১৯ মার্চ ২০১৭, রবিবার, ৮:৪৬

দখলে-দূষণে কর্ণফুলীর মরণদশা

প্রধানমন্ত্রীর ক্ষোভ-অসন্তোষের পর সপ্তাহ পার : কর্তৃপক্ষ নির্বিকার

দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দরের ধারক কর্ণফুলী নদী। আর চট্টগ্রাম বন্দর জাতীয় অর্থনীতির হৃদপিন্ড। শুধু বন্দরেরই নয়; বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রাণভোমরা কর্ণফুলী। সেই খরস্রোতা পাহাড়ি নদী কর্ণফুলী এখন আর ‘সুস্থ’ নয়। গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থনৈতিক নদী কর্ণফুলীর চলছে মরণদশা। বেপরোয়া দখল-বেদখল, দূষণ ও ভরাটে বিপন্ন হয়ে উঠেছে কর্ণফুলী নদী। একই সাথে চট্টগ্রাম বন্দরও। বন্দরের প্রাণপ্রবাহ জাহাজ চলাচলের মূল নেভিগেশন চ্যানেলের ক্যাপিটাল ড্রেজিং ও মেইনটেনেন্স ড্রেজিং না হওয়ায় ক্রমাগত ভরাট হয়ে নাব্যতা হারাচ্ছে কর্ণফুলী। বিরান হয়ে যাচ্ছে নদীটির সুস্বাদু ও অর্থকরী মাছ। জীববৈচিত্র্য আজ ধ্বংসের মুখে। কর্ণফুলী মোহনায় গড়ে উঠেছে শত শত অবৈধ স্থাপনা। পাঁচ শতাধিক শিল্প,কল-কারখানা, অসংখ্য জাহাজ নৌযানের বিষাক্ত বর্জ্যরে সাথে ৬০ লাখ নগরবাসীর পয়ঃবর্জ্যে মারাত্মক বিষিয়ে উঠেছে এ নদী। এখনও জোরালো সামাজিক আন্দোলন না হলেও কর্ণফুলী রক্ষায় মাঝে-মধ্যে চট্টগ্রামের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন সভা-সমাবেশ, সাম্পান নৌকার র্যালির মাধ্যমে দাবি দাওয়া তুলে ধরছে।


গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থনৈতিক নদী কর্ণফুলীর সামগ্রিক এই দুর্দশার পরিপ্রেক্ষিতে গত ১২ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বন্দরনগরী চট্টগ্রাম সফরকালে বোট ক্লাবে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এ বিষয়ে তীব্র ক্ষোভ-অসন্তোষ প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে কর্ণফুলীর ড্রেজিং ও সুরক্ষায় বিভিন্ন সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু ইতোমধ্যে এক সপ্তাহ অতিবাহিত হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কার্যত নির্বিকার রয়েছে। চট্টগ্রামে ওই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘আমি চাই না কর্ণফুলীর অবস্থা ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর মত মৃত হয়ে যাক। কারণ, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই নদীটা। কাজেই আমাদের কর্ণফুলীর নাব্যতা যেন ঠিক থাকে সেজন্য ড্রেজিং করতে হবে। যেহেতু এখানে পোর্ট আছে। সাথে সাথে কর্ণফুলী নদীকে দূষণমুক্ত রাখতে হবে। যদিও পানিসম্পদ মন্ত্রী দিয়েছি চট্টগ্রামের। সেখানেও আমি দেখি খুব বেশি আশা জাগাতে পারেননি। সেটাও দুর্ভাগ্য।’ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, উক্ত অনুষ্ঠানে পানিসম্পদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদও উপস্থিত ছিলেন।


প্রধানমন্ত্রী কর্ণফুলীর চরম দুর্দশার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, ‘শহরের বর্জ্য কর্ণফুলী নদীতে যাবে সেটা গ্রহণযোগ্য না। এখানে ওয়াসার জায়গা আছে। আমি বলবো ওয়াসার জায়গায় একটা সেন্ট্রাল স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট করার জন্য। এখানে স্থানীয় সরকার মন্ত্রীও আছেন। আমি বলবো অনতিবিলম্বে এ কাজ করতে। একটা সেন্ট্রাল স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট যদি করা হয় তাহলে এখানকার বর্জ্যগুলো সেখানে গিয়ে সেখান থেকে ট্রিটমেন্ট হয়ে নদীতে যাবে। দূষিত পানি নদীতে যাবে না। কর্ণফুলীর কোন কোন এলাকায় দূষিত পানি আসে তা চিহ্নিত করতে হবে। যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেল্ট আছে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেল্ট থেকে দূষণ হয় কিনা, সেখান থেকে দূষিত পানি কর্ণফুলীতে যায় কিনা সেগুলোর বিষয়ে এখন থেকেই খোঁজ নিতে হবে। ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট করে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। এখন থেকে যদি ব্যবস্থা না নেয়া হয় তাহলে এই নদীর ভাগ্য কি হবে তা বলা যায় না।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি আশা করি সেন্ট্রাল স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট করার দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে। ডিপিপি গ্রহণ করুন এবং পাঠান। একনেকে তো আমি দেখভাল করি। কাজেই সেটার অনুমোদন হয় কিনা সেটা আমি দেখবো। কিন্তু অনুমোদন হবে, কাজ হবে না, বা কাজে দেরি হবে সেটা কিন্তু সহ্য করবো না। আমি দ্রুত কাজ চাই। আমাদের নদীগুলো রক্ষা করতে হবে। নদীগুলো রক্ষার জন্য আমরা বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছি।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা এখানে আছি জনগণের সেবা করতে। কাকে কাজ দিব, কে কাজ পাবে, কে পেল না, কাজ নিয়ে ভাগ-ভাটোয়ারা, দুর্নীতি এসব আমার সময়ে চলবে না। কারণ, আমি নিজে এখানে ব্যবসা করতে আসিনি। কমিশন খেতে আসিনি। দুর্নীতি করতে আসিনি। জনগণের সেবা করতে এসেছি। দেশের উন্নয়ন করতে এসেছি। দেশের উন্নয়নটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড়। কাজেই সেখানে কেউ যদি অপকর্ম করতে চায় সে যেই হোক না কেন তাকে আমি ছাড়বো না।’


