নারায়ণগঞ্জের পশ্চিম তল্লা বাইতুস সালাম জামে মসজিদে বিস্ফোরণে আহত আবদুস সাত্তার নামে আরেকজন গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজের শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে মারা গেলে নিহতের স্ত্রী কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন -সংগ্রাম
১১ সেপ্টেম্বর ২০২০, শুক্রবার, ৭:৫৬

না’গঞ্জের মসজিদে বিস্ফোরণে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৩১ ॥ বাকী ৫ দগ্ধ ও শঙ্কটাপন্ন

* জমে থাকা গ্যাসের কারণেই মসজিদে বিস্ফোরণ

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরও দুইজনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নারায়ণগঞ্জের মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৩১ জন হয়েছে।

ঢাকার শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক চিকিৎসক পার্থ শংকর পাল জানান, ছয় দিন আগের ওই ঘটনায় দগ্ধদের মধ্যে মোট ৭ জন আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তাদের মধ্যে পটুয়াখালীর নজরুল ইসলাম (৫০) এবং কিশোরগঞ্জের শেখ ফরিদ (২১) গতকাল বৃহস্পতিবার বিকালে মারা যান। এই দুজনকে নিয়ে এ ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৩১ জন হল। বাকি যে পাঁচজন এখনও হাসপাতালে ভর্তি আছেন, তাদের অবস্থাও সঙ্কটাপন্ন বলে জানান ডা. পার্থ। তিনি বলেন, “তাদের সবার শ্বাসনালী পুড়ে গেছে। আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি।”

নারায়ণগঞ্জ শহরের পশ্চিম তল্লা এলাকার বায়তুস সালাত জামে মসজিদে গত শুক্রবার এশার নামাজের সময় ওই বিস্ফোরণের ঘটনার পর মোট ৩৭ জনকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে কেবল মামুন প্রধান নামের একজন চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরতে পেরেছেন।

গ্যাস পাইপলাইনের লিকেজ থেকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মসজিদের বদ্ধ পরিবেশে গ্যাস জমে এই বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে ফায়ার সার্ভিসের ধারণা।

আইসিইউতে চিকিৎসাধীন যারা

ময়মনসিংহের ত্রিশালের আব্দুর রহমানের ছেলে ফরিদ (৫৫), পটুয়াখালীর চুন্নু মিয়ার ছেলে মোহাম্মদ কেনান (২৪), নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার নিউখানপুর ব্যাংক কলোনির আনোয়ার হোসেনের ছেলে রিফাত (১৮), শরীয়তপুরের নড়িয়া কেদারপুর গ্রামের মনু মিয়ার ছেলে আব্দুল আজিজ (৪০), নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের বসিরহাট গ্রামের আবদুল আহাদের ছেলে আমজাদ (৩৭)।

আহতরা সবাই বিভিন্ন জেলার হলেও তারা শিল্প নগরী নারায়ণগঞ্জে থাকতেন। এদের প্রায় সবাই নিম্ন আয়ের মানুষ।

জমে থাকা গ্যাসের কারণেই মসজিদে বিস্ফোরণ

লিকেজ থেকে গ্যাস বের হয়ে মসজিদে জমা হয়, আর বৈদ্যুতিক স্পার্ক থেকেই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে নারায়ণগঞ্জের পশ্চিম তল্লা বাইতুস সালাত জামে মসজিদে। জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটির গত পাঁচ দিনের তদন্তে এমন তথ্যই উঠে এসেছে। তদন্ত সশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসকের কাছে ওই কমিটির প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল। তবে তদন্ত কমিটির প্রধান নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খাদিজা তাহেরা ববি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট জমা দেওয়ার জন্য আরও সাত দিনের সময় চেয়ে আবেদন করেন।

জেলা প্রশাসক মো. জসিম উদ্দিন আবেদন পাওয়ার কথা নিশ্চিত করে জানান, আবেদনের প্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দিতে আরও পাঁচ দিন সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রায় ১৫/১৬ বছর আগে পশ্চিম তল্লা জামে মসজিদটির পাকা স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। মসজিদে প্রবেশপথের গেটে একটি কলাপসিবল গেট, দুটি কাচের টানা দরজা ছিল। মসজিদের বারান্দা থেকে ভেতরের অংশ থাই দিয়ে সাঁটানো ছিল। থাই দিয়ে ঘেরা অংশের ভেতরে ১৫টি জানালা, ছয়টি এয়ারকন্ডিশন, ২৬টি সিলিং ফ্যান, ৭০টি সুইচ সকেট ছিল।

তদন্তে জানা যায়, মসজিদের বিদ্যুৎ প্যানেল বোর্ড ও ডিস্ট্রিবিউশনের দুটি লাইন ব্যবহার করা হতো। যার একটি লাইন ছিল বৈধ, অন্যটি অবৈধ। একটি লাইন ম্যানুয়ালি এবং একটি লাইন অটো ব্যবহার হতো। যা মসজিদ কমিটির সাক্ষ্যসহ অনেকের বক্তব্যে উঠে এসেছে।

এদিকে ঘটনার দিন (৪ সেপ্টেম্বর) শুক্রবার সকাল থেকেই মসজিদে গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। মসজিদের মুসল্লিরা এশার নামাজের ফরজ আদায় করে অনেকে মসজিদ থেকে বের হয়ে যান। আনুমানিক ৮টা ৪৫ মিনিটের সময় বিদ্যুৎ চলে যায়। এ সময় অনেক মুসল্লি সুন্নতসহ অন্যান্য নামাজ আদায় করছিলেন। মসজিদের মুয়াজ্জিন দেলোয়ার হোসেন এ সময় বিদ্যুতের লাইন চেঞ্জ করতে গেলে স্পার্ক হয়। এ সময় দরজা-জানালা বন্ধ থাকায় মসজিদে জমে থাকা গ্যাসের কারণে আগুন ধরে যায়। এতে মসজিদের ভেতরে থাকা মুসল্লিদের শরীরে আগুন ধরে যায়।

