২১ মার্চ ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:৩০

মোবাইল ব্যাংকিংয়ে হ-য-ব-র-ল

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা নির্দেশনা, দফায় দফায় প্রজ্ঞাপন, ব্যাংক সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতা ও এজেন্টদের স্বেচ্ছাচারিতায় হ-য-ব-র-ল অবস্থা তৈরি হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং সেক্টরে। অন্যদিকে বারবার টাকা পাঠানোর খরচ কমানোর কথা বললেও এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। সংশ্লিষ্টরা জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা নির্দেশনা মাঠ পর্যায়ে কার্যকর করা হচ্ছে না। ফলে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে লেনদেন পরিচালিত হচ্ছে। এজন্য মূলত দায়ী যত্রতত্রভাবে এজেন্ট নিয়োগ, ভুয়া নিবন্ধিত সিম ব্যবহার, পর্যাপ্ত মনিটরিং না থাকা। এসব অনিয়ম ও ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছে গ্রাহককেই। থামছে না প্রতারণা ও অবৈধভাবে রেমিট্যান্স আসা। হুন্ডি ব্যবসায়ীরা বিদেশে বসে ফোন কল করে গ্রাহককে শর্ট কোড নাম্বার দিয়ে টাকা লেনদেন করছে। জবাবদিহি, অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ ও হয়রানি থেকে বিরত থাকতেই অবৈধভাবে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশ থেকে অর্থ আসছে। এর ফলে রাষ্ট্র রেমিট্যান্স থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে ১১ই জানুয়ারি মোবাইল ব্যাংকিং নিয়ে নতুন নির্দেশনা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ধরনের নির্দেশনাকে বিতর্কিত ও গ্রাহকবান্ধব নয় বলে মন্তব্য করেন সংশ্লিষ্টরা। যুক্তি হিসেবে তারা জানান, ব্যাংকের ওই সিদ্ধান্তে নজরদারির মধ্যে পড়ছেন ৪ কোটি মোবাইল ব্যাংকিং গ্রাহক। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় নাখোশ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও। এরপরই বিরূপ প্রভাব পড়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের। গ্রাহক, বিভিন্ন স্তরের ব্যবসায়ী ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়। এদিকে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার কড়া সমালোচনা করা হয়েছে। সংগঠনটি জানিয়েছে, গ্রাহকদের ওপর নজরদারি আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে তা যথাযথ হয়নি বলে আমরা মনে করি। কারণ, একজন গ্রাহক ইচ্ছা করলেই টাকা হুন্ডি বা পাচার করতে পারে না। তার জন্য এজেন্টের সহযোগিতা প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত গ্রাহকের ওপর নির্দেশনা প্রদান না করে মোবাইল ব্যাংকিং করে যে সকল প্রতিষ্ঠান ও এজেন্ট, তাদের ওপর নজরদারি বৃদ্ধি করা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সমালোচনার মধ্যে গত ৬ই মার্চ মোবাইল ব্যাংকিং সেবার চার্জ কমানোর উদ্যোগের কথা জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা বলেন, মোবাইল ব্যাংকিংয়ে উচ্চ চার্জ নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। চার্জ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে আলোচনা হয়েছে। কিভাবে এটা কমানো যায়, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তিনি বলেন, এখন দেশের ১৭টি ব্যাংক মোবাইলে ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। এর মধ্যে বিকাশ ছাড়া বাকি ১৬টি পোর্টফোলিও বিনিয়োগ। সম্প্রতি এসব সেবা নিয়ে বেশ কিছু অনিয়মের খবর বেরিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে পরিদর্শন কার্যক্রম শুরু করেছে। এখন পর্যন্ত ১০০০ এজেন্টের কার্যক্রম, হিসাব পরিদর্শন করা হয়েছে। মুখপাত্র বলেন, মোবাইল ব্যাংকিং একটি সীমিত ব্যাংকিং সেবা। তবে এখন ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) বেড়ে গেছে। এর মাধ্যমে অনিয়ম বেড়েছে। গ্রাহকরা জানিয়েছেন, সবচেয়ে বেশি হযবরল অবস্থা তৈরি হয়েছে সার্ভিস চার্জ নিয়ে। এখানে কারও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইড লাইনে কোথাও সার্ভিস চার্জ নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি। গাইড লাইনে ৭-এর ৪ নাম্বারে বলা আছে, সার্ভিস চার্জ নির্ধারণ করবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংক। বর্তমানে সার্ভিস চার্জ সকল ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানের একই অর্থাৎ ১.