শুকিয়ে গেছে পাবনার বেড়ার সুতিখালী নদী :নয়া দিগন্ত
২১ মার্চ ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:১৭

উত্তরাঞ্চলের বেশির ভাগ বিল নদী শুকিয়ে গেছে

হারিয়ে যাচ্ছে দেশী প্রজাতির মাছ ; কৃষিকাজ হয়ে পড়েছে নলকূপ নির্ভর

 পানির অভাবে উত্তরাঞ্চলের নদ-নদী, খাল-বিল জলাশয় শুকিয়ে যাচ্ছে। বছরের পর বছর পলি পড়ে ভরাট হয়ে সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে বিল, নদী ও জলাশয়ের আয়তন। ফলে শুষ্ক মওসুমে এ অঞ্চলের বেশির ভাগ নদী বিল শুকিয়ে আবাদি জমিতে রূপান্তরিত হয়। এতে প্রায় দুই লাখ হেক্টর বোরোর জমিতে সেচ সঙ্কট দেখা দেয়। এ দিকে বিল, নদী ও জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ায় উত্তরাঞ্চলের শিল্প, ব্যবসায়-বাণিজ্য, জীববৈচিত্র্য ও কৃষি খাত হুমকির মুখে পড়েছে। বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে জলজগুল্মলতা ও দেশী প্রজাতির মাছ।
জানা যায়, ষাটের দশক থেকে দেশে হাইব্রিড জাতের ধান আবাদ শুরু হয়। সেই সময় থেকে সেচের জন্য শ্যালো মেশিন ব্যবহার হয়ে আসছে। তখন নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয় থেকে শ্যালো মেশিনের সাহায্যে ফসলি জমিতে সেচ দেয়া হতো। ১৯৭৩ সালের পর থেকে ভারত অভিন্ন নদ-নদীতে নানা অবকাঠামো নির্মাণ করে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। ফলে শুষ্ক মওসুমে পানির অভাবে উত্তরাঞ্চলের সহস্রাধিক বিল, দুই শতাধিক নদী, শাখা নদী ও উপনদী শুকিয়ে যাওয়ায় নদী বিল জলাশয়নির্ভর সেচব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে দেশের বৃহত্তম তিস্তা সেচ প্রকল্প। সেচ কার্যক্রম সম্পূর্ণ ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভশীল হয়ে পড়েছে। এতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। সেই সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে আর্সেনিকের মাত্রা।
পাবনা পানি উন্নয়ন, মৎস্য ও কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, উত্তরাঞ্চলের এক সময়ের খরস্রোতা তিস্তা, পদ্মা, বড়াল, মহানন্দা, নন্দকুজা, ভদ্রাবতী, সরস্বতী, ইছামতি, গুমানী, আত্রাই, গুড়নদী, করতোয়া, ফুলঝোর, তুলসী, চেঁচুয়া, ভাদাই, চিকনাই, বানগঙ্গা, ঝরঝরিয়া, কাকন, কানেশ্বরী, মুক্তাহার, কাকেশ্বরী, সুতিখালি, গোহালা, গাড়াদহ, স্বতী, ভেটেশ্বর, ধরলা, দুধকুমার, সানিয়াজান, তিস্তা, ঘাঘট, ছোট যমুনা, নীলকুমার, বাঙ্গালী, বড়াই, মানস, কুমলাই, সোনাভরা, হলহলিয়া, জিঞ্জিরাম, বুড়িতিস্তা, যমুনেশ্বরী, মহানন্দা, টাঙ্গান, কুমারী, রতœাই, পুনর্ভবা, ত্রিমোহনী, তালমা, ঢেপা, কুরুম, কুলফি, বালাম, ভেরসা, ঘোড়ামারা, মালদহ, চারালকাঁটা, পিছলাসহ দুই শতাধিক নদী, শাখা নদী ও উপনদী নব্যতা হারিয়ে মরা নদী ও ফসলি জমিতে রূপান্তরিত হয়েছে।
