতি দূষিত হয়ে পড়া এবং স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েই ধর্ষণের মতো ঘৃণিত অপরাধে জড়ানোর সাহস পাচ্ছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ছাত্ররা সমাজের অগ্রসর অংশ। আমাদের দেশে তারা সব সময় নানা আন্দোলনের মধ্যে থেকেছে। কিন্তু এখন আর তারা সে ধারায় নেই। কোথাও কোনো ছাত্রসংসদ নির্বাচন নেই। ছাত্রসংসদ থাকলে তাদের একটা কর্তৃত্ব থাকে। তারা দেখতে পারে কোথাও শিক্ষার্থীদের সমস্যা হচ্ছে কি না। এখন তো প্রশাসনের কর্তৃত্ব নেই, আবার ছাত্রসংসদও নেই। এখন শুধু ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের কর্তৃত্ব চলছে। তারা কোনো কিছুর তোয়াক্কা করে না। তাদের তো সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমর্থনও দরকার পড়ে না। স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রীকে কেড়ে নিয়ে ধর্ষণের মতো অকল্পনীয় অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তারা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ছাত্রসংসদের নির্বাচন করলে সেখানকার পরিবেশ খানিকটা উন্নত হবে বলে মনে করি।’ তিনি বলেন, ‘সমাজে ভোগ-বিলাস চরমমাত্রায় বেড়ে গেছে। নৈতিক অবক্ষয় ঘটেছে। ফলে ছাত্রদের দ্বারা শিশু ধর্ষণ, দল বেঁধে ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটছে। পুঁজিবাদী নৃশংস রূপ এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি। পুঁজিবাদের মধ্যে একটা ফ্যাসিবাদ লুকানো থাকে। তারা যা ইচ্ছা করবে—এমন একটা প্রবণতা থাকে। ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে এ ধরনের ঘটনা বাড়ছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এসব ঘটনা খুবই দুঃখজনক। এটা যে হঠাৎ করে হচ্ছে তা নয়। পর্যায়ক্রমে নিচে যেতে যেতে একটা গভীর সংকটে এসে আমরা দাঁড়িয়েছি। অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে, সম্পদ বাড়ছে, কিন্তু মানুষের মানবিক গুণাবলি কমে যাচ্ছে। এখন আমাদের সামনে কোনো আদর্শ নাই। আদর্শহীনতা, নীতিহীনতা—এগুলো দ্বারা রাজনীতি দূষিত হয়ে গেছে। জাতীয় রাজনীতি যদি দূষণমুক্ত হতো তাহলে সরকারের নীতি ভিন্ন হতো। তখন এসব অস্বস্তিকর ঘটনা কমত। আপাতত জোড়াতালি দিয়ে সময় পার করবে। এখন শাস্তি দিয়ে সমস্যা সমাধান করতে চাইছে। কিন্তু শাস্তি দিয়ে তো সমাধান হচ্ছে না। এগুলো বন্ধে দরকার জনগণকে জাগানো। এর জন্য দরকার সুস্পষ্ট রাজনৈতিক বক্তব্য ও আদর্শ নিয়ে একটি দল।’

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা খুবই দুঃখজনক। এ দেশের সকল প্রগতিশীল আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্রলীগ। এমন একটি ঐতিহ্যবাহী সংগঠনের নেতাকর্মীরা স্বামীকে মারধর করে স্ত্রীকে ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য, বর্বর অপরাধে যুক্ত হবে, তা কোনোভাবেই মানা যায় না। এ ধরনের ধৃষ্টতায় তারা কাদের প্রশ্রয় পায়, তাদেরসহ সকলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের চারজনের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সাধারণ সম্পাদক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই ছাত্রলীগ আমাদের না। এ নিয়ে কোনো বক্তব্য দিতে চাই না।’

