৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, রবিবার, ১২:৫৬

মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ড এবং ইউএনও হত্যা চেষ্টা : প্রশাসনে অশনি সংকেত

আসিফ আরসালান : ২৩/২৪ বছর আগে ‘দৈনিক সংগ্রামে’ আসিফ আরসালান নামে এই কলামটি লেখা শুরু করেছিলাম। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত অবিরাম লিখে যাচ্ছি। কিন্তু গত মার্চ মাসে কোভিডের প্রাদুর্ভাবের পর লেখার পরিধি সঙ্কুচিত হয়ে এসেছে। যেহেতু পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশে করোনার আক্রমণ হয়েছে এবং প্রতিটি দেশেই হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছেন তাই বিশ্বব্যাপী রাজনীতি স্তব্ধ হয়ে গেছে। কর্তৃত্ববাদী শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে বাংলাদেশ বিরোধীদলীয় রাজনীতি আগেই পিষ্ট হয়ে গিয়েছিল, সেখানে করোনা ভাইরাস বোঝার ওপর শাকের আঁটি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতি এখন স্তব্ধ, মন্থর। সংগ্রামে আমি দুই আড়াই দশক ধরে পলিটিক্যাল কলাম লেখা শুরু করি। কিন্তু ২০০৯ সালের পর থেকে নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ কলাম লেখার স্পেস মারাত্মক ভাবে সঙ্কুচিত হয়।

কোভিড-১৯ রাজনীতিকে, বিশেষ করে নিরপেক্ষ বস্তুনিষ্ঠ রাজনীতিকে থামিয়ে দিয়েছে। কিন্তু রাজনীতিতে দুর্নীতি এবং দুর্বৃত্তায়ন থামাতে পারেনি। অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার ঠান্ডামাথায় হত্যাকাণ্ড রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রচণ্ড ঝাঁকি দিয়েছে। এবারেই প্রথম দেখলাম যে একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ডের দুই তিন দিনের মাথায় সেনা প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ এবং পুলিশ প্রধান ড. বেনজীর আহমেদ হেলিকপ্টারে চড়ে অনুষ্ঠানে যান এবং সংশ্লিষ্টদের সাথে বৈঠক করেন। বোঝা গেল, এই ক্যালকুলেটেড হত্যাকাণ্ডকে কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিয়েছেন। সেনা প্রধান এবং পুলিশ প্রধান অনেক উঁচু স্তরের কর্র্তৃপক্ষ। কিন্তু যেভাবে তাদেরকে পাঠানো হল, তাতে মনে হয়, আরও হায়ার অথরিটির নির্দেশে তাদেরকে সেখানে পাঠানো হয়েছে।

এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত শুরু হয়েছে। তদন্তে র‌্যাবের কমিটিকে সামনে দেখা যাচ্ছে। গত ৩রা সেপ্টেম্বর সেনা প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের কথায় জানা গেল যে সেনাবাহিনীও তাদের নিজস্ব ধারায় তদন্ত করছে। দেখা যাক, এসব তদন্তের ফলাফল কি দাঁড়ায়। তবে কয়েকটি প্রশ্নের জবাব এখনো মেলেনি। অথবা এমনও হতে পারে যে তদন্ত কমিটি সমূহ হয়তো সেগুলোর জবাব ইতোমধ্যেই পেয়ে গেছেন। কিন্তু অধিকতর তদন্তের স্বার্থে সেগুলো প্রকাশ করেননি। প্রশ্ন গুলো হচ্ছে, সাড়ে ১০টা-১১টার দিকে মেজর সিনহা নিহত হলেন, আর রাত দুটো বা আড়াইটার দিকে পুলিশ সিনহার রেস্ট হাউজে গেল কেন? সেখানে তারা রাত ৪টা পর্যন্ত কি খোঁজাখুঁজি করলো? সেখান থেকে তারা নাকি ল্যাপটপ, ক্যামেরা এবং আরও কিছু ডকুমেন্টস নিয়ে গেছে। কেন পুলিশ সেখানে নিশিরাতে অভিযান চালায়? আটককৃত ল্যাপটপ এবং অন্যান্য ডকুমেন্টেস এর মধ্যে এমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিল কি? থাকলে সেগুলো কি?

