২১ মার্চ ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:২৩

বেসিক ব্যাংকের অর্থ লোপাট

বাচ্চুকে নিয়ে দুদকও অন্ধকারে

চার্জশিটভুক্ত আসামি বা গ্রেফতার করা নিয়ে সিদ্ধান্ত ঝুলে আছে

বেসিক ব্যাংকের অর্থ কেলেংকারির হোতা সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা তা এখনও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষ থেকে নিশ্চিত করতে পারেনি। এ নিয়ে তৈরি হয়েছে রহস্যময়তা। দুদক বাচ্চুকে এখন পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদও করেনি। বেসিক ব্যাংকের অর্থ লোপাটের ঘটনায় দুদক ৫৬টি মামলা করলেও তার কোনোটিতে বাচ্চুর নাম নেই। তদন্তকালে গত দেড় বছরে কোনো একটি মামলার সূত্রেও বাচ্চুকে জিজ্ঞাসাবাদ করার উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বেসিক ব্যাংকের দুর্নীতির বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ড. মো. আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, দুটি অডিট ফার্মের নিরীক্ষা প্রতিবেদনসহ সার্বিক বিবেচনায় বেসিক ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান, পরিচালকরা এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ দায় এড়াতে পারে না। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও রোববার বলেছেন, ‘শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে দুদক ব্যবস্থা নেবে। অপেক্ষা করুন, বেসিক ব্যাংকের বিরুদ্ধে যে রিপোর্ট হয়েছে তা এখন দুদকে আছে। তারা তাদের আইনি ব্যবস্থা নেবে।’


অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক সচিব আবু মো. মোস্তফা কামাল সোমবার যুগান্তরকে বলেন, ওনার (মন্ত্রী) বক্তব্য নিয়ে আমার কোনো মতামত নেই। বেসিক ব্যাংকের মামলার তদন্ত ও আবদুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে কিনা- এমন প্রশ্নে সচিব বলেন, বেসিক ব্যাংকের বেশ কিছু মামলা তদন্তাধীন আছে। তদন্ত যৌক্তিক পরিণতির দিকে এগোচ্ছে। খুব দ্রুতই মামলাগুলোর চার্জশিট হবে। চার্জশিটে আবদুল হাই বাচ্চুকে আসামি করা হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নে দুদক সচিব বলেন, এখনই এ বিষয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না। তদন্ত শেষ হলেই বলা যাবে আসামি হবেন কিনা। তদন্তাধীন মামলার বিষয়ে এর চেয়ে বেশি কিছু বলা সম্ভব নয় বলে জানান তিনি।

দুদকের বিধি অনুযায়ী, কাউকে কোনো দুর্নীতি মামলায় আসামি করতে হলে, তার আগে ওই ব্যক্তির বক্তব্য নিতে হয়। দুদক তা অনুসরণও করে থাকে। বাচ্চুকে আসামি করার চিন্তা থাকলে বা তদন্তে যদি তিনি নির্দোষও প্রমাণিত হন, তা নিশ্চিত করার জন্য হলেও তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার কথা ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত তা করা হয়নি। ফলে যা কিছু তদন্ত হয়েছে, তার আলোকে আবদুল হাই বাচ্চু দুর্নীতির মামলায় চার্জশিটভুক্ত আসামি হচ্ছেন এমন কথা জোর দিয়ে কেউই বলতে পারছেন না। এমনকি দুদক থেকেও তা নিশ্চিত করে বলা হচ্ছে না।

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগও বলছে, বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ ও রিপোর্ট দুদককে দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিও বলেছে, পৃথক দুটি অডিট ফার্মের নিরীক্ষা প্রতিবেদনসহ সার্বিক বিবেচনায় শেখ আবদুল হাই বাচ্চু দায় এড়াতে পারেন না। তার দুর্র্নীতির সব ধরনের তথ্য দুদকের হাতে রয়েছে। আবদুল হাই বাচ্চুর বিষয়ে নতুন করে কোনো রিপোর্ট দুদকে পাঠানো হয়েছে কিনা এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন এ মজিদ যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংকের ইতিপূর্বের অনিয়মের তথ্য বিভিন্ন সময় দুদককে দেয়া হয়েছে। তা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকেও দেয়া হয়েছে। দু’ভাবেই তথ্য গেছে দুদকে। দুদকের প্রয়োজনে যেসব তথ্য চেয়েছে তা সরবরাহ করা হয়েছে। তবে নতুন করে কোনো তথ্য বা প্রতিবেদন দেয়া হয়নি।

উল্লেখ করা যেতে পারে- বাংলাদেশ ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই ও অনুসন্ধান শেষে বেসিক ব্যাংকের দুর্নীতির ঘটনায় ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ৫৬টি মামলা করে দুদক। মামলাগুলোর তদন্তকাজ করছেন দুদকের ৮ কর্মকর্তা। তবে কোনো মামলার এজাহারেই বাচ্চুর নাম নেই। মামলা করার আগে অনুসন্ধান পর্যায়ে বাচ্চুকে জিজ্ঞাসাবাদ করেনি দুদক। মামলা দায়েরের পর কাউকে যদি চার্জশিটভুক্ত আসামি করতে হয়, তবে দুদক বিধি অনুযায়ী ওই ব্যক্তির বক্তব্য নিতে হয়। কিন্তু বেসিক ব্যাংকের মামলার ক্ষেত্রে তদন্তকালে বাচ্চুকে ৫৬ মামলার কোনোটিতেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। ফলে জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়া তাকে আসামি করা হবে এমনটি হওয়ার সুযোগ নেই। যেসব কর্মকর্তা মামলার তদন্ত করছেন তাদের কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করে এমনই তথ্য পাওয়া গেছে।

