২০ মার্চ ২০১৭, সোমবার, ৮:১৪

বছর পার, খুনিই শনাক্ত হয়নি

বিচার দাবিতে তোলপাড় হয়েছে দেশজুড়ে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পালিত হয়েছে ধর্মঘট, হাতে হাত রেখে মানববন্ধন করেছে সর্বস্তরের মানুষ। তারপর গড়িয়েছে বছর। অথচ এখনো রহস্যই উন্মোচন হয়নি, থমকে আছে তদন্ত। এ অবস্থায় সোহাগী জাহান তনু হত্যাকাণ্ডের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ সোমবার।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, সন্দেহভাজন কয়েক ব্যক্তিকে ঘিরে তদন্ত চলছে। তবে এখনো খুনি শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। ২৫ জনের ডিএনএ নমুনা যাচাই করা হয়েছে, অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে রহস্য ভেদ করতে পারেননি তদন্তকারীরা। এখনো বেশ কিছু আলামতের ফরেনসিক পরীক্ষা বাকি আছে। এর মধ্যে একজন সন্দেহভাজন পুরুষের এক জোড়া জুতা, কলম, দুটি মোবাইল ফোনের কভার, তনুর জুতাও রয়েছে।
তবে তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, মাঝে তদন্তে কিছুটা ধীরগতি ছিল। তবে এখন আবার তদন্ত গতি পেয়েছে।
এক বছরেও খুনি শনাক্ত না হওয়ায় চরম ক্ষুব্ধ, হতাশ তনুর পরিবার ও কুমিল্লার গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা। ভয় ও উৎকণ্ঠার মধ্যে একটি বছর কাটিয়ে দেওয়া তনুর স্বজনরা তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী পালন করতে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের গ্রামের বাড়িতে গেছেন। স্বজনরা জানান, আজ সেখানে তনুর জন্য দোয়া ও মিলাদের আয়োজন করা হয়েছে। কুমিল্লার গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠকরা বলছেন, বিচারের দাবিতে আজ এসপির কার্যালয়ে স্মারকলিপি দেবেন তাঁরা।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মী তনু গত বছরের ২০ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাসের অলিপুরের ১২ ইঞ্জিনিয়ার্স ব্যাটালিয়নের কোয়ার্টারে সার্জেন্ট জাহিদুজ্জামানের মেয়েকে প্রাইভেট পড়াতে যান। রাতে অলিপুরে পাওয়ার হাউসের জঙ্গলে তাঁর লাশ পাওয়া যায়। তাঁর বাবা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহকারী ইয়ার হোসেন এ ঘটনায় ২১ মার্চ কোতোয়ালি মডেল থানায় হত্যা মামলা করেন। ওই দিন তনুর মরদেহের প্রথম ময়নাতদন্ত করে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ। ৪ এপ্রিল সেই প্রতিবেদন দেওয়া হয়। শুরু থেকেই ধর্ষণের সন্দেহ করা হলেও ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, মৃত্যুর কারণ অজ্ঞাত, ধর্ষণের আলামতও মেলেনি। এ নিয়ে তখন দেশজুড়ে বিতর্ক ওঠে। তবে প্রথম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের আগেই আদালতের নির্দেশে ওই বছরের ৩০ মার্চ লাশ উত্তোলন করে তনুর দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত করা হয়। একই সঙ্গে আদালতের নির্দেশে তনুর পরনের কাপড়সহ সাতটি আলামত ডিএনএ পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। তবে দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্তেও তনুর মৃত্যুর কারণ স্পষ্ট করতে পারেননি চিকিৎসকরা। তাঁরা বলেন, মৃত্যুর আগে তনুর ‘সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স’ হয়েছিল বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু তা ধর্ষণ কি না—সে প্রশ্নের সরাসরি কোনো জবাব দেননি তাঁরা। সাংবাদিকরা বিস্তারিত ব্যাখ্যা চাইলে তাঁরা বলেন, আপনারাই বুঝে নেন। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে তাঁরা তদন্ত সংস্থাকে অধিকতর তদন্তের পরামর্শ দেন।
