২১ মার্চ ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:১২

বাজেট বাড়ে, কমে না মশা তীব্র উৎপাত রাজধানীজুড়ে

রাজধানী ঢাকায় বসবাসকারীদের জীবনযাত্রায় নানাবিধ যন্ত্রণা নিত্যনৈমিত্তিক । দেনদরবার করে একটার সামাল দেয়া গেলেও আরেকটার বেসামাল অবস্থা । এমন দুর্ভোগের মধ্যেই দিনযাপনের এই মহানগরীতে দিন দিন বেড়েই চলছে মশার উৎপাত। বাসাবাড়ি, অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল সর্বত্রই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মশা। রাতে তো বটেই দিনের বেলায়ও চলছে মশার এমন অত্যাচার। মশারি টানিয়ে, কয়েল জ্বালিয়ে, ইলেকট্রিক ব্যাট কিংবা মশানাশক ওষুধ স্প্রে করেও রক্ষা মিলছে না ।


অথচ মশা নিধনে বছর বছর বরাদ্দ বাড়াচ্ছে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি ও ডিএনসিসি)। অভিযোগে প্রকাশ, বরাদ্দ বাড়লেও মশার যন্ত্রণা থেকে রেহাই মিলছে না নগরবাসীর। তাদের মতে , বরাদ্দ বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মশার উপদ্রব।
জানা গেছে , রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার পুকুর-ডোবা, নালা-নর্দমার কচুরিপানা ও ময়লা পরিষ্কার না করায় সেগুলো মশা উৎপাদনের খামার হিসেবে বিরাজ করছে। মশা নিধনের দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। তবে অভিযোগ রয়েছে, ওষুধ স্প্রে করার জন্য প্রতি ওয়ার্ডে ৬ জন করে কর্মী থাকলেও কয়েকমাসেও তাদের কোন খোঁজ পাওয়া যায় না।


খোঁজ নিয়ে দেখা যায় , তেজগাঁও, মহাখালী, ফকিরাপুল, কমলাপুর, মানিকনগর, বাসাবো, মুগদা, খিলগাঁও, ধোলাইখাল, মীর হাজীরবাগ, যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর, কামরাঙ্গীরচর, সূত্রাপুর, মোহাম্মদপুর, সায়েদাবাদ, রামপুরা, বাড্ডা, কুড়িল, মিরপুর, গাবতলী, দারুস সালাম, হাজারীবাগ, গোড়ান এলাকায় মশার উপদ্রব সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়াও নগরীর অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরা, ধানমন্ডিতেও বেড়েছে মশার উপদ্রব। অভিজাত এলাকাগুলোর বেশিরভাগ ফ্ল্যাট বাড়িতে জানালা-দরজায় নেট লাগানো সত্ত্বেও যেন রেহাই নেই মশার অত্যাচার থেকে। নিচতলা থেকে শুরু করে ২০ তলা পর্যন্ত সর্বত্রই মশার সমান উপদ্রব।
ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি কর্পোরেশন প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দ রাখা হয় মশা নিধনের জন্য। বরাদ্দকৃত টাকা খরচও করে দুই সিটি কর্পোরেশন। কিন্তুু নগরীতে মশার ওষুধ ছিটাতে দেখা যায় না তেমন একটা।


অভিযোগ রয়েছে, মশার ওষুধ ছিটানো হয় স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সিটি কর্পোরেশন কর্মকর্তাদের পছন্দের এলাকায়। কোথাও কোথাও ছয় মাসেও একবার দেখা যায় না আবার কোথাও মাসে দুই থেকে তিনবারও ওষুধ ছিটানো হয়।