এ ছাড়া পাবনা, নাটোর, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ ও রাজশাহী জেলার ঘুঘুদহ বিল, গাজনার বিল, শিকর বিল, কাজলকুড়ার বিল, ধলকুড়া বিল, ইটাকাটা বিল, গণ্ডার বিল, পাইকাশার বিল, বেহুলার বিল, হাড়গিলার বিল, দীঘলাছড়ার বিল, বোছাগাড়ীর বিল, ইউসুফ খার বিল, নাওখোয়া বিল, ঢুবাছড়ি বিল, কুশ্বার বিল, মেরমেরিয়ার বিল, মাইলডাঙ্গা বিল, মাটিয়ালেরছড়া বিল, চাছিয়ার বিল, হবিছড়ি বিল, পেদিখাওয়া বিল, কয়রার বিল, ধলার বিল, ধরইল বিল, বড়বিলা, বালোয়া বিল, আমদাকুরী বিল, উলিপুর-মাগুড়া খাল, দোবিলা খাল, বেহুলার খাড়ি, কাঁকড়ার বিল, দিক্ষিবিল, মালিখার বিল, বিলচাতরা, দীঘলাছড়ার বিল, বোছাগাড়ীর বিল, রাজশাহীর বিল কুমারী, জামিরতলা বিল, কসবা বিল, বগুড়ার গোবরচাপড়া বিল, ধামাচাপা বিল, সাতবিলা ও কাঁকড়ার বিলসহ সহস্র্রাধিক বিল শুকিয়ে জেগে উঠেছে সমতল ভূমি। এক সময় এসব বিলে সারা বছরই পানি থাকত। আর এখন বছরের ৯ মাসই পানি থাকে না। নদী বিলের শুকিয়ে যাওয়া দিগন্ত বিস্তৃত জমিতে ধান, পাট, সরিষা, রসুন, পেঁয়াজ, তরমুজ, বাঙ্গি, মরিচ, গাজর, সিম, ফুলকপি, পাতাকপি, আলু, পটোল, লাউসহ নানা ধরনের ফসল আবাদ হচ্ছে।
কুড়িগ্রামের ১৮২টি বিলের মধ্যে দীঘলাছড়ার বিল, বোছাগাড়ীর বিল, ইউসুফ খাঁর বিল, নাওখোয়া বিল, চুবাছড়ির বিল, কুশ্বার বিল, মেরমেরিয়ার বিল, চাছিয়ার বিল, হবিছরি বিল, পেদিখাওয়া বিল, কয়রার বিলসহ বেশির ভাগ বিলে ফসলের আবাদ হচ্ছে। অন্য বিলগুলোতে বছরের আট মাসের বেশি সময় পানি থাকে না। দিনাজপুর, পঞ্চগড়, নীলফামারী, লালমনিরহাট জেলার বিলগুলোর একই অবস্থা। চলনবিলে এক হাজার ৮৮ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে বেঁচে আছে ৩৬৮ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে মাত্র ৮৬ বর্গকিলোমিটার এলাকায় সারা বছর পানি থাকে। পানি সরে গেলে বিলগুলো ফসলি জমিতে রূপান্তরিত হয়।
নদী-বিলের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় দেড় লাখ হেক্টর বোরোর জমিতে সেচ ব্যাহত হচ্ছে। কৃষিকাজ হয়ে পড়েছে গভীর-অগভীর নলকূপনির্ভর। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। খনন ও সংস্কারের অভাব, অপরিকল্পিত রক্ষণাবেক্ষণ, বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ ও বিল রক্ষায় পর্যাপ্ত উদ্যোগ না নেয়ায় উত্তরাঞ্চল থেকে নদী ও বিলের অস্তিত্ব এক এক করে মুছে যাচ্ছে। শুষ্ক মওসুমে নদী বিল শুকিয়ে জেগে উঠেছে দিগন্ত বিস্তীর্ণ মাঠ। কৃষকেরা মাঠে ধান, পাট, সরিষা, রসুন, পেঁয়াজসহ নানা ধরনের ফসল আবাদ করছেন।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সমতার এক জরিপ প্রতিবেদনে জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলে বিলের সংখ্যা এক হাজার ৫৬১টি। এর মধ্যে সহস্রাধিক বিলের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। পলি জমে বিলের মুখ ভরাট হয়ে যাওয়া এবং পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় বছরের বেশির ভাগ সময় এসব বিল শুকনা থাকে। বছরের পর বছর বিলগুলোতে পলি জমছে। গভীরতা হ্রাস পাচ্ছে। পরিণত হচ্ছে নিচু সমতল ভূমিতে। দীর্ঘদিন খনন না করায় বিলের পানির নির্দিষ্ট ধারাটিও হারিয়ে যাচ্ছে।
উত্তরাঞ্চলে বন্যার সময় আসা পলি জমছে বিলে। বন্যার পানি নেমে গেলে থেকে যাচ্ছে পলি। একপর্যায়ে গোটা বিল এলাকাই পরিণত হচ্ছে ধু ধু প্রান্তরে। দেশে বেশ কিছু বিল মাছ চাষের জন্য ইজারা দেয়া হয়েছে। ইজারাদাররা যেখানে সেখানে বাঁধ নির্মাণ করে মাছ চাষ করছে। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বিলের পানি প্রবাহ। এতে একপর্যায়ে বিলের মূল ধারাই শুকিয়ে যাচ্ছে। নদীগুলোর সাথে বিলের সংযোগস্থলে দেয়া হচ্ছে কৃত্রিম বাঁধ। একে তো জমে থাকা পলি, এর ওপর বাঁধ নির্মাণ করায় নদী-বিলের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। সরকারিভাবে বিল রক্ষণাবেক্ষণে কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে নদী থেকে বিচ্ছিন্ন বিলগুলো ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। বেশির ভাগ বিলেই এখন সারা বছর চাষাবাদ হয় নানা রকম ফসল।