জানতে চাইলে ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ছাত্রলীগ একেবারে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত একটি বৃহৎ সংগঠন। এ সংগঠনে অনেক সময় নানা স্বার্থান্বেষী লোকেরা ঢুকে যায়। তারা স্থানীয় পর্যায়ে ব্যক্তিগত নানা স্বার্থের দ্বন্দ্বে নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। এসবের দায় এসে পড়ে আমাদের সংগঠনের ওপর। আমরা কঠোরভাবে এগুলো দমনে কাজ করে যাচ্ছি।’

ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এমসি কলেজে যারা ঘৃণিত কাজটি ঘটিয়েছে, তারা ছাত্রলীগের কোনো পর্যায়ের কোনো কমিটিতেই নেই। এর পরও এর দায় ছাত্রলীগের ওপর চাপানোর চেষ্টা চলছে। ছাত্রলীগ নারীদের প্রতি শ্রদ্ধায় বিশ্বাসী। আমরা আমাদের কর্মীদের এ ধরনের নির্দেশনাই দিয়ে থাকি। আমরা কখনো নারীর প্রতি কোনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেব না।’

জানা যায়, গত ১০ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার আটিয়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি মো. সেলিমের বিরুদ্ধে টাঙ্গাইলের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ধর্ষণ ও ভিডিও ধারণের অভিযোগ দায়ের করেন এক নারী। ৬ সেপ্টেম্বর রংপুরে একজন প্রভাবশালী ছাত্রনেতার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করেন এক শিক্ষিকা। ৪ সেপ্টেম্বর ভোলার মনপুরা থানায় মনপুরা সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রাকিব হাসানের বিরুদ্ধে একটি ধর্ষণের মামলা দায়ের হয়।

৩ সেপ্টেম্বর ভোলা সদর মডেল থানায় ভেদুরিয়া ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি মামুন হাওলাদারের বিরুদ্ধে একটি ধর্ষণের মামলা দায়ের করেন এক তরুণী।

গত ২০ আগস্ট এক স্কুলছাত্রীকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে দীর্ঘ চার বছর ধরে ধর্ষণের অভিযোগে সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শেখ মেহেদী হাসান নাইচের বিরুদ্ধে কলারোয়া থানায় একটি মামলা দায়ের হয়। এর আগে গত ১২ ফেব্রুয়ারি বরিশালের বিমানবন্দর থানায় জেলা ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক বনি আমিনের বিরুদ্ধে নগরীর নথুল্লাবাদ এলাকা থেকে এক কলেজছাত্রীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়।

গত ৬ জানুয়ারি সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পরিচয়ে ফেসবুকের মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ে বিয়ের নাটক সাজিয়ে এক নারীকে ধর্ষণের অভিযোগে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আকিবুল ইসলাম আকিবের বিরুদ্ধে বাকলিয়া থানায় মামলা হয়।

গত বছরের ৮ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শরিফুর রহমান পারভেজের বিরুদ্ধে স্থানীয় যুব মহিলা লীগের এক নেত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের হয়। ওই বছরের ২৯ আগস্ট পাবনা সদর উপজেলার চরতারাপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নিরব হোসাইনের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ তোলে অন্তঃসত্ত্বা এক স্কুলছাত্রী। ১৮ আগস্ট মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার দরগ্রাম ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শরিফুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয় এক কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে।

২০১৮ সালের ৮ নভেম্বর গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা ছাত্রলীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মাহিম আহাম্মেদের বিরুদ্ধে জয়দেবপুর থানায় ধর্ষণের মামলা দায়ের হয়।

এমনকি নিজ সংগঠনের নেত্রীদেরও ধর্ষণের অভিযোগ আছে ছাত্রলীগের নেতাদের বিরুদ্ধে। ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর সিরাজগঞ্জের বেলকুচি থানার একটি স্কুল শাখার নেত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি রিয়াদ হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। এর আগে মিরপুর বাঙলা কলেজের প্রভাবশালী এক ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে সংগঠনের এক নেত্রীকে বিয়ের আশ্বাসে ধর্ষণ করার অভিযোগ ওঠে। পরে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে বিচার চেয়ে না পেয়ে আত্মহত্যা করেন ওই নেত্রী।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2020/09/28/959971