॥ দুই ॥
আরও প্রশ্ন আছে। দেড় মিনিটের মধ্যে লিয়াকত পর পর ৪টি গুলি করলো কেন? পত্র পত্রিকার মতে মেজর সিনহা তো তাঁর পিস্তল বের করেননি। তাকে নামতে বললে তিনি গাড়ি থেকে নেমে যান। নিজের পরিচয়ও দেন। তারপরও তাকে গুলি করতে হল কেন? পত্র পত্রিকায় আরও খবর বেরিয়েছে যে ওসি প্রদীপ এসে দেখেন যে মেজর সিনহা গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছেন। ওসি জানতে চান যে মেজর সিনহা কি এখনও জীবিত? যখন বলা হয় যে তিনি এখনও জীবিত তখন ওসি প্রদীপ মাটিতে পড়ে থাকা সিনহাকে বুট দিয়ে লাথি মারেন এবং তার রিভলভার থেকে আরও দুটি গুলি করেন। ফলে সিনহার মৃত্যু ঘটে। সিনহার ওপর প্রদীপের এই আক্রোশ কেন? কেন তিনি সিনহার মৃত্যু নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন?

পত্র পত্রিকার রিপোর্ট বেরিয়েছে সিনহা নিহত হওয়ার পর ওসি প্রদীপ এসপিকে ফোন করেন। বলেন, একটি খারাপ ঘটনা ঘটে গেছে। বড় বিপদে পড়েছি স্যার। আমাকে সাহায্য করেন। সব ঘটনা শুনে এসপি নাকি বলেন, দেখছি কি করা যায়। এরপর এসপি কি করেছেন সেটি আর পত্রিকায় আসেনি। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই এসপিকে প্রত্যাহার করা হয়নি কেন? আমরা এ কথা বলছি না যে এসপি এই ঘটনার সাথে জড়িত আছেন অথবা নাই। তবে নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে সংশ্লিষ্ট সকলকে প্রত্যাহার করতে হয়, এটাই নিয়ম। যেহেতু এই হত্যাকাণ্ড তদন্তাধীন এবং সেনা প্রধান ও পুলিশ প্রধান উভয়েই আশ্বাস দিয়েছেন যে এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচার হবে তাই এ সম্পর্কে আমরা এই মুহূর্তে আর কোনো মন্তব্য করছিনা।

॥ তিন ॥
এই মুহূর্তে আরেকটি ভয়াবহ এবং নৃশংস ঘটনা ঘটেছে। ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যতটুকু ডেভেলপমেন্ট পাওয়া গেছে ততটুকু পড়ে আতঙ্কিত এবং শিহরিত হয়েছি। ভাবছি, দেশটা যাচ্ছে কোথায়? ওয়াহিদা খানম দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের সিটিং ইউএনও বা উপজেলা নির্বাহী অফিসার। তিনি তাঁর সরকারি বাসভবনেই বাস করছিলেন। ২ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতের তৃতীয় প্রহরে সন্ত্রাসী এবং গুন্ডারা তাঁর বাসার ভেন্টিলেটর ভেঙে তার ঘরে প্রবেশ করে এবং লোহার হাতুড়ি দিয়ে তার মাথায় আঘাত করে। তার মাথার খুলি ভেঙে যায়। মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে রংপুর নিয়ে এলে এয়ার এ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়। শুক্রবার বেলা ৪টায় যখন এই রিপোর্ট লিখছি তখন দৈনিক পত্রিকাগুলোতে দেখালাম যে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে তার মাথার অপারেশন হয়েছে। আড়াই ঘণ্টা ব্যাপী করা এই অপারেশনের পরে শুক্রবার তার জ্ঞান ফিরেছে। রোববার যখন এই লেখাটি বের হবে তখন ওয়াহিদা খানম হয়তো আরও সুস্থ হয়েছেন। দয়াময় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, ওয়াহিদা যেন সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন।

এটি নিঃসন্দেহে এ্যাটেম্পট টু মার্ডার, হত্যা চেষ্টা। একজন সরকারি অফিসার এবং মহিলার ওপর ঘাতকদের এই হামলার নিন্দা করার ভাষা আমাদের নাই। কিন্তু হত্যা করতে চেষ্টা করেছিল কারা? হামলাকারীদের চিনিয়ে দিয়েছেন স্বয়ং ঐ এলাকার এমপি। দিনাজপুর-৬ (হাকিমপুর, নবাবগঞ্জ ও ঘোড়াঘাট) আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য শিবলী সাদিক। অন লাইন নিউজ পোর্টাল ‘শীর্ষ নিউজের’ ৪ সেপ্টেম্বরের খবরে প্রকাশ, এমপি শিবলী সাদিক বলেছেন, ঘোড়াঘাট উপজেলা যুবলীগের আহবায়ক জাহাঙ্গীর হোসেনের ছত্রছায়ায় ইউএনও ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলার সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে।

তিনি অভিযোগ করেছেন, আসাদুল, জাহাঙ্গীর ও আরও একজন গ্রেফতার হয়েছে। তাদের (জাহাঙ্গীর ও আসাদুল) বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এলাকায় সন্ত্রাস ও মাদকের বিস্তারের একাধিক মামলা রয়েছে। এ কারণে তাদের দল থেকে বহিষ্কারসহ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমি আড়াই থেকে তিনমাস আগে যুবলীগের স্থানীয় নেতাদের ও সেন্ট্রাল নেতাদের একাধিকবার জানাই। স্থানীয় পর্যায়েও জেলা কমিটি থেকে চিঠি দিয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত চিঠির কোনো উত্তর আসেনি। এদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হলোনা, দেশবাসীসহ আমারও প্রশ্ন। আমি জানতে চাই।

