৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, রবিবার, ১:১৮

নারায়ণগঞ্জের মসজিদে বিস্ফোরণে ২১ প্রাণহানি

এমন মৃত্যু দেখেনি তল্লাবাসী

বার্ন ইন্সটিটিউটে আশঙ্কাজনক ১৬ জন * তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের অবহেলাই দায়ী : এলাকাবাসী * দগ্ধদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা দেয়া হয়েছে : স্বাস্থ্য সচিব

নারায়ণগঞ্জ সদরের ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা বাইতুস সালাত জামে মসজিদে গ্যাস বিস্ফোরণের ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। শনিবার রাত দেড় পর্যন্ত দগ্ধ ৩৭ জনের মধ্যে ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। বাকিদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। শুক্রবার রাতে দগ্ধ মুসল্লিদের অনেকেরই শ্বাসনালি, মুখমণ্ডলসহ শরীরের বেশিরভাগ অংশ পুড়ে গেছে। শ্বাসনালি পুড়ে যাওয়ায় তারা কেউ আশঙ্কামুক্ত নন। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটে দগ্ধদের চিকিৎসা চলছে। এ মর্মান্তিক ঘটনায় নারায়ণগঞ্জবাসী কাঁদছেন।

গ্যাস বিস্ফোরণে মুসল্লিদের হতাহতের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। দুর্ঘটনা তদন্তে ফায়ার সার্ভিস, তিতাস গ্যাস ও জেলা প্রশাসন তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। দাফনের জন্য মৃতদেহগুলো স্বজনদের কাছে শনিবার হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ঘটনায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চত্বরসহ দুর্ঘটনাস্থলের আশপাশের পরিবেশ আত্মীয়-স্বজনদের কান্না ও আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে শেখ হাসিনা বার্ন ইন্সটিটিউটের সামনে স্বজনদের আহাজারি আক্রান্ত করছে অন্যদেরও।

শুক্রবার রাত থেকে উদ্বেগাকুল স্বজনরা অপেক্ষা করছেন হাসপাতালের সামনে। হঠাৎ হঠাৎ ভেতর থেকে মৃত্যুর খবর আসছে, সঙ্গে সঙ্গে শুরু হচ্ছে আহাজারি। কেউ সন্তান, কেউ স্বামী অথবা ভাই হারানোর ব্যথায় বিলাপ করছেন। রাতে অনেকেই স্বজনদের খুঁজে পাননি। তাদের উদ্বেগ ছিল লক্ষ করার মতো। জানতে পারছেন না তাদের ভাই বা সন্তান বেঁচে আছে না মরে গেছে। এ হাসপাতালে আছে না অন্য কোথাও নেয়া হয়েছে। তবে সময় গড়ানোর পাশাপাশি নিশ্চিত হন মসজিদে দগ্ধ সবাইকে শেখ হাসিনা বার্ন ইন্সটিটিউটেই ভর্তি করা হয়েছে।

এরপর থেকে শুরু হয় তাদের অপেক্ষার পালা। রাতেই খবর আসে এক শিশুর মৃত্যুর। এ ঘটনায় সেটাই প্রথম মৃত্যু। এরপরই শুরু হয় সন্তান হারানো মা-বাবার কান্না। যা ছুঁয়ে যায় অন্যদেরও। এভাবেই কান্না, আহাজারি ও বিলাপের মধ্যে দিয়ে পার হয়েছে শনিবার সারা দিন। দুর্ঘটনায় এত মানুষের মৃত্যুতে এলাকার মানুষ কালো পতাকা উত্তোলন করে শোক প্রকাশ করেছেন। একই সঙ্গে তারা শনিবার এলাকার সব দোকানপাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখেন। এদিকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবারকে নগদ ২০ হাজার টাকা করে অনুদান দেয়া হয়।

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটে দগ্ধদের চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে চিকিৎসক-নার্সসহ সংশ্লিষ্টরা হিমশিম খাচ্ছেন। দগ্ধদের চিকিৎসার সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর রাখছেন প্রধানমন্ত্রী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টরা। আহতদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

