২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ১২:২৪

মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে নগরবাসী

রাজধানীতে তাপমাত্রা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। উত্তপ্ত হচ্ছে চারপাশ, ক্লান্ত হচ্ছে জনজীবন। ব্যস্ত নগরীতে রোদে পুড়ে একটু শীতলতা খুঁজে বেরাচ্ছে নগরবাসী। তীব্র গরমে কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে ওঠা শ্রমজীবীরা প্রাণ জুড়াতে হাতে তুলে নিচ্ছেন বিভিন্ন ধরনের পানীয়। স্বচ্ছল মানুষেরা বিভিন্ন জুসবার বা ডাবের পানিতে তৃষ্ণা মেটালেও স্বল্প আয়ের মানুষের ভরসা রাস্তার পাশের রকমারি শরবতের দোকানগুলো। এসব দোকান থেকে নানা রকম ঠান্ডা পানীয় পান করে তৃষ্ণা মেটাচ্ছেন তারা।

পথের ধারের এসব পানীয় কতটা নিরাপদ? কী ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন নগরীর স্বল্প আয়ের এই মানুষগুলো যারা জেনে বা না জেনে কিংবা সাধ্য অনুযায়ী রাস্তার পাশের এসব পানীয়গুলো পান করছেন? রাজধানীর গুলিস্তান, পল্টন ও স্টেডিয়াম এলাকা সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, রাস্তার পাশে বিভিন্ন রং-বেরঙের ও ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের শরবত বিক্রি হচ্ছে পুরোদমে। তাপমাত্রা যত বাড়ছে ততোই বাড়ছে মানুষের আনাগোনা। শিশু থেকে প্রাপ্তবয়স্ক সবাই পান করছে রাস্তার পাশের শরবত। এসময় কথা হয় ক্রেতা বিক্রেতা উভয়ের সঙ্গেই। এসব দোকানে লেবুর শরবত প্রতি গ্লাস ১০ টাকা, প্যাকেটজাত ফ্লেভার দিয়ে বানানো ৫০০ মিলি লিটার বোতলের শরবত ২০ টাকা, বেলের শরবত প্রতি গ্লাস ২০ টাকা ও তোকমাসহ বিভিন্ন ফল দিয়ে বানানো শরবত প্রতি গ্লাস ২০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। উন্মুক্ত স্থানে, ধুলায় আচ্ছন্ন রাস্তায় নোংরা পরিবেশে উন্মুক্তভাবে বিভিন্ন ফল সাজিয়ে রাখা হয়। এগুলো দিয়েই তৈরি হয় ফলের শরবত।

সিএনজি অটোরিকশা থামিয়ে শরবত পান করছিলেন চালক। তিনি বলেন সারাদিন রোদের মধ্যে ঘুরতে হয়। আর গাড়ির মধ্যে এমনিতেই গরম হয়ে থাকে। কত আর সহ্য করা যায়। তাই কোথাও থামলে এক গ্লাস লেবুর শরবত খাই, এটা কিছুটা শান্তি দেয়। এই লেবুর শরবত পরিষ্কার পানিতে বানানো হচ্ছে কিনা যাচাই করেছেন কখনও এই প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, হ্যাঁ, এগুলো পরিষ্কার পানি দিয়েইতো বানায়। দোকানদারতো তাই বলেছে।

এক শরবত বিক্রেতা বলেন, এখন ঢাকা শহরে আবার অপরিষ্কার পানি আছে নাকি? সবই পরিষ্কার পানি। আমি শরবত বানাই ফিল্টারের পানি দিয়ে। ফিল্টার পানি আমাকে দিয়ে যায় যারা পানি (বড় জার) বিক্রি করে।

শাহানা তার ছোট বোন ও ছোট বোনের মেয়েদের নিয়ে যাচ্ছিলেন যাত্রাবাড়ী। গরমে তৃষ্ণার্ত হয়ে রাস্তার পাশের বিক্রি করা আখের রস খেয়েছেন তারা। তিনি বলেন, এতো গরম সহ্য করা যায় না। গলা শুকিয়ে গিয়েছিল, তাই আখের রস খেলাম। এটা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। কিন্তু আখের ওপর মাছিসহ ধূলোবালি রয়েছে এটাতো ক্ষতিকর, এমনটা বললে তিনি বলেন, আমরা তো আর প্রতিদিন খাই না। এক দুই দিন খেলে কিছু হয় না।

