ব্যাংকের স্প্রেড (আমানত ও ঋণ সুদের মধ্যকার ব্যবধান) বেশি থাকায় অর্থনীতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতার পরিবেশ না থাকার কারণে এমনটি হচ্ছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত প্রাক-বাজেট আলোচনায় এভাবেই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে সতর্ক করেছেন অর্থনীতিবিদরা। পাশাপাশি বিদেশে অর্থ পাচারের সঙ্গে ব্যাংকগুলো জড়িত আছে কিনা এবং কি কারণে অর্থ পাচার হচ্ছে তা খতিয়ে দেখারও সুপারিশ করেছেন তারা। ওই প্রাক-বাজেট আলোচনা বৈঠকের একটি কার্যবিবরণী তৈরি করেছে অর্থ বিভাগ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সূত্র জানায়, আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন সামনে রেখে সুনির্দিষ্ট মতামত ও সুপারিশ নেয়ার জন্য ২৬ ফেব্রুয়ারি দেশের অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে বৈঠক করেন অর্থমন্ত্রী। ওই সময় বৈঠক সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘ব্যাংকিং খাতের বিশৃংখলা নিয়ে অর্থনীতিবিদরা আলোচনা করেছেন। শৃংখলা ফিরিয়ে আনতে তারা কমিশন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন। এ ব্যাপারে আগামী বাজেটে কিছু একটা করা হবে।’
সূত্র আরও জানায়, অর্থনীতিবিদরা ওই বৈঠকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের স্বার্থে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি বিদেশী ব্যাংকগুলোর স্প্রেড কমাতে অর্থমন্ত্রীকে পরামর্শ দিয়েছেন। তারা বলেছেন, ‘দেশে অনেক ব্যাংক হলেও কোনো প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি হয়নি। যে কারণে স্প্রেড হার কমানো যাচ্ছে না। এছাড়া বিদেশে অর্থ পাচারে সহায়তা করার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। দেশের অনেক কোম্পানিই এখন বিদেশে ব্যবসা করছে। মোটা অংকের টাকা বিদেশে নেয়ার ব্যাপারে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এরপরও কিভাবে বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে তা খতিয়ে দেখা দরকার।’
অর্থ বিভাগের তৈরি বৈঠকের কার্যবিবরণী সূত্রে জানা যায়, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সভায় বলেন, বর্তমান রাজস্ব আহরণ সন্তোষজনক না হলেও আগামী বছর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) রাজস্ব আহরণে বড় লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয়া হবে। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি বর্তমানে নিয়ন্ত্রণে আছে। তবে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার কিছুটা অবমূল্যায়ন হয়েছে। আগামীতে আরও কিছুটা হতে পারে। তিনি জানান, আগামী জাতীয় নির্বাচনের কারণে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে পরীক্ষামূলক নতুন কোনো উদ্যোগ থাকবে না। ফলে আগামী বাজেট হবে মেগা প্রকল্প গ্রহণের শেষ সময়। যে কারণে বাজেটের আকারও কিছুটা বড় থাকবে।
বৈঠকে অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, আগামীতে রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি আরও বাড়াতে পে-রোল ট্যাক্সের আওতা বাড়ানো দরকার। একটি বিশেষ কর্মসূচির আওতায় তা করা যেতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে মূল্যস্ফীতির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এর ফলে বাড়ছে জীবনযাত্রার ব্যয়। তাই মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পদক্ষেপ নিতে হবে। নতুন ভ্যাট আইন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এ নিয়ে বিতর্ক চলছে। আগামী পহেলা জুলাই থেকে এই আইন বাস্তবায়নে নতুন প্রতিবন্ধকতা আসবে। তবে সরকারকে খোলা মনে ব্যবসায়ীদের সমস্যাগুলো শুনতে হবে। তা আমলে নিয়ে বাস্তবতার নিরিখে নতুন বিধিমালা সাজাতে হবে। নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে সমস্যা নেই এ ধরনের ঢালাও বক্তব্য দেয়া সরকারের ঠিক হবে না।’ তিনি বৈদেশিক মুদ্রার ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও মুদ্রা বাজারের একটি দীর্ঘমেয়াদি পর্যবেক্ষণ গ্রহণ, বড় প্রকল্পে রিজার্ভের ব্যবহার ও সভরেন ওয়েলথ ফান্ডের মাধ্যমে বড় আকারে অবকাঠামো প্রকল্প বিবেচনায় নেয়ার সুপারিশ করেন।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের মহাপরিচালক কেএএম মুরশেদ বলেন, টিআইনভুক্ত করদাতা সংখ্যা বাড়ছে। তবে এরা নিয়মিত কর ও আয়কর রিটার্ন জমা দিচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ দরকার। প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে সুফল পেতে প্রকল্পের মূল্য এবং সময় নির্ধারণ গুরুত্বপূর্ণ। প্রকল্প নির্বাচনে দক্ষতা বাড়াতে হবে। প্রবাসী আয় হ্রাসের কারণ আরও গভীরভাবে খতিয়ে দেখার সুপারিশ করেন এই অর্থনীতিবিদ। এছাড়া পিপিপির মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়নে সমস্যা চিহ্নিত ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনে স্বাধীন মনিটরিং সংস্থা গঠন করার কথা বলেন তিনি।
বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকের ঋণ পুনর্তফসিলের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ সুবিধা দেয়া দরকার। বৈধ পথে রেমিটেন্স বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংককে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপ (ইআরজি) নির্বাহী পরিচালক ড. সাজ্জাদ জহির বলেন, পরিবারের দু’জন চাকরিজীবী ও করদাতা হলে একটি সমন্বিত আয়কর রিটার্ন দাখিলের ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। তিনি বলেন, ‘ব্যাংকগুলো আমানত ও ঋণের সুদের হারের মধ্যকার পার্থক্য স্প্রেডের পরিমাণ অনেক বেশি। ব্যাংকের সংখ্যা বাড়লেও প্রতিযোগিতার পরিবেশ নেই। এতে অর্থনীতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।’
অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. জামাল উদ্দিন বলেন, আর্থিক খাতের দক্ষতা ও গতিশীলতা বাড়াতে ব্যাংকিং খাতের সামগ্রিক অটোমেশন করতে হবে। শুধু উত্তোলন ও জমা পদ্ধতিতে অটোমেশন হলে চলবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্লিয়ারিং এবং সেটেলমেন্ট পদ্ধতিতে এর দক্ষতা ও নিরাপত্তা আরও বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এটি বের করে আলাদা কোম্পানি গঠন করা যেতে পারে। যা বিশ্বের অনেক দেশে আছে।