২১ মার্চ ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:৩৫

নিরাপদ পানির স্তর দ্রুত নিচে নামছে

সরবরাহ লাইনের মাধ্যমে ঘরে ঘরে পৌঁছে যাওয়া পানিও এখনো পুরোপুরি নিরাপদ হয়ে উঠতে পারছে না মানুষের কাছে। দূষণ, দুর্গন্ধ আর রোগ-জীবাণুর ভয় লেগেই আছে। তার ওপর রয়েছে পানি না থাকার যন্ত্রণা। প্রতিদিনই রাজধানীর কোথাও না কোথাও পানির ভোগান্তি লেগেই থাকে। ঢাকার বাইরের পরিস্থিতিও খুব ভালো না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূ-উপরিভাগের পানিদূষণ আর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় এ পরিস্থিতির মুখে পড়তে হচ্ছে মানুষকে। ঢাকার আশপাশের নদীগুলোর পানি মাত্রাতিরিক্ত দূষিত হয়ে পড়ায় ওই পানি প্রক্রিয়াজাত করেও পুরোপুরি নিরাপদ করা যাচ্ছে না।


পানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. এম আশ্রাফ আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ঢাকায় পানির বিপদ এখন ভয়াবহ। প্রতিবছর প্রায় এক মিটার করে নিচে নেমে যাচ্ছে ঢাকার ভূগর্ভস্থ নিরাপদ পানির স্তর। তিনি বলেন, স্বাভাবিক নিয়মে ভূগর্ভস্থ পানির যে স্তরটুকু খালি হয় সেটা আবার পরবর্তী সময়ে প্রাকৃতিকভাবেই পূরণ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ঢাকাসহ আরো কিছু এলাকায় সেটা হচ্ছে না। ভূগর্ভের পানি শুধু কমছেই। আগে থেকেই অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে অতিমাত্রায় নলকূপ বসিয়ে ইচ্ছেমতো পানি তুলে ফেলায় অবস্থা এমন হয়েছে যে এখন আর পানি নাগালে পাওয়া যাচ্ছে না।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, সরকার বিভিন্নভাবে চেষ্টা করলেও ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট দিয়ে পানি সঠিক মাত্রায় নিরাপদ করা যাচ্ছে না মারাত্মকভাবে নদী দূষণের ফলে।


পানি বিশেষজ্ঞরা জানান, নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন এখন জাতিসংঘ স্বীকৃত একটি মানবাধিকার। তথ্য-উপাত্ত অনুসারে, এখনো বিশ্বের প্রায় ৯০ কোটি মানুষ নিরাপদ পানি সুবিধা থেকে বঞ্চিত। নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশনের অভাবে সৃষ্ট রোগব্যাধিতে প্রতিবছর বিশ্বে পাঁচ বছরের কম বয়সী ১৫ লাখ শিশু মারা যায়।


একজন পরিবেশবিদ বলেন, প্রাচীনকাল থেকে সারফেস ওয়াটার বা মাটির ওপরের পানিই ব্যবহার করে আসছিল মানুষ। তখন নদ-নদী বা অন্যান্য জলাশয়ের পানি সেলফ পিউরিফিকেশন সিস্টেমে প্রাকৃতিক উপায়ে স্বয়ংশোধিত পদ্ধতিতে দূষণমুক্ত হতো। কিন্তু জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ও শিল্পায়নের দরুন এ পদ্ধতি ক্রমেই অকার্যকর হতে থাকে। শুরু হয় গভীর কিংবা অগভীর নলকূপের সাহায্যে মাটির নিচের পানি ব্যবহার। কিন্তু এর ফলে মাটির নিচের পানিস্তরও নিচে নামতে শুরু করে। এ অবস্থায় বর্তমানে বিশ্ব এক গভীর সংকটের মুখে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে পরিবেশদূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং মরুকরণের ফলে পানি সংকট আরো তীব্র হচ্ছে। বিশুদ্ধ পানি সংকটের কারণে বিশ্বের ১০০ কোটির বেশি মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা আজ ঝুঁকির মুখে। প্রতিবছর বিশ্বে ২৫ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায় পানির অভাবে কিংবা দূষিত পানি পান করে। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও বালু নদীর পানিদূষণের কারণে রাজধানীর এক কোটির বেশি মানুষের জন্য সুপেয় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে হুমকির মুখে পড়েছে জনস্বাস্থ্য।


অধ্যাপক ড. এম আশ্রাফ আলী বলেন, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে বলেই সরকার ২০২১ সালের মধ্যে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা নিয়েছে। বাকি ৭০ শতাংশ জোগান দেওয়া হবে সারফেস ওয়াটারের মাধ্যমে। নির্ধারিত সময়ের আগেই হয়তো টার্গেট পূরণ করা যাবে।


ওয়াসার কর্মকর্তারা জানান, ঢাকার আশপাশের নদীগুলো অতিমাত্রায় দূষিত হওয়ায় বড় বিপত্তি ঘটেছে। এ জন্য এখন পদ্মা ও মেঘনা নদী থেকে পানি এনে তা শোধন করে ঢাকার মানুষের মধ্যে সরবরাহ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ঢাকায় আপাতত শীতলক্ষ্যার পানি পরিশোধন করতে হচ্ছে দুই ধাপে। প্রথমে এক দফায় দূষিত পানি পরিশোধন করে সাধারণ নদীর পানির মতো করা হয়। এরপর এই পানি আবার পরিশোধন করে খাওয়ার উপযোগী করা হচ্ছে। এ জন্য ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এক কথায় নদীর পানি যত দূষিত হবে তা পরিশোধন করতে তত বেশি খরচ হবে।


পানি বিশেষজ্ঞরা বলেন, আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে অন্যতম ওয়াদা ছিল ২০১১ সালের মধ্যে সবার জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা। কিন্তু প্রথম পাঁচ বছর পার হওয়ার পর আরো প্রায় তিন বছরেও সরকারের পদক্ষেপে কার্যকর অগ্রগতি নেই বললেই চলে। পানির উৎস বাড়লেও তা নিরাপদ হচ্ছে না। পাশাপাশি সরকারের পর্যাপ্ত নজরদারির অভাবে গৃহীত পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নে দুর্নীতি-অনিয়মের সুযোগ নিচ্ছে অনেকেই।


স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় ৬১ জেলার ২৭১ উপজেলার ৮৫৪০টি গ্রামে ৮০ শতাংশ পানির উৎস আর্সেনিকযুক্ত ছিল। ফলে মাত্র ২০ শতাংশ জনগণ নিরাপদ পানি পেয়েন। বর্তমান সরকারের সময় স্থানীয় সরকার বিভাগ ও এর সহযোগী সংস্থাগুলোর কার্যকর পদক্ষেপে ৬১ জেলায় ৫০ শতাংশ মানুষকে নিরাপদ পানি সরবরাহ করা সম্ভব হয়েছে।


জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে মোট ১৪ লাখ ৮১ হাজার ৮৬৫টি উৎস (গভীর-অগভীর নলকূপ ও বিভিন্ন পদ্ধতির উৎস) রয়েছে। এসবের মধ্যে এক লাখ দুই হাজার ৮৫৪টি উৎস অচল হয়ে আছে বিভিন্ন কারণে। এ ছাড়া এক লাখ ৫৭ হাজার ৭৪৪টি উৎস দূষণযুক্ত (আর্সেনিকসহ অন্যান্য কারণে)। বাকি উৎসগুলো নিরাপদ বলে ধরা হয়েছে ওই হিসাবে।

 

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2017/03/21/476972