তনুর পরিবার ঘটনার পর থেকেই অভিযোগ করেছে, সেনানিবাসে অনুষ্ঠানে গান না করায় শারীরিক নির্যাতনের পর তনুকে হত্যা করে লাশ জঙ্গলে এনে ফেলে রাখা হয়েছিল।
গত বছরের ২৫ মার্চ মামলা স্থানান্তর করা হয় গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে। ২৮ মার্চ মামলাটি স্থানান্তর হয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি)। মামলার তদন্ত তদারকি কর্মকর্তা, সিআইডির অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (অ্যাডিশনাল ডিআইজি) আবদুল কাহহার আকন্দের কাছে গতকাল রবিবার বিকেলে মোবাইল ফোনে অগ্রগতির ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি আজ ফোনে কোনো কথা বলব না। কাল (সোমবার) অফিসে আসেন কথা বলব। ’
তবে সম্প্রতি কাহহার আকন্দ বলেছেন, ‘তনু হত্যা মামলার তদন্তে কিছু অগ্রগতি আছে। পেশাদারি ও আন্তরিকতার সঙ্গে তদন্ত চলছে। ’
এ পর্যন্ত মামলার একাধিক তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তিত হয়েছেন। গত ১১ জুলাই তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার নাজমুল করিমকে রাজশাহী বদলি করা হয়। তাঁর স্থলে প্রথমে আসেন শাহরিয়ার হোসেন। তাঁর বদলির পর সেখানে যোগ দেন ব্যারিস্টার মোশাররফ হোসেন। এরই মধ্যে সিআইডির পরিদর্শক গাজী মোহাম্মদ ইব্রাহিম ‘অসুস্থতার’ কথা জানিয়ে এ মামলার তদন্ত থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন। সর্বশেষ দায়িত্ব পান সিআইডির এএসপি জালাল আহমেদ।
এএসপি জালাল আহমেদ বলেন, ‘আমরা তদন্ত করে যাচ্ছি। মাঝে নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে জিজ্ঞাসাবাদ কার্যক্রম বন্ধ ছিল। কারণ ওই সময় সেনানিবাসের অনুষ্ঠান ছিল। তবে ফেব্রুয়ারি থেকে আবার জিজ্ঞাসাবাদসহ অন্যান্য কাজ শুরু হয়েছে। আগের ডিএনএ প্রোফাইল, আলামত পরীক্ষা, জিজ্ঞাসাবাদসহ অন্য সূত্রগুলো নিয়ে কাজ চলছে। এখনো কিছু আলামত পরীক্ষা বাকি আছে। ঘটনাস্থলের কাছে দুই জায়গা থেকে উদ্ধার করা তনুর জুতা, সন্দেহভাজন পুরুষের দুটি জুতা, দুটি মোবাইল ফোনের কাভার, কলমসহ কিছু আলামতের ফরেনসিক টেস্ট করানো হবে। ’ কতজন সন্দেহভাজনকে জিজ্ঞাসাবাদ ও কতজনের ডিএনএ প্রোফাইলিং হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নানাজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এটা নির্দিষ্ট করে বলা ঠিক হবে না। ’
গত বছরের ১৬ মে রাতে তনু হত্যা মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার নাজমুল করিম খান গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ‘তনুর ডিএনএ পরীক্ষায় ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে। তনুর পরনে থাকা পোশাক পরীক্ষা করে পৃথক তিন ব্যক্তির ডিএনএ নমুনা পাওয়া যায়। সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের সঙ্গে ডিএনএ পরীক্ষা করে এসব নমুনা মিলিয়ে দেখা হবে। ’
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তনু হত্যা মামলার তদন্ত সিআইডির কাছে যাওয়ার পর থেকে সামরিক-বেসামরিক অন্তত ৫০ ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এর মধ্যে তনুর পরিবারের সদস্য, বন্ধু, ডাক্তার, নার্স ও পাঁচজন শিল্পীও রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অন্তত ২৫ জনের ডিএনএ প্রোফাইল সংগ্রহ করে তনুর কাপড়ে পাওয়া প্রোফাইলের সঙ্গে মেলানো হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকজন সন্দেহভাজন ব্যক্তিও রয়েছে, যাদের গতিবিধির ওপর নজরদারির চেষ্টা করেন তদন্তকারীরা। তবে এই মামলার হত্যার সূত্র চিহ্নিত করে এবং সন্দেহভাজনদের ঘিরে তদন্ত করতে অনেক সময় চলে যায়। কারণ সংরক্ষিত এলাকা হওয়ার বেশ কিছু নিয়মের মধ্যে এগোতে হয় তদন্তকারীদের। এর ফলে খুনিরা সন্দেহভাজনদের আড়ালে নিজেদের লুকিয়ে রাখতে পেরেছে বলে ধারণা করছে তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র।