এদিকে, দগ্ধ ব্যক্তিদের আত্মীয়-স্বজনকে সহায়তা দিতে পুলিশ হটলাইন চালু করেছে। শুক্রবার রাতে দুর্ঘটনার পর থেকেই ফতুল্লার পশ্চিম তল্লার বাইতুস সালাত জামে মসজিদ এলাকার পরিবেশ থমকে গেছে। এমন দুর্ঘটনা কেউ মেনে নিতে পারছেন না। ক্ষোভ প্রকাশ করছেন বিভিন্ন সংস্থার ওপর। গ্যাস বিস্ফোরণের ঘটনায় এলাকাবাসী তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের অবহেলাকে দায়ী করছেন।

বিস্ফোরণের ২০ দিন আগে গ্যাস লিকেজের বিষয়টি মসজিদ কমিটির একটি প্রতিনিধি দল তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডকে জানিয়েছিল। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে জানানো হলেও তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তাই স্থানীয়রা এটি নিছক দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।

দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা বলছেন, মসজিদের এসি নয়, গ্যাস লাইন লিকেজ থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। মসজিদের দরজা-জানালা বন্ধ থাকায় লিকেজ হওয়া গ্যাস সেখানে ছড়িয়ে পড়ে ও বিস্ফোরিত হয়। তবে এ বিস্ফোরণ নিছক দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা তা খতিয়ে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এ ঘটনায় কোনো বিভাগ বা কর্মকর্তার গাফিলতি থাকলে ব্যবস্থা নেয়া হবে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। মসজিদ-মন্দির ও অন্যসব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুৎ সংযোগ ও এসির অবস্থা পরীক্ষা করার জন্য নির্দেশ দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

শনিবার বিকালে শেখ হাসিনা বার্ন ইন্সটিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ জানান, দগ্ধ বাকিদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। অনেকের শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। তাদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এর আগে বার্ন ইন্সটিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন সাংবাদিকদের জানান, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দগ্ধ ব্যক্তিদের বেশির ভাগের শরীরের ৬০ থেকে ৭০ ভাগ পুড়ে গেছে। তাদের বেশিরভাগের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তিনি আরও বলেন, সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে ফোন করেছিলেন। দগ্ধ ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতের নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।

২১ জনের মৃত্যু : বাইতুস সালাত জামে মসজিদে গ্যাস বিস্ফোরণের ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ২১ জনে দাঁড়িয়েছে। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়। তারা হলেন- মোস্তফা কামাল (৩৪), নারায়ণগঞ্জ কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. রিফাত (১৮), গার্মেন্টকর্মী মো. রাসেদ (৩০), দুই সন্তানের জনক হুমায়ুন কবির (৭০), গার্মেন্টকর্মী ইব্রাহীম বিশ্বাস (৪৩), জুয়েল, সাব্বির (২১), মসজিদের মুয়াজ্জিন মো. দেলোয়ার হোসেন (৪৮) ও তার সন্তান জুনায়েদ (১৭), চাকরিজীবী মো. জামাল আবেদিন (৪০), কুদ্দুস ব্যাপারী (৭২), পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাইনুদ্দিন (১২), জয়নাল (৫০), কাঞ্চন হাওলাদার, গার্মেন্টকর্মী নয়ন, ৭ বছরের শিশু জুবায়ের, ওয়ার্কশপ শ্রমিক রাসেল (৩৪) ও মো. বাহাউদ্দিন (৫৫), মো. মিজান (৪০), মসজিদের ইমাম আবদুল মালেক নেসারি (৫৫) ও ফটো সাংবাদিক নাদিম হোসেন (৪৫)। মৃতদেহগুলো সবুজবাগ মাঠে নেয়া হয়। সেখান থেকে হস্তান্তর করা হয় স্বজনদের কাছে।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন যারা : বার্ন ইন্সটিটিউট সূত্র জানায়, দগ্ধদের মধ্যে মো. রাসেলের শ্বাসনালিসহ শরীরের শতভাগ ও আবদুল আজিজের ৪৭ ভাগ পুড়ে যায়। এছাড়া মো. রাসেলের শরীরের ৮০ ভাগ, জয়নালের ৯০ ভাগ, কুদ্দুস ব্যাপারীর ৯০ ভাগ, ইব্রাহীমের ৯২ ভাগ পুড়ে গেছে। তাদের প্রত্যেকের শ্বাসনালি দগ্ধ হয়েছে। বার্ন ইন্সটিটিউটের সহকারী পরিচালক ডা. হুসেইন ইমাম বলেন, দগ্ধদের সবার শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। তাদের শরীরের কমপক্ষে ৩০ শতাংশের বেশি দগ্ধ হয়েছে।

ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, যারা ভর্তি আছেন, তারা কেউ শঙ্কামুক্ত নন। তাদের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ বলা যায়। কয়েকজনের শরীর কম পুড়লেও শ্বাসনালি পুড়ে যাওয়ায় অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম যুগান্তরকে বলেন, দগ্ধদের চিকিৎসায় কোনো গাফিলতি হচ্ছে না। আমাদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চিকিৎসা দেয়ার সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর শোক : এসি বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ব্যাপারে তিনি সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর রাখছেন এবং সর্বোচ্চ চিকিৎসা নিশ্চিতের নির্দেশ দিয়েছেন। শনিবার প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং থেকে দেয়া শোকবার্তায় বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন ও তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন। আহতদের দ্রুত সুস্থতাও তিনি কামনা করেছেন।

চিকিৎসায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নির্দেশ : আহতদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। একই সঙ্গে তিনি রোগীদের সব রকম সুবিধা নিশ্চিত করতেও নির্দেশ দিয়েছেন। শুক্রবার রাতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ বিভাগ থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার খোঁজ-খবর নিয়েছেন এবং এ বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দিয়েছেন।

শনিবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেছেন, বিদ্যুৎ বিভাগের কারও গাফিলতি থাকলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে স্থানীয় এমপি শামীম ওসমান বলেছেন, তদন্তের আগে কেউ কোনো মন্তব্য করবেন না। এটি নাশকতা না দুর্ঘটনা কোনোটিই বলব না। তবে নাশকতার বিষয়টিও ফেলে দেব না। তাই এ ঘটনার গভীর তদন্ত হতে হবে।

তিন তদন্ত কমিটি : ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন) লে. কর্নেল জিল্লুর রহমানকে আহ্বায়ক করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির অপর সদস্যরা হলেন- ঢাকা ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক দেবাশীষ বর্মণ, উপ-পরিচালক (অপারেশন) নুর হাসান এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আরেফিন।

তদন্ত কমিটিকে আগামী ১০ কার্য দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক খাদিজা তাহেরী ববিকে আহ্বায়ক করে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটিকে আগামী ৫ কার্য দিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড ঢাকা অফিসের মহাব্যবস্থাপক (জিএম-পরিকল্পনা) আবদুল ওহাব তালুকদারকে আহ্বায়ক করে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।

কমিটিকে ৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। ভয়াবহ বিস্ফোরণের পরপর ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। আগুন নেভানোর পর ফায়ার সার্ভিস তদন্ত শুরু করেছে। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসেন বলেছেন, নাশকতার বিষয়টিও মাথায় রেখে আমরা তদন্ত করছি। কোনো দিকই আমরা বাদ রাখব না।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আল আরেফিন জানান, মসজিদের নিচ দিয়ে (মেঝেতে) একটি গ্যাস পাইপ গেছে। এ পাইপের লিকেজ দিয়ে নির্গত গ্যাস বের হতে পারেনি। বিদ্যুতের স্পার্কিং থেকে আগুন লেগে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটতে পারে। তিনি আরও বলেন, মসজিদের মেঝেতে থাকা পানিতে গ্যাসের বুদবুদ ওঠায় সন্দেহ হয়।

পরে খোঁজ নিয়ে দেখা যায় মসজিদের নিচ দিয়ে তিতাস গ্যাসের অনেকগুলো লাইন গেছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড আগে থেকে উদ্যোগ নিলে দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটত না। মসজিদ কমিটি বলছে, ৯ মাস আগে গ্যাসলাইনের লিকেজ মেরামতের জন্য লিখিতভাবে অভিযোগ জানানো হলেও ৫০ হাজার টাকার জন্য কাজ করেনি তিতাস।

এ বিষয়ে কমিটির সভাপতি আবদুল গফুর মেম্বার বলেন, গ্যাসলাইন লিকেজ হওয়ার বিষয়টি টের পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা তা মেরামত করার জন্য তিতাসকে জানিয়েছিলাম। তখন তারা আমাদের কাছে ৫০ হাজার টাকা চেয়েছিল। আমরা টাকাটা জোগাড় করতে পারিনি বলে আর মেরামত করা হয়নি। শনিবার সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আলী মোহাম্মদ আল মামুন বলেন, তদন্ত চলছে। কেউ দায়ী হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিতাসের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