দুদক সূত্র জানায়, বেশ কয়েকটি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কমিশনে তাদের অগ্রবর্তী তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। দু’জন কর্মকর্তা ১৬টি মামলায় সাক্ষ্য-স্মারকসহ (এমই) অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। তবে তাদের প্রতিবেদনে বাচ্চুর নাম আসেনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন তদন্ত কর্মকর্তা জানান, তার মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে (এমই) বাচ্চুর বিষয়ে কোনো সুপারিশ আসেনি। তিনি জানান, প্রতিবেদন দাখিলের পর তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কিছু পর্যবেক্ষণসহ সম্পূর্ণ তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। কী ধরনের পর্যবেক্ষণ চাওয়া হয়েছে জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, যেসব কোম্পানি বা ব্যক্তি বেসিক ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিল ওই ঋণের সর্বশেষ অবস্থা কী, ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ পরিশোধ করেছে কিনা এবং ব্যাংকের যেসব কর্মকর্র্তার নামে চার্জশিটের সুপারিশ করেছিলাম, তার বাইরে আর কারও সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা আমাকে তা খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে। আবদুল হাই বাচ্চুকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করার সম্ভাবনা আছে কিনা এমন প্রশ্নে ওই কর্মকর্তা বলেন, নথিপত্র দেখে সিদ্ধান্ত নেব। তবে এখন পর্যন্ত তাকে ডাকা হয়নি।

বেসিক ব্যাংক মামলার অপর একজন কর্মকর্তা জানান, তার হাতে অনেক মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। সব ক’টি মামলার অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। তবে কোনো মামলার প্রতিবেদনেই বাচ্চুর নাম নেই। তিনি বলেন, ‘নিয়ম রক্ষার জন্য আমি অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করেছি। পুরো তদন্ত শেষ হলে মূল প্রতিবেদনগুলো দাখিল করা হবে।’

এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ১৫তম বৈঠকে শেখ আবদুুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ার বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। ওই বৈঠকের কার্যবিবরণী ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে পাঠানো হয় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে। কার্যবিবরণী সূত্রে জানা যায়, বেসিক ব্যাংকের দুর্র্নীতির বিষয়ে কমিটির সভাপতি ড. মো. আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, বেসিক ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি- দু’বার মতামত চাওয়া হলেও দুদকের কোনো মত পাওয়া যায়নি। সোমবার এ বিষয়ে জানতে চাইলে ড. মো. আবদুর রাজ্জাক যুগান্তরকে বলেন, বেসিক ব্যাংকের দুর্নীতির সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির সাবেক চেয়ারম্যানের জড়িত থাকার যথেষ্ট প্রমাণ আমাদের হাতে আছে। কিন্তু কেন তার ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না, এ বিষয়টি দুদকের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে। তবে তারা এখনও কোনো মতামত দেয়নি।

অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য টিপু মুন্সি তার বক্তব্যে বলেন, ‘বেসিক ব্যাংকের অনিয়মের বিষয়ে তৎকালীন চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে গৃহীত পদক্ষেপ জনগণের সামনে দৃশ্যমান হচ্ছে না। বরং তিনি এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক বিভাগ প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, বেসিক ব্যাংকের অনিয়ম সংক্রান্ত সব ধরনের রিপোর্ট দুদককে দেয়া হয়েছে। এই তথ্যের ভিত্তিতে ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেষ আবদুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে মামলা করে গ্রেফতার করা যেতে পারে। কিন্তু কেন দুদক ব্যবস্থা নিচ্ছে না এর কারণ জানা নেই।

বেসিক ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ তদন্তেও সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুসহ ১৩ কর্মকর্তার চাঞ্চল্যকর ঋণ কেলেংকারির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কথা উঠে আসে। প্রতিবেদনে বলা হয়, অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত সাবেক চেয়ারম্যান ও টপ ম্যানেজমেন্টকে বিচারের আওতায় আনতে দুদকের চাহিদা অনুযায়ী ঋণ জালিয়াতি ও অনিয়মের নথি সরবরাহ করা হয়েছে।

এছাড়া বেসিক ব্যাংকের অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে অডিট ফার্ম মেসার্স এস. এফ. আহমেদ অ্যান্ড কো: এবং মেসার্স ম্যাবস অ্যান্ড জে পার্টনারস রিপোর্ট দাখিল করে। ওই দুটি প্রতিষ্ঠানের অডিট রিপোর্টে অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যানের সম্পৃক্ততার কথা তুলে ধরা হয়েছে।

উল্লেখ্য, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে বেসিক ব্যাংকের তিনটি শাখায় প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ে। এর মধ্যে গুলশান শাখায় ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা, শান্তিনগর শাখার ৩৮৭ কোটি টাকা, মেইন শাখা প্রায় ২৪৮ কোটি টাকা ও দিলকুশা শাখায় ১৩০ কোটি টাকা অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ শনাক্ত করা হয়। পাশাপাশি বেসিক ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ তদন্তে আরও এক হাজার কোটি টাকার জালিয়াতির ঘটনা বেরিয়ে আসে। সব মিলে এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ে।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/03/21/110764/