এছাড়া মসজিদটি যেখানে নির্মাণ করা হয়েছে সেই রাস্তা অনেক সরু এবং নিচু এলাকা হওয়ায় দগ্ধ ও হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে বলেও তদন্তে উঠে এসেছে।

নারায়ণগঞ্জে মসজিদে বিস্ফোরণএ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও তদন্ত কমিটির প্রধান খাদিজা তাহেরা ববি বলেন, তদন্তে বেশ অগ্রগতি হয়েছে। অনেক তথ্য আমরা পেয়েছি। আরও কিছু তথ্য সংগ্রহ ও সমন্বয়ের বাকি। সবকিছু যাচাই-বাছাইয়ের পর বিস্ফোরণের প্রকৃত কারণ চিহ্নিত করে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে। তিনি বলেন, পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য সাত দিনের সময় চাওয়া হয়েছিল। জেলা প্রশাসক তদন্ত কমিটিকে আরও পাঁচ দিনের সময় বাড়িয়ে দিয়েছেন।

পাঁচ দিনের তদন্তে কী উঠে এসেছে, জানতে চাইলে কমিটির প্রধান বলেন, তদন্ত চলমান। তাই কোনও মন্তব্য করা যাবে না। তবে তিনি গত বুধবার জানিয়েছিলেন, জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি বিদ্যুৎ, তিতাস গ্যাস, মসজিদ নির্মাণে ত্রুটিসহ সব বিষয়কে সামনে রেখে তদন্ত কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

এদিকে তদন্তের বাইরেও জনসাধারণ যেসব সমস্যার কথা বলছে সে বিষয়েও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মো. জসিম উদ্দিন। তিনি বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর যেগুলো তার অধীন, সেসব বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অন্য সংস্থাগুলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে চিঠি দেওয়া হবে।

এদিকে গতকালও চতুর্থ দিনের মতো তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ গ্যাস লিকেজ খোঁজার জন্য কাজ করেছে। প্রাথমিকভাবে খোঁড়ার পর দুই দিনে মোট ছয়টি লিকেজ পাওয়া গেছে। তবে তদন্ত কমিটি আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য কাজ অব্যাহত রেখেছে। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের কাজের জন্য গ্যাসলাইন বন্ধ রাখায় জনসাধারণ চরম ভোগান্তির মধ্যে আছে।

তিতাস গ্যাসের তদন্ত কমিটির প্রধান মহাব্যবস্থাপক (পরিকল্পনা) আব্দুল ওহাব তালুকদার জানান, ছয়টি লিকেজ মেরামত করে বন্ধ গ্যাস লাইনে সরবরাহ শুরু করা হয়েছে।

অন্যদিকে বিদ্যুৎ বিভাগের পশ্চিম বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আনিসুর রহমান জানান, বিস্ফোরণের পর যেসব বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল, তার মধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার বৈধ সংযোগে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়েছে। আর অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে বলে জানান তিনি।

প্রতিবেদন জমা দিতে তিতাসের গড়িমসি

মসজিদের বিস্ফোরণের ঘটনায় তিতাসের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় বাড়লো আরও চারদিন। গতকাল বৃহস্পতিবার তাদের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল। সারাদিন অপেক্ষার পর শেষ বিকেলে জানিয়ে দিলো আজ বৃহস্পতিবার দিচ্ছে না তদন্ত রিপোর্ট। ভয়াবহ এই দুর্ঘটনায় তিতাসের গড়িমসি নিয়ে এর মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। এর আগে মসজিদে নামাজরত অবস্থায় কোনও দুর্ঘটনায় দেশে এত মানুষের প্রাণহাণি ঘটেনি।

এ ঘটনার পর পরই তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক আব্দুল ওহাবের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আরও একটি কমিটিও গঠন করে। একইসঙ্গে তদন্ত কমিটি গঠন করে ডিপিডিসি। ডিপিডিসি দুদিনেই প্রতিবেদন জমা দিলে তিতাস ৫ দিনেও পারেনি। আরও ৪ দিন সময় চেয়েছে। এরমধ্যে গত চারদিন ধরেই মসজিদের উত্তর পাশে ও পূর্ব পাশে এবং দক্ষিণ পাশে বেশ কয়েকটি গর্ত খুঁড়ে লিকেজ অনুসন্ধান করেছে তিতাস।

এদিকে সময় বাড়ানোর বিষয়ে জানতে তদন্ত প্রধানকে একাধিকবার ফোন দিয়েও পাওয়া যায়নি।

সময় বাড়ানোর বিষয়টি নিশ্চিত করে তিতাসের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, তারা সময় চেয়েছে। চাইলে তো দিতেই হবে। আগামী চার কর্মদিবস অর্থাৎ বুধবার পর্যন্ত তাদের সময় বাড়ানো হয়েছে।

আগামী বুধবার বিকেল অথবা বৃহস্পতিবার সকালে প্রতিবেদন পাওয়া যাবে বলে বলে জানান সেই কর্মকর্তা। তিনি আরও বলেন, এখন কী কারণে তারা সময় চাইছে সেটি প্রতিবেদন হাতে পেলে বোঝা যাবে। এদিকে আজকেও তারা খোঁড়াখুঁড়ি করেছে। এ কারণেই হয়তো দেরি হচ্ছে।

https://dailysangram.com/post/426973