রাজধানীর সব বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়ছে। ফলে পানি হয়ে উঠেছে বিষাক্ত। ছবিটি বাবুবাজারে দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতুর নিচ থেকে তোলা : নাসিম সিকদার
২২ মার্চ ২০১৭, বুধবার, ৮:৫৫

দূষণের কবলে দেশের প্রধান নদ-নদী

আজ বিশ্ব পানি দিবস

ভয়াবহ বিপর্যয়ের কবলে দেশের প্রধান ২৩০টি নদ-নদী। দূষণ, দখল ও নাব্যহীনতার কবলে নদীগুলোর অস্তিত্ব বিলীনের পথে। যেটুকু অবশিষ্ট তাও এখন বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত। মরে সাফ হয়ে যাচ্ছে জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণিকুল। একসময়ে নদীর সুপেয় পানি এখন কালো আলকাতরা। শিল্পকারখানার বর্জ্য, কৃষিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক, কীটনাশক, নৌযানের ব্যবহৃত তেল, ট্যানারি ও মনুষ্যবর্জ্য নদী ধ্বংসের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ স্বেচ্ছাচারিতা চলতে থাকলে সেদিন দূরে নয়, যেদিন বাংলাদেশের মানুষকে পানির অভাবে মরতে হবে। বিদেশ থেকে ডলারে কিনে আনতে হবে ব্যবহার্য পানি। আর এহেন ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই আজ বুধবার বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব পানি দিবস ২০১৭।
প্রধানত, গঙ্গা-বহ্মপুত্র-মেঘনা নদী দিয়ে বয়ে আসা পলিতেই বাংলাদেশ নামের এই বদ্বীপের সৃষ্টি। একাদশ শতাব্দীতে দেশে নদীর সংখ্যা ছিল প্রায় দেড় হাজার। কালের বিবর্তনে বেশির ভাগ নদীর অস্তিত্ব আর নেই। বর্তমানে গঙ্গা-পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও বরাক-মেঘনা নদী এবং তাদের উপনদী, শাখানদী মিলেই সারা দেশের নদী নেটওয়ার্ক গঠিত। শুধু ঢাকা ও এর আশপাশে নদী রয়েছে ৩২টি। এই নদীগুলোই সর্বাধিক দূষণের শিকার। বিআইডব্লিউটিএর সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী তোফায়েল আহম্মেদ তার গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, ঢাকার জনসংখ্যা ও শিল্প দু’টিই সমানতালে বাড়ছে। ফলে এত বিপুল জনগোষ্ঠীর শহরের বর্জ্য নির্গমনের কারণে খুব সহজেই দূষিত হচ্ছে এসব নদ-নদী, জলাশয়, খাল, বিল ও জলাধার। ঢাকার সাত হাজার শিল্পপ্রতিষ্ঠান ৯টি প্রধান শিল্প এলাকা (হটস্পট) থেকে প্রতিদিন ৯০ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য এবং ১৩ লাখ ঘনমিটার পয়ঃবর্জ্য এবং চার হাজার টন কঠিন বর্জ্য ঢাকার আশপাশের নদীতে পড়ছে। ফলে পানিবাহিত রোগজীবাণু ছড়িয়ে পড়ছে মারাত্মকভাবে। পানি অক্সিজেনশূন্য হওয়ায় প্রাণধারণে অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
যেভাবে দূষণ হচ্ছে : দেশে কলকারখানাগুলো থেকে নানা রকম দীর্ঘস্থায়ী বিষাক্ত তরল পদার্থ নদীর পরিবেশের সীমাহীন ক্ষতি করে চলেছে। দূষণকারী কলকারখানার মধ্যে ট্যানারি, ইউরিয়া ও টিএসপি কলকারখানা, সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, পাল্প ও পেপার মিল, ফেব্রিক মিল, ওষুধ কারখানা, ব্যাটারি তৈরি কারখানা, ডিটার্জেন্ট ফ্যাক্টরি প্রভৃতি অন্যতম। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিবেশ অন্দোলনের (বাপা) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশজুড়ে শিল্পকারখানা থেকে বিষাক্ত কেমিক্যাল, এসিড, এলকালি, হেভি মেটাল, নানা রকম রঞ্জক পদার্থ শুধু উপরিভাগের জলরাশি নয় ভূগর্ভস্থ পানিকেও দূষিত করে তুলছে। এতে বলা হয়, সারা দেশে নিবন্ধিত ২৭৭টি চামড়া শিল্প থেকে প্রতিদিন ৮ দশমিক ৪৭ মিলিয়ন লিটার তরল বর্জ্য নিষ্কাশিত হয়। তার ৯০ শতাংশ কারখানাই ছিল ঢাকার হাজারীবাগে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ক্রোমিয়াম মিশ্রিত তরল বর্জ্য মাছের প্রজননক্ষমতা হ্রাস করে। ডায়িং কারখানা থেকে বিষাক্ত রঞ্জক পদার্থ প্রাণিকুলের নানা রকম রোগ বৃদ্ধিসহ খাদ্য চক্রের বিষক্রিয়ার প্রভাব বৃদ্ধি করছে।