হতাশা, উৎকণ্ঠায় পরিবার : তনু হত্যার পর থেকেই নানা ধরনের চাপ ও হয়রানির অভিযোগ করছে তাঁর স্বজনরা। এক বছরেও খুনি শনাক্ত না হওয়ায় হতাশার সঙ্গে উৎকণ্ঠায়ও ভুগছে তারা। গতকাল তনুর বাবা ইয়ার হোসেনের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তনুর ভাই নাজমুল হাসান ধরেন। তিনি বলেন, ‘এখন কী তদন্ত হচ্ছে আমরা জানি না। আমাদের কোনো অগ্রগতির খবর দিতে পারেনি কেউ। ’
তনুর মা আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘কী হবে—এই চিন্তায় ওর (তনুর) বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমরা সেখানে (কুমিল্লার সেনানিবাস) মৃত্যুবার্ষিকীও পালন করতে সাহস পাইনি। তাই এখানে (টাঙ্গাইলে) চলে আসছি। ’
স্বজনরা জানায়, আজ সোমবার তনুর জন্য দোয়া-মিলাদ পড়ানো হবে। দুটি মাদরাসার এতিম ছাত্রদের খাইয়ে তনুর জন্য প্রার্থনা করা হবে।
খুনি শনাক্ত না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে কুমিল্লার গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরাও। মঞ্চের সংগঠক খায়রুল আনাম রায়হান বলেন, ‘বিচার তো দূরে থাক, এক বছরে খুনিই শনাক্ত হয়নি। আমরা চাই খুনি যত ক্ষমতাধরই হোক না কেন, তাকে আইনের আওতায় আনা হোক। ’ বিচার দাবিতে আজ কুমিল্লার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে গণজাগরণ মঞ্চ স্মারকলিপি দেবে বলে জানান তিনি।
আইএসপিআরের বক্তব্য : তনু হত্যার ঘটনায় সিআইডি প্রায় ৭০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তাদের মধ্যে ৪০ জনেরও বেশি সেনা সদস্য। এ ঘটনায় সিআইডিসহ কয়েকটি সংস্থা ৫৫ থেকে ৬০ বার কুমিল্লা সেনানিবাসে তদন্তে এসেছে। তাদের তদন্ত কার্যক্রমে সেনাবাহিনী সব ধরনের সহায়তা দিয়েছে। কোথাও কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়নি। মানবাধিবার কমিশন এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্র থেকেও প্রতিনিধিদল এ বিষয়ে খোঁজখবর নিতে কুমিল্লা সেনানিবাসে এসেছে। তাদেরও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে।
তনু হত্যা তদন্তের বিষয়ে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে কি না তা জানতে চাইলে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পরিচালক লে. কর্নেল মোহাম্মদ রাশিদুল হাসান কালের কণ্ঠকে এ তথ্য জানান।
আরেক প্রশ্নে লে. কর্নেল মোহাম্মদ রাশিদুল হাসান বলেন, ‘অপরাধী শনাক্ত করতে সেনাবাহিনীর সার্জেন্ট জাহিদসহ ২৫ জনের ডিএনএ টেস্ট করা হয়েছে বলে আমরা জেনেছি। তনুর পোশাক থেকে ধর্ষণের আলামতসহ তিন ব্যক্তির ডিএনএ নমুনা পাওয়া যায়। সে নমুনার সঙ্গে সন্দেহভাজন ২৫ জনের ডিএনএ প্রফাইল মেলানোর উদ্যোগ নেয় সিআইডি। যত দূর জানা গেছে, এদের কারো ডিএনএ প্রফাইলের সঙ্গে তনুর শরীরে পাওয়া তিন ব্যক্তির ডিএনএ মেলেনি। ’
তনুর বাবার আগের বাসা ছেড়ে দেওয়া সম্পর্কে এ সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘তিনি (তনুর বাবা) নিজেই ওই বাসা ছেড়ে দেওয়ার জন্য আবেদন করেন। আগের বাসার আশপাশের সব বাসার লোক চলে যাওয়ার কারণে হয়তো তনুর মা-বাবা ওই বাসায় থাকতে স্বস্তি বোধ করছিলেন না। এই অবস্থায় তাঁদের সেনানিবাসের ভেতরেই ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের একটি বাসা দেওয়া হয়। তাঁরা সেখানেই বসবাস করছেন। তনুর পরিবার ১৫ বছর ধরে সেনানিবাসের ভেতরে বসবাস করছে। তনু আমাদেরই সন্তান। দেশবাসীর মতো সেনাবাহিনীও তনু হত্যার সুষ্ঠু বিচার চায়। ’

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2017/03/20/476640