আওয়ামী লীগের এই এমপি আরও বলেন, “এরা মাদকাসক্ত। এরা একাধিক মামলার আসামী। জাহাঙ্গীর, আসাদুল, নান্নু- এরা একই গ্রুপে চলাচল করে। জমিজমা কেনা সংক্রান্ত, বিশেষ করে ওসমানপুর কেন্দ্রিক বিষয়ে এদের অনেক দৌরাত্ম্য। আমি একাধিকবার তাদের বিষয়ে চিঠি দিয়েও কোনো জবাব পাইনি। তিনি আরও বলেন, ইউএনও’র ওপর হামলার ঘটনায় এই যে আওয়ামী লীগের ওপর দাগ পড়ে গেল, এর জবাব কে দেবে? যারা দায়িত্বে আছেন, তাদেরই দিতে হবে।

অন লাইন দৈনিক নিউজ পোর্টাল ‘শীর্ষ নিউজ’ দিনাজপুর জেলা যুবলীগ সভাপতি পারভেজের সাথে যোগাযোগ করে। রাশেদ পারভেজ বলেন, গত ৭ জুন স্থানীয় সংসদ সদস্য শিবলী সাদিকের তরফ থেকে অভিযুক্ত যুবলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত সে চিঠির উত্তর পাওয়া যায়নি। ঘোড়াঘাট উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক নিরূপ সাহা জানান, জাহাঙ্গীর হোসেন উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ সম্পর্কে জেলা যুবলীগের কাছে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।

শুক্রবার ভোরে হিলি ও ঘোড়াঘাট থেকে আসাদুল হক ও জাহাঙ্গীর হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডে সন্দেহভাজন হিসাবে ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্যে যুবলীগের আহবায়ক জাহাঙ্গীর হোসেন, যুবলীগ কর্মকর্তা আসাদুল, নবীরুল প্রমুখ রয়েছে।

গত শুক্রবার সন্ধ্যায় এক প্রেস ব্রিফিংয়ে রংপুর র‌্যাব-১০ অফিসে কমান্ডার রেজা আহমেদ ফেরদৌস বলেন যে আটক তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তারা বলে যে চুরির উদ্দেশ্যে তারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আরও তদন্ত করবে। ঐ দিকে স্থানীয় যুবলীগের আহবায়ক জাহাঙ্গীর হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদের পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

আগেই বলেছি যে মেজর সিনহা হত্যার তদন্ত চলছে। তাই আমরা সরাসরি কোনো মন্তব্য করি নাই। ওয়াহিদা খানম হত্যা চেষ্টায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই বলা ঠিক হয়নি যে চুরির উদ্দেশ্যে এই বর্বর হামলা চালানো হয়েছে। এর ফলে ঘটনার গুরুত্ব খাটো হয়ে যায়। আওয়ামী লীগের এমপি শিবলী সাদিক বলেছেন যে ইউনিয়ন যুবলীগের আহবায়ক জাহাঙ্গীর হোসেনের সার্বিক পরিচালনায় এই হামলা হয়েছে।

অথচ র‌্যাব তাকে গ্রেফতার করে কয়েক ঘন্টা পরই ছেড়ে দিয়েছে। এই ধরণের কাজে জনগণের কাছে ভুল বার্তা যায়।

অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার অথবা ইউএনও এর মতো প্রথম শ্রেণীর সরকারি অফিসারের ওপর হামলা হালকাভাবে নেওয়া যায় না। ৫ সেপ্টেম্বর ইংরেজি ‘ডেইলি স্টারে’ দেখলাম, পুলিশ ভ্যানে বন্দী অবস্থায় ওসি প্রদীপ এবং লিয়াকত কোনো এক ব্যক্তিকে মোবাইল ফোনে ‘স্যার’ বলছে এবং জানাচ্ছে যে রিমান্ডে থাকা অবস্থায় তাদের ওপর টর্চার করেছে র‌্যাব। এই ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে। প্রশ্ন হল, প্রিজন ভ্যানে কিভাবে আসামীরা মোবাইলে কথা বলতে পারে এবং কিভাবে সেটি ভিডিও হয়ে ভাইরাল হতে পারে? প্রশাসনে কোথাও না কোথাও ছিদ্র আছে। ছিদ্রগুলো বন্ধ করা দরকার।
asifarsalan15@gmail.com

https://dailysangram.com/post/426412