ভাগাড়ে পরিণত কর্ণফুলী
সাড়ে ৫শ’ ছোট-বড় শিল্প-কারখানা, প্ল্যান্ট, দেশি-বিদেশি জাহাজ কোস্টার নৌযান ট্রলারের বিষাক্ত বর্জ্য-ময়লা-জঞ্জাল ও আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে কর্ণফুলী নদী। সেই সাথে নৌ-চলাচলের মূল (নেভিগেশনাল) চ্যানেল, বহির্নোঙ্গরসহ বন্দর এলাকা। ক্রমেই বিষিয়ে উঠেছে পানি। নদীর পানির স্বাভাবিক রঙ, গন্ধ ও স্বাদ আর নেই। প্রায় ৬০ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত চট্টগ্রাম নগরীর বিশাল অংশের নগর-বর্জ্যরে ঠিকানা কর্ণফুলী। বিলুপ্ত হচ্ছে এ নদীর হাজারো জীববৈচিত্র্য। এককালে হরেক প্রজাতির চিংড়িসহ সুস্বাদু মাছের খনি কর্ণফুলী নদী এখন প্রায় বলতে গেলে মাছশূন্য হয়ে পড়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র মতে, কর্ণফুলী নদীতে মিঠা পানির ৬৬ প্রজাতির, মিশ্র পানির ৫৯ প্রজাতির এবং সামুদ্রিক পরিযায়ী ১৫ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেতো। দূষণের কারণে ইতোমধ্যে মিঠাপানির প্রায় ২৫ প্রজাতির এবং মিশ্রপানির ১০ প্রজাতির মাছ এখন বিলুপ্তপ্রায়। এছাড়া আরও ১০ থেকে ২০ প্রজাতির অর্থকরী মাছ বিপন্ন।


অবৈধ দখলবাজি
কর্ণফুলীর মোহনায় প্রায় ১৫৮ একর ভূমি বেদখল হয়ে গেছে। গড়ে উঠেছে শত শত অবৈধ স্থাপনা। কর্ণফুলীর উভয় তীরের অবৈধ দখল হওয়া জমি উদ্ধার করে অচিরেই সরকারের আয়ত্তে আনার দৃঢ় প্রত্যয়ের কথা মন্ত্রী-এমপি-কর্তাব্যক্তিরা বার বার ব্যক্ত করলেও তার কোন বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না। দীর্ঘদিন থমকে আছে ভূমি বেদখল মুক্ত করতে মোবাইল কোর্টের অভিযান। কর্ণফুলী নদীর উভয় পাড়কে কেন্দ্র করে চলছে ভরাট ও দখল-বেদখলের প্রতিযোগিতা। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন দু’বছর আগে কর্ণফুলী নদী তীরবর্তী ১৫৮ দশমিক ৪৫ একর ভূমিতে অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করে। অথচ জমি উদ্ধারের আলামত নেই। আবার সরকারি দলের বিভিন্ন অঙ্গ কিংবা সহযোগী সংগঠনের দাপট দেখিয়েও যথেচ্ছভাবে রাতারাতি সারি সারি বাড়ি-ঘর বানিয়ে কর্ণফুলীর তীরভূমি বেদখল করা হচ্ছে। এর পেছনে তৎপর একেকটি ভূমিদস্যু চক্র। কথিত সমিতির নামে প্লট বেচাকেনা চলছে। প্লটের ব্যবসায় অপরিকল্পিত বালি তোলার কারণে নদীর স্বাভাবিক গতিপথ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। চাক্তাই রাজাখালীর দু’পাশে, চর পাথরঘাটা, সিডিএ মাঠ, ওমরআলী ঘাট, মনোহরখালী এলাকার কাছেও কেউ কেউ নতুন চরের জমির দাবিদার সেজে, আবার কেউ নদীর বালি তুলে ডুবোচর ভরাট করে, বিভিন্ন অপকৌশলে কর্ণফুলী দখলে মেতে আছে।
নদী গবেষক অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া বলেছেন, দেশের অন্য কোন নদ-নদীর তুলনায় কর্ণফুলী নদীর রয়েছে আলাদা কিছু ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য। এগুলো সুরক্ষা জরুরী। কর্ণফুলী বাঁচলে বন্দর বাঁচবে। এ নদী মানুষকে সবই দিয়েছে উদারভাবে। কিন্তু নদীটি দিন দিন ভরা যৌবন হারিয়ে ফেলছে। বেপরোয়া দখল, দূষণ আর পলি-বালি ও জঞ্জালে ভরাট হয়ে বিপন্ন হয়ে উঠেছে কর্ণফুলীর বুক। কর্ণফুলী নিছক একটি নদীর নাম নয়। বরং দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের প্রাণস্পন্দন। কর্ণফুলী আর বঙ্গোপসাগরের মিলিত মোহনায় হাজার বছর আগে গড়ে উঠেছে দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম। আর তাকে ঘিরে বিশাল অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ

https://www.dailyinqilab.com/article/70199/