২৭ আগস্ট ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৮:৪২

বন্যাকবলিত এলাকার আতংক পানিবাহিত রোগ

উত্তর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপটি এখন সুস্পষ্ট লঘুচাপে পরিণত হয়েছে। এ কারণে সাগর উত্তাল। এর প্রভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঝড়ো হাওয়া বইছে। কোথাও কোথাও ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টিও হচ্ছে। বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের আবহাওয়া হঠাৎ করেই খারাপ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। সাগরে তিন এবং নদীতে দুই নম্বর হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।

আবহাওয়াবিদ বজলুর রহমান জানান, সাগরে লঘুচাপটি সুস্পষ্ট লঘুচাপে পরিণত হয়েছে। ফলে সারাদেশেই ঝড়ো হাওয়া বইছে। বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলে। লঘুচাপটি মূলত ভারতের উড়িষ্যা দিয়ে যেতে পারে। এখন উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে।

আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, লঘুচাপের প্রভাব এবং সাগরে মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলে ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি হচ্ছে। ফলে সাগরে তিন এবং নদীতে দুই নম্বর হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। উত্তর বঙ্গোপসাগর এবং আশেপাশের এলাকায় সুস্পষ্ট লঘুচাপটি উত্তর পশ্চিম বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে। মৌসুমি বায়ুর অক্ষ রাজস্থান, সুস্পষ্ট লঘুচাপের কেন্দ্রস্থল বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও রাজস্থান হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। এর বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর সক্রিয় ও উত্তর বঙ্গোপসাগরে মাঝারি অবস্থায় বিরাজ করছে।

পূর্বাভাসে বলা হয়, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের অধিকাংশ জায়গায়, ঢাকা, সিলেট ও ময়মনসিংহ, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী বা অতি ভারী বৃষ্টি হতে পারে।

এদিকে আবহাওয়ার এক সতর্কবার্তায় বলা হয়, উত্তর বঙ্গোপসাগর এবং আশেপাশের এলাকায় সুস্পষ্ট লঘুচাপটি উত্তর পশ্চিম বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে। এর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগরে মৌসুমি বায়ু সক্রিয় এবং সঞ্চালনশীল মেঘমালার সৃষ্টি হয়েছে। এর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর ও এর আশেপাশের উপকূলীয় এলাকার ওপর দিয়ে ঝড়ো হাওয়া হয়ে যেতে পারে। এজন্য চট্টগ্রাম, মোংলা, কক্সবাজার ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে তিন নম্বর সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে মাছ ধরার নৌকা, ট্রলারগুলোকে উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে।

একই কারণে উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা ও তাদের আশেপাশের দ্বীপ ও চরগুলোর নিম্নাঞ্চলে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ১ থেকে ২ ফুট বেশি উচ্চতার জোয়ার হতে পারে।

গতকাল বুধবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত নদীবন্দরের পূর্বাভাসে বলা হয়, রাজশাহী, রংপুর, পাবনা, বগুড়া, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, ঢাকা, ফরিদপুর, যশোর, কুষ্টিয়া, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং সিলেট অঞ্চলগুলোর ওপর দিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব দিক থেকে ঘণ্টায় ৬০ থেকে ৮০ কিলোমিটার বেগে বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। এসব এলাকার নদীবন্দরকে দুই নম্বর নৌ হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়। এছাড়া দেশের অন্য এলাকায় ৪৫ থেকে ৬০ কিলোমিটার বেগে বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। এসব এলাকার নদীবন্দরকে এক নম্বর নৌ হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়।