মৎস্য বিভাগের তথ্যানুযায়ী দেশের উত্তরাঞ্চলে বিলের সংখ্যা এক হাজার ৫৬১টি। খনন ও সংস্কারের অভাবে সহস্রাধিক বিল হারিয়ে গেছে। অবশিষ্ট বিলগুলোর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। নদী বিলের পানি শুকিয়ে যওয়ায় প্রায় দেড় লাখ হেক্টর জমির সেচকাজ ব্যাহত হচ্ছে। কৃষিকাজ হয়ে পড়ছে গভীর-অগভীর নলকূপনির্ভর। ফলে এ অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে।
মৎস্য বিশেজ্ঞরা জানিয়েছেন, উত্তরাঞ্চলের নদী, বিল, জলাশয় ও প্লাবন ভূমি ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি ধারণক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। এ অঞ্চলের নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর, জলাশয় ও প্লাবন ভূমি খননের মাধ্যমে পানি ধারণক্ষমতা বাড়ানো হলে ফসল উৎপাদনের পাশাপাশি মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।
আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা ২০০০ সালে ৫৪ প্রজাতির মাছ বিপন্ন ঘোষণা করেছে। আইইউসিএন বিপন্ন প্রজাতির মাছগুলোকে সঙ্কটাপন্ন, বিপন্ন, চরম বিপন্ন ও বিলুপ্ত এ চার ভাগে ভাগ করেছে। সঙ্কটাপন্ন মাছের মধ্যে আছে ফলি, বামোশ, টাটকিনি, তিতপুঁটি, আইড়, গুলশা, কাজুলি, গাং মাগুর, কুচিয়া, নামাচান্দা, মেনি, চ্যাং ও তারাবাইম। বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে চিতল, টিলা, খোকশা, অ্যালং, কাশ খাইরা, কালাবাটা, ভাঙন, বাটা, কালিবাউশ, গনিয়া, ঢেলা, পাবদা, ভোল, দাড়কিনি, রানি, পুতুল, গুইজ্যা আইড়, টেংরা, কানিপাবদা, মধুপাবদা, শিলং, চেকা, একঠোঁট্রা, কুমিরের খিল, বিশতারা, নেফতানি, নাপিত কৈ, গজাল ও শাল বাইন। অন্য দিকে চরম বিপন্ন প্রজাতির মাছের তালিকায় রয়েছে ভাঙন, বাটা, নান্দিনা, ঘোড়া মুইখ্যা, সরপুঁটি, মহাশোল, রিটা, ঘাইড়া, বাছা, পাঙ্গাস, বাঘাইড়, চেনুয়া ও টিলাশোল মাছের নাম।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. মো: রেদওয়ানুর রহমানের প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, ২৬ বছর আগেও চলনবিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ১৬টি নদী, ৩৯টি বিল ও ২২টি খাড়িতে বছরজুড়েই ৬ থেকে ১২ ফুট পানির গভীরতা থাকত। ফলে সারা বছরই নৌচলাচল করত। কিন্তু বছরের পর বছর পলি জমে এসব নদী, বিল ও খাড়ি ভরাট হয়ে গেছে। ওই নিবন্ধে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণ, ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে এবং ১৯৮০-এর দশকে পানি উন্নয়ন বোর্ড বড়ালের (পদ্মা) উৎসমুখে স্লুইসগেট নির্মাণের ফলে চলনবিলের বিভিন্ন নদী বিল জলাশয় ও খাড়িগুলোয় পলি জমে ক্রমে ভরাট হয়ে গেছে। তা ছাড়া বিলের মধ্য দিয়ে যথেচ্ছভাবে সড়ক, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ, ভূমি দখল করে বসতি ও দোকানপাট স্থাপন করায় নদী, বিল ও খাড়িগুলো সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/205436