ঘটনার ২০ দিন আগে তিতাস গ্যাসে গিয়েছিল মসজিদ কমিটি : বিস্ফোরণের ২০ দিন আগে গ্যাস লিকেজের বিষয়টি মসজিদ কমিটির সভাপতি গফুর মেম্বারের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডকে জানিয়েছিল। মসজিদটির ধর্মবিষয়ক সম্পাদক মাওলানা মোহাম্মদ আল-আমিন বলেন, প্রায় পৌনে এক বছর ধরেই আমরা একাধিকবার বিষয়টি জানিয়েও কোনো ফল পাইনি।

আগে বা পরেও তো এমন ঘটনা ঘটতে পারত। যদি জুম্মার নামাজের সময় এ ঘটনা ঘটত তবে তো লাশ রাখার জায়গা দেয়া যেত না। মাওলানা আল-আমিন বলেন, আমরা নামাজে এলেই গ্যাসের গন্ধ পেতাম। দিন দিন এ গন্ধ বেড়েই চলেছিল। পরে মসজিদ কমিটির সভাপতি নেতৃত্বে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে জানানো হলেও তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তিনি আরও বলেন, মসজিদের সামনে দিয়ে গ্যাসের রাইজার ও লাইনগুলো গেছে।

তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ চাইলে এক ঘণ্টায় এটি সমাধান করতে পারত। তারা তা করেনি। তাদের গাফিলতিতে এতগুলো প্রাণ হারাল তল্লাবাসী। তিনি বলেন, তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানাইনি আমরা, এটি আমাদের ভুল ছিল হয়তো। আর সেটিই এখন সামনে এসেছে। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে অনবরত গ্যাস বের হচ্ছে, তবুও তারা আসেনি।

দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিতের দাবি মানবাধিকার কমিশনের : ঘটনায় দায়ীদের দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। শনিবার গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গ্যাস সংযোগ পাইপের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। এতে তিতাস গ্যাসের গাফিলতির অভিযোগ রয়েছে। এ ঘটনায় তিতাস ও মসজিদ কমিটিসহ দায়িত্বশীলদের গাফিলতি আছে কিনা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। যথাযথ তদন্ত করে জড়িতদের দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম এক শোকবার্তায় নিহতদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন।

রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সহায়তা : বিস্ফোরণের ঘটনায় মুমূর্ষু রোগীদের চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় রক্ত সহায়তা দিয়েছে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। শনিবার সোসাইটির পক্ষ থেকে ১০০ ইউনিট ব্লাড (ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা) শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটের ব্লাড ইউনিটের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৫ ইউনিট ‘এ’ পজিটিভ, ৩০ ইউনিট ‘বি’ পজিটিভ, ৪০ ইউনিট ‘ও’ পজিটিভ এবং ৫ ইউনিট ‘এবি’ পজিটিভ ব্লাড রয়েছে। যুব রেড ক্রিসেন্ট জাতীয় সদর দফতরের ব্লাড বিভাগের প্রধান জানান, রক্তের জরুরি প্রয়োজন মেটাতে আরও ২৫০ জন ব্লাড ডোনার (রক্তদাতা) প্রস্তুত রাখা হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের চাহিদা অনুযায়ী ব্লাড সরবরাহ করা হবে।

স্বজনদের জন্য সহায়তা কেন্দ্র ও হটলাইন : আহত ও নিহতদের আত্মীয়-স্বজনদের সহায়তায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহায়তা কেন্দ্র খোলা হয়েছে। স্বজনরা এখান থেকে সব ধরনের তথ্য ও সহযোগিতা পাবেন। এছাড়া মরদেহ হস্তান্তরের বিষয়ে সহায়তা দিতে স্বজনদের জন্য একটি হটলাইন খুলেছে পুলিশ। নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিনের পক্ষ থেকে জানানো হয়- মরদেহ গ্রহণ ও হস্তান্তরের জন্য স্বজনদের ০১৭৩২-৮৯২১২১ নম্বরে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/341763