এদিকে বন্যাকবলিত এলাকায় মানুষের আতঙ্ক এখন পানিবাহিত রোগ। এই সময়ে এটি একটি দুর্ভোগও। এই আতঙ্ক এবং দুর্ভোগ নিয়েই বসবাস করছেন দেশের ৩৩টি জেলার প্রায় ৮ লাখ পরিবারের প্রায় ৫০ লাখ বানভাসি মানুষ। দীর্ঘ ৪৬ দিন পানির নিচে তলিয়ে থাকা কাদা কাদা ঘর, অবিরাম বৃষ্টি তার ওপর পানিবাহিত ডায়রিয়া, আমাশয়, জন্ডিসসহ নানা ধরনের চর্ম রোগে জর্জরিত এসব বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ। ঘরে খাবার নেই, নেই সুপেয় পানিও। পরপর তিন দফা বন্যায় অনেক টিউবওয়েল নষ্ট হয়ে গেছে। পুকুরেও ঢুকেছে দূষিত পানি। খালে বিলে নদীতে হাওরে এখন পানি থই থই করলেও খাবার যোগ্য পানি মিলছে না কোথাও। কূলকিনারা না পেয়ে এসব পানি খেয়েই পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। সরকারি ত্রাণ সহায়তা কেউ কেউ কিছুটা পেলেও অনেকেই বলছেন, তা তারা চোখেও দেখেননি। বানভাসি মানুষের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স কো-অর্ডিনেশন সেন্টার (এনডিআরসিসি) সূত্রে জানা গেছে, ২৫ আগস্ট পর্যন্ত বন্যাকবলিত ৩৩ জেলার ৭ লাখ ৯২ হাজার ৭৪৮ পরিবারের ৪৯ লাখ ৫২ হাজার ৪৩৭ জন মানুষ বানভাসি। প্রায় ৮ লাখ পরিবারের ৫০ লাখ মানুষ পানিবাহিত রোগের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন। বন্যার পানিতে ঘর-দুয়ার ভেঙে গেছে, আয় নেই, রোজগারের পথ নাই, ঘরে খাবার নেইÍএমন অবস্থায় নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে তারা এখন দিশেহারা। স্থানীয় হাসপাতালেও চিকিৎসা হচ্ছে না বলে অভিযোগ তাদের।

জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার ১নং কুলকান্দি ইউনিয়নের বাসিন্দা দিনমজুর হরি নারায়ণ দাস জানিয়েছেন, এবারের বন্যায় যে কী পরিমাণ দুর্ভোগ হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এতো লম্বা সময় বন্যার পানিতে তলিয়ে থাকা ঘরবাড়িতে এখন আর বসবাসের উপায় নাই। ঘরের চাল থেকে শুরু করে পর্যায়ক্রমে ঘরদুয়ারের সবকিছুই বদলাতে হবে। পানিতে পচে গেছে সব। ভাঙা বাড়িঘর রোদে শুকায় আর মড়মড় করে ভেঙে পড়ে। এখন এগুলো ঠিক করবো নাকি চিকিৎসা করাবো তা ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছি না।
তিনি জানান, বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে ঠিকই, কিন্তু ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এর সঙ্গে আছে আমাশয় এবং জন্ডিস। সরকারি হাসপাতালে সব রোগের একই চিকিৎসা দেয় বলে মনে হয় হরি নারায়ণের। তিনি জানান, সরকারি হাসপাতালে জ্বর আর জন্ডিসের একই ওষুধ। ডায়রিয়ার স্যালাইন মাঝেমধ্যে পাওয়া যায়, বেশিরভাগ সময় পাওয়া যায় না। তখন বাইরের দোকান থেকে কিনতে হয়। একইভাবে গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা, কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী, শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলায়ও বন্যার পানি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পানিবাহিত রোগ দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন সেখানকার বানভাসি মানুষেরা।

ইসলামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. এম তাহের জানিয়েছেন, এখনও তেমন মারাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। তবে আমাদের প্রস্তুতি নেওয়া আছে। মেডিক্যাল টিম গঠন করা আছে। যেকোনও জরুরি প্রয়োজনে বা পরিস্থিতিতে আমরা চিকিৎসা সেবা দিতে পারবো।

এদিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান জানিয়েছেন, ৯৮-এর বন্যার তুলনায় এবার বন্যার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম। ওই সময় প্রায় ৪০ জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এবার ৩৩ জেলা। একইভাবে সে সময় প্রায় ৫০ ভাগ এলাকা প্লাবিত হয়, এবার প্লাবিত হয়েছে ৩০ ভাগ এলাকা। সে সময় বন্যা স্থায়ী হয়েছিল ৬৯ দিন, এবার ৪৬ দিন। তিনি জানান, আমরা রিলিফ বেইজ জায়গা থেকে বের হয়ে দুর্যোগের ঝুঁকি কমানোর চেষ্টা করছি। এজন্য নদী শাসন, নদীভাঙন রোধে নানা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। দেশে আরও ৩ হাজার ১৮৭টি বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র এবং মুজিব কেল্লা নির্মাণ করা হবে। ১১০টি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র, ২০ ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র এবং ৫৭টি মুজিব কেল্লা এক বছরের মধ্যে করার জন্য পরিকল্পনা করেছি।

https://dailysangram.com/post/425393