ডিএসসিসির প্রধান স্বা¯্য’ কর্মকর্তা ডা. শেখ সালাহউদ্দিন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘মশক নিধন কর্মীরা নিয়মিত কাজ করছে। কোথায় কোথায় ওষুধ ছিটাতে হবে সেটা দেখভাল করেন স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলররা। তারাই ভালো জানেন কোন এলাকায় বেশি সমস্যা আর যদি কোন এলাকায় ওষুধ ছিটানো না হয় তাহলে কাউন্সিলরদের জানালে তারা ব্যবস্থা নেবেন।’
নগরীর প্রতিটি ঘরে মশার যন্ত্রণা বেড়েছে। বিভিন্ন নিম্ন মানের কয়েল, মশারি, মশা মারার বৈদ্যুতিক ব্যাটও মশার হাত থেকে রেহাই দিতে পারছে না রাজধানীবাসীকে। যথাসময়ে জলাশয়, আবর্জনা পরিষ্কার-পরিছন্ন না করাও মশক নিধন কার্যক্রম শুরু না করার কারণেই মশার বিস্তার ঘটেছে। মশার যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়েছে সবাই আর এরই সাথে বাড়ছে ডেঙ্গু ,ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়াসহ নানাবিধ মশাবাহী রোগ জিবানু।


ঢাকা সিটি কর্পোরেশন (ডিসিসি) উত্তর ও দক্ষিণের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, মশক নিধন কার্যক্রম চলছে। তবে তা দৃশ্যত নেই বলেই জানান ভুক্তভোগীরা।


কামাল নামে হাজারীবাগের এক বাসিন্দা বলেন, শীতের মওসুমের শুরু থেকে নগরীতে মশার দাপট বেড়ে গেছে। দিন-রাত সব সময়ে মশা থাকে । রাতে মশার কয়েল ও ওষুধ স্প্রে করেও টেকা যায় না। রাতে মশারি টানিয়ে ঘুমালেও দিনে বিশ্রাম নিতে লাগাতে হয় মশারি। মশার উপদ্রব বাড়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, নিয়মমাফিক ওষুধ ছিটানো না হওয়া এবং অনেক এলাকায় ঝিল, নালা-নর্দমা ও অন্যান্য জলাশয় পরিষ্কার না করায় এসব মশার প্রজনন ক্ষমতা বেড়ে গেছে। এছাড়া মশার ওষুধ ছিটাতে তিন মাসেও কোন কর্মীকে দেখা যায় নি।


ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. শেখ সালাহউদ্দিন বলেন, শীতের সময়ে মশার উপদ্রব একটু বেশি হয়। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, তখন বৃষ্টি হয় না। বৃষ্টি হলে মশার প্রজনন স্থানগুলো নষ্ট হয়ে যায়। ভাসমান পানিতে মশা জন্মাতে পারে না। আবদ্ধ পানি কিংবা শুকনা স্থানে মশার প্রজনন বেড়ে যায়।
ওই কর্মকর্তার দেয়া যুক্তির প্রেক্ষিতে দেখা যায় , এখন বৃষ্টি হচ্ছে । মওসুম না হলেও আগাম বৃষ্টির কারণে যদি মশার প্রজননস্থানগুলো নষ্ট হয়ে যায় , তাহলে এখন মশার উপদ্রব কেন এমন প্রশ্ন ভূক্তভোগীদের ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৮ নং ওয়ার্ড ছাড়া প্রথম ১৩টিতে ৩১২ একর জলাধার রয়েছে। এগুলো কচুরিপানা ও আবর্জনায় ভর্তি। একই চিত্র ১৪, ২২, ২৩, ২৪, ২৫, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ওয়ার্ডের ৩২ একর জলাধারের। এছাড়াও ৭, ৩৯, ৪০, ৪১, ৪৪, ৪৫, ৪৬, ৪৭, ৪৮, ৪৯, ৫০, ৫১, ৫২, ৫৩ ও ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডের ১৪৪ বিঘা ৯ কাঠা জলাশয় দীর্ঘদিন ধরে পরিষ্কার করা হয় না।


খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ডিএসসিসির মশক নিধন বিভাগে স্প্রে রয়েছে ১৮৩ জন, ক্রু ম্যান রয়েছে ১৫১, সুপারভাইজার রয়েছে ১০ জন। ফগার মেশিন রয়েছে ৩৮৭টি, হস্তচালিত মেশিন রয়েছে ৪৩৮টি, হুইল ব্যারো মেশিন রয়েছে ৩৬টি, ইউএলভি মেশিন রয়েছে ২টি, পাওয়ার স্পেয়ার রয়েছে ৫টি এবং ন্যাপসেক পাওয়ার রয়েছে ১টি। এর মধ্যে ৭১টি ফগার মেশিন, ৫৯টি হস্তচালিত মেশিন, ৮টি হুইল ব্যারো, ২টি ইউএলভি, ৫টি পাওয়ার স্পেয়ার ও ১টি ন্যাপসেক পাওয়ার মেশিন নষ্ট।
অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের পাঁচটি অঞ্চলে জলাধার রয়েছে ১ হাজার ৮৭৫ বিঘা। এর মধ্যে অন্যতম এলাকা হচ্ছে বছিলা, গাবতলী, মিরপুর, কুড়িল, গুলশান ও উত্তরা। এছাড়াও অন্যান্য এলাকায় বেশ কিছু জলাধার রয়েছে। আর ডিএনসিসির ৩০৯ জন মশক নিধন কর্মী রয়েছে। এর মধ্যে স্প্রে রয়েছে ১২০ জন এবং ক্রু ম্যান রয়েছে ১৮৯ জন। সুপারভাইজার রয়েছে ৮ জন। এছাড়াও ফগার মেশিন রয়েছে ২১৭টি, হস্তচালিত মেশিন রয়েছে ২৮৭টি এবং হুইল ব্যারো মেশিন রয়েছে ১টি।
কথা বলতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এসএমএম সালেহ ভূইয়াকে ফোনে বার বার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।


জানা গেছে, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকায় জলাশয় রয়েছে প্রায় এক হাজার বিঘা। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণে রয়েছে ৪৮৭ বিঘা। এসব জলাশয়ে কচুরিপনা ও আবর্জনা জমে আছে। এগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না। ফলে শীত মওসুম এলে জলাশয়ের আবদ্ধ পানি দুর্গন্ধময় হয়ে মশার প্রধান প্রজনন স্থলে পরিণত হয়।


চলতি অর্থবছরে ২০১৬-১৭ মশক নিধন কার্যক্রমের মনিটরিং ও সার্ভিলেন্সসহ বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ডিএনসিসির ২৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা। গত অর্থবছরে ২০১৫-১৬ এখাতে বাজেট ধরা হয়েছিল ১৪ কোটি টাকা। সে বছর ব্যয় হয় ১১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।


অন্যদিকে চলতি অর্থবছরে মশক নিধন কার্যক্রমের জন্য ডিএসসিসির বাজেট বরাদ্দ ধরা হয়েছে ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। গত বছর ১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ রেখে ব্যয় করেছে ৯ কোটি ৯০ লাখ টাকা।
নগরবাসী জানান, বিগত বছরগুলোর তুলনায় চলতি বছর প্রায় দ্বিগুণ হারে বেড়েছে মশা। দিনের বেলায় উপদ্রব কিছুটা কম থাকলেও রাতের বেলায় অসহনীয় হয়ে উঠে। বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল থেকে শুরু করে চলন্ত গাড়িতেও মশার কামড় বাড়ছে।


সিটি কর্পোরেশনের মশা নিধনের দায়িত্বে থাকা স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, নগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রতিদিন মশার ওষুধ ছিটানোর জন্য ৫ থেকে ৬ জন করে কর্মী নিযুক্ত আছেন। তারা দিনে দুবার ওষুধ ছিটানোর কাজ করেন। তবে সিটি কর্পোরেশন এমন দাবি করলেও নগরবাসী তাদের দেখতে পান কালেভদ্রে।

http://www.dailysangram.com/post/276491-