শরবত তৈরির পানি ও বরফ কোথা থেকে আনেন জানতে চাইলে বিক্রেতা বলেন, আমি ওয়াসার পানি ফিল্টার থেকে কার্ড দিয়ে পানি আনি। আমার পানি পরিষ্কার। বরফ আনি মার্কেটের একটা দোকান থেকে সেটাও ভালো বরফ। আরেক বিক্রেতা বলেন, আমি ফিল্টারের পানি ব্যবহার করি। এখানের মার্কেটে যারা পানি দিয়ে যায় তারা আমাকেও পানি দিয়ে যায়।

বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলার পর তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী খোঁজ নেওয়া হয় স্টেডিয়াম মার্কেটের বরফের দোকানে। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম সুইমিংপুল মার্কেটের মতিউর রহমান বরফ ডিপোর বিক্রেতা বলেন, আমি মূলত বরফ রাখি খেলোয়াড়দের জন্য। তারা ব্যাথা পেলে বরফের দরকার পড়ে। অনেক সময় তারা বরফ পানি দিয়ে গোসল করে তখন নেয়। এছাড়া মার্কেটের অনেক দোকানে এসির কাজ করে। তাদেরও বরফ প্রয়োজন পড়ে। তারা আমার থেকে বরফ নেয়। এছাড়া বেশি গরম পড়লে ফ্রিজের ড্রিংকস ঠান্ডা হতে চায় না। তখন আমি এটা ব্যবহার করি। আর রাস্তার পাশের বিভিন্ন দোকানে যাদের ফ্রিজ নেই তারা ড্রিংকস ঠান্ডা করার জন্য নেয়।
রাস্তার পাশে বিক্রি করা বাহারি এসব পানীয়র মান ও স্বাস্থ্যের ঝুঁকি নিয়ে কথা হয় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, প্রচণ্ড গরমে মানুষের শরীর থেকে ঘাম আকারে পানি বের হয়ে যায়, ফলে তীব্র পিপাসা পায়। এসময় পথচারী বা রাস্তায় যারা কাজ করেন তারা রাস্তার পাশে বিভিন্ন ধরনের শরবত বা লেবুর শরবত বা পানীয় পান করে থাকেন। এই পানীয় গ্রহণ করার প্রথম বিপদ হচ্ছে এই শরবতগুলো যে পানি দ্বারা তৈরি করে সেগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই থাকে অনিরাপদ পানি। অর্থাৎ ওয়াসার সরবারহ করা পানি সরাসরি গ্রহণ করে। দ্বিতীয়ত গরমের সময় এই শরবতগুলোকে ঠান্ডা করার জন্য যে বরফ দেওয়া হয় সেগুলোর সবগুলোতেই প্রায় অনিরাপদ পানি ব্যবহার করা হয়। কারণ বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে বরফ বানানোর যে কলগুলো রয়েছে সেখানে কিন্তু নিরাপদ পানি ব্যবহার করতে আমরা এখনও দেখিনি।

পথের পাশের বিক্রি করা পানীয় স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, এই অনিরাপদ পানি বা বরফ দিয়ে বানানো শরবতগুলো খাওয়ার ফলে পানি বাহিত রোগ যেমন টাইফয়েড,জন্ডিস, হেপাটাইটিসের মতো রোগগুলো ছড়াতে থাকে। এছাড়া ফুড পয়জনিং, বমিও হতে পারে। গরমের সময় ঢাকায় কিন্তু এই অসুখগুলো বেড়ে যায়। এবারও আমরা এটাই দেখছি। এই বেড়ে যাওয়ার কারণ হচ্ছে যত্রতত্র পথের ধারের এসব শরবত বা পানীয় পান করা।

পানি বাহিত রোগমুক্ত থাকতে এবং সুস্থ থাকার পরামর্শ দিয়ে লেনিন চৌধুরী বলেন, যারা বাইরে কাজে বের হবেন তারা যেন বাসার ফুটানো পানি বা ফিল্টারের পানি সঙ্গে নিয়ে বের হন। আর যারা রিকশা চালান বা কায়িক শ্রমের কাজ করেন তারা নিরাপদ পানিতে ওরস্যালাইন দিয়ে যেন পান করেন। এতে শরীর থেকে যে লবণ বের হয়ে হয়ে যায় তার পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে এবং অসুস্থতা থেকে আমাদের রক্ষা করবে। এছাড়াও বয়স্ক ব্যক্তি, শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের তিনি এই তাপদাহে বাসার বাইরে না বের হওয়ার পরামর্শ দেন। একইসঙ্গে যারা বাইরে কাজ করেন তাদের ছাতা ব্যবহারের কথাও বলেন তিনি।

https://dailyinqilab.com/national/article/652203