এ দিকে বাপা’র পক্ষ থেকে পৌর ও শিল্পকারখানার বর্জ্যে দূষিত প্রধান ৩২টি নদী ও তার পানি দূষণকারী প্রতিষ্ঠান, ময়লা নিঃসরণের হার ও এর উপাদানের একটি তথ্য-তালিকাও প্রণয়ন করা হয়। এতে বলা হয়, ঢাকার পাশে শীতলক্ষ্যায় সিমেন্ট কারখানা ও ঘোড়াশাল সার কারখানা থেকে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। এতে প্রচুর অ্যামোনিয়া, ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড, সোডিয়াম হাইড্রো-অক্সাইড, সালফিউরিক এসিড রয়েছে। বুড়িগঙ্গায় সংযোগ রয়েছে ঢাকা মহানগরীর বৃহৎ পাঁচটি ড্রেনের। এসব ড্রেনের মাধ্যমে প্রতি সেকেন্ডে দশমিক ৬ থেকে ২ দশমিক ৯ কিউবিক মিটার অপরিশোধিত গৃহস্থালি ও রাসায়নিক দ্রব্য, তেল-গ্রিজ-লুব্রিক্যান্ট পড়ছে নদীতে। এ ছাড়া জাহাজের বর্জ্য ও শিপ ব্রেকিং ইন্ডাস্ট্র্রিজের দূষণ তো রয়েছেই। তুরাগ নদের পাশে রয়েছে যাত্রীবাহী ও ব্যবসায়িক জাহাজ এবং ২৫০টি বিভিন্ন কারখানা। এসব থেকে প্রচুর পরিমাণ পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, লোহা, তামা, দস্তা, আর্সেনিক, ব্রোমিন, সীসা, নিকেল, স্ট্রংশিয়াম, ক্যাডমিয়াম, রবিডিয়াম, থ্যালিয়াম নদীতে পড়ছে। বালু নদীর আশপাশে রয়েছে ২৬৮ বিভিন্ন ধরনের কারখানা। বংশীর তীরে বিভিন্ন ধরনের শিল্পকারখানা রয়েছে। এতে প্রচুর রাসায়নিক মিশ্রিত বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। কালীগঙ্গার আশপাশে রয়েছে ফেব্রিক কারখানা। প্রচুর রাসায়নিক মিশ্রিত বর্জ্য এতে পড়ছে। মেঘনার পাশে রয়েছে আশুগঞ্জ সার কারখানা। প্রচুর অ্যামোনিয়া ও অন্যান্য রাসায়নিক বর্জ্য ফেলা হচ্ছে ওই নদীতে। কর্ণফুলীর আশপাশে রয়েছে ৪৪১টি শিল্পকারাখানা, ৪০ থেকে ৫০টি তেল ট্যাংকার থেকে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ মিলিয়ন গ্যালন তরল, ৪০০ টন কঠিন পদার্থসহ প্রতি বছর ছয় হাজার গ্যালন তেল নদীতে পড়ছে। এতে করে পানি বিষাক্ত, মাছের বৈচিত্র্য ও সংখ্যা হ্্রাস পাচ্ছে। ভৈরব নদীর তীরে অবস্থিত খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল। এই নদীতে বর্জ্য পড়ছে সাড়ে চার হাজার কিউবিক মিটার প্রতি ঘণ্টায়। সিলেটের সুরমা ও ধনু নদীর পাশে রয়েছে ছাতক কাগজ ও পাল্প কারখানা। এ নদীতে প্রতি ঘণ্টায় ১২ শ’ থেকে ১৩ শ’ কিউবিক মিটার রাসায়নিক বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। এসব ভয়াবহ দূষণ প্রতিরোধে সরকারের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিবেশ অধিদফতর রয়েছে। কিন্তু তাদের কর্মপরিধি এতটাই সঙ্কীর্ণ যে এসব নদীদূষণ বন্ধে এ প্রতিষ্ঠান অনেকটাই অকার্যকর।
আজ বিশ্ব পানি দিবস : এমনই ভয়াবহ দূষণের দায় কাঁধে নিয়েই পালিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব পানি দিবস-২০১৭। এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে বিশ্ব পানি দিবস ও বর্জ্য পানি। এ উপলক্ষে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। আজ বুধবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সকাল ১০টায় মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। বিশেষ অতিথি হিসেবে প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বীরপ্রতীক, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রমেশ চন্দ্র সেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সমন্বয়ক (এসডিজি) আবুল কালাম আজাদ এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. জাফর আহমেদ খান উপস্থিত থাকবেন। এ দিকে এর আগে বিশ্ব পানি দিবস-২০১৭ উপলক্ষে সকাল সাড়ে ৮টায় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা হতে বিআইসিসি পর্যন্ত একটি র্যালি অনুষ্ঠিত হবে। অনুষ্ঠিতব্য র্যালিতে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সিনিয়র সচিব উপস্থিত থাকবেন।


http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/205678