৮৫ ভাগ যা ১০০ টাকায় ১ দশমিক ৮৫ টাকা বা ১০ হাজার টাকায় ১৮৫ টাকা। আবার রিটেইলাররা এর থেকেও অতিরিক্ত ২ ভাগ আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২.৫০ ভাগ বেশি নিচ্ছে। যে হারে সার্ভিস চার্জ আদায়ের নামে অর্থ লুটপাট করা হচ্ছে তা ভবিষ্যতে জাতিকে ভোগাবে ও প্রান্তিক অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেবে। তিনি জানান, সার্ভিস চার্জ ভাগাভাগির বিষয়ে দেখা যায়, এজেন্ট ও ডিলার পায় ০.৭৬ ভাগ, অপারেটর (টঝঝউ) পায় ০.০৭ ভাগ, সরকারি রাজস্ব পায় ০.৪২ ভাগ এবং ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠান পায় ০.৬০ ভাগ। অর্থাৎ মোট ১.৮৫ ভাগ। সংশ্লিষ্টরা বলেন, এ ব্যবসা পরিচালনার জন্য প্রথমে ডিলার নিয়োগ করতে হয়, দ্বিতীয়ত এজেন্ট নিয়োগ করতে হয়, তৃতীয়ত অপারেটরের চ্যানেল ব্যবহার করে। এ চ্যানেল ব্যয় বেশি নেই বললেই চলে। তারপরও যদি এর ব্যয় সর্বোচ্চ দশমিক ২৫ পয়সা ধরা হয়। কিন্তু তারা নিচ্ছে দশমিক ৭০ পয়সা। এজেন্ট ও ডিলাররা বিনিয়োগ করলেও গ্রাহকদের কাছ থেকে সঙ্গে সঙ্গে এ অর্থ আদায় করে থাকেন। এমনিতেই এর সার্ভিস চার্জ বেশি। তারপরও তারা গ্রাহকদের জিম্মি করে অনৈতিকভাবে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছে। মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, এই কার্যক্রমে যে অনিয়ম হয় তার প্রমাণ গত ১৪-১২-২০১১ তারিখে গাইডেন্স অন মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস ফর দি ব্যাংক জারি করার ৭ দিনের মধ্যে আবারও ২০-১২-২০১১ তারিখে ৯টি নির্দেশনা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইড লাইনে বলা আছে লেনদেন হবে গ্রাহক থেকে গ্রাহক। বাস্তবে লেনদেন হচ্ছে প্রায় ৯০ ভাগই এজেন্ট থেকে এজেন্ট। কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে যত্রতত্র এজেন্ট নিয়োগ করা হয়েছে। বর্তমানে প্রায় ৬ লাখ ৭৫ হাজার এজেন্ট রয়েছে। এই বিপুল সংখ্যক এজেন্টদের নজরদারি করার কোনো সংস্থা তৈরি হয়নি। যার ফলে গ্রাহকরা একদিকে যেমন এজেন্টদের মাধ্যমে প্রতারিত হচ্ছেন, তেমনি অর্থ পাচার ও হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ লেনদেন হচ্ছে। তিনি বলেন, মোবাইল নেটওয়ার্ক আমাদের দেশের অভ্যন্তরে দুর্বল হলেও দেশের সীমানার ওপারেও নেটওয়ার্ক সচল থাকার ফলে দুর্বৃত্তরা ওপারে অবাধে মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সুবিধাবঞ্চিতদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির দুয়ার খুলে দিতে ২০১০ সালে মোবাইল ব্যাংকিং চালুর অনুমতি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকগুলো বিভিন্ন মোবাইল ফোন অপারেটরের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে এ সেবা দিচ্ছে। ডাচ্-বাংলা ব্যাংক প্রথম এ সেবা চালু করলেও এখন সবচেয়ে এগিয়ে আছে ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান বিকাশ। মোট লেনদেনের ৫৫ দশমিক ১১ শতাংশ হয় বিকাশের মাধ্যমে। আর ডাচ-বাংলার ৩৮ দশমিক ২৬ শতাংশ এবং অন্যান্য ব্যাংকের সর্বমোট ৬ দশমিক ৬৩ শতাংশ মার্কেট শেয়ার রয়েছে। বর্তমানে দেশে ১৯টি ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং সেবা দেয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন রয়েছে। তবে এর মধ্যে ১৭টি ব্যাংক এ সেবা চালু করেছে।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=58237&cat=3/