১৯ মার্চ ২০১৭, রবিবার, ৮:৪০

মূলধন ঘাটতিতে চলতে পারছে না ৫ ব্যাংক

রাষ্ট্র খাতের ব্যাংকগুলো চরমভাবে মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। সোনালী, বেসিক, কৃষিসহ পাঁচ ব্যাংকেরই মূলধন ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতির কারণে সরকার এর আগে ৮ হাজার কোটি টাকা নগদ দিয়েছে সাত ব্যাংককে। এ ব্যাংকগুলোই আবার নতুন কৌশলে ৪ হাজার ১০০ কোটি টাকা দাবি করছে। এবারের দাবি নগদ টাকা নয়, বন্ড।


আজ রোববার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এ নিয়ে বিশেষ বৈঠক করবেন। ‘রাষ্ট্রমালিকানাধীন পাঁচ বাণিজ্যিক ও দুই বিশেষায়িত ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণের বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত’ শীর্ষক বৈঠকের কার্যপত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। ব্যাংকগুলো হচ্ছে সোনালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি) এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব)।


মূলত বড় ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারি ও খেলাপি ঋণ আদায় করতে না পারার কারণেই ব্যাংকগুলোতে মূলধন ঘাটতি বেড়েছে। ২০১১ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যেই সোনালী, জনতা ও বেসিক ব্যাংক থেকে বেরিয়ে গেছে ১২ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে রূপালী, অগ্রণী ব্যাংকসহ বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর দুর্নীতির তথ্যও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন তদন্তে উঠে আসে। এরপরের তিন বছরে (২০১৪ থেকে ২০১৬) সরকার সোনালী, বেসিক, জনতাসহ সাত ব্যাংককে ৭ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা দিয়েছে। এগুলো দেওয়া হয়েছে কখনো মূলধন ঘাটতি পূরণ, কখনোবা মূলধন পুনর্গঠন বা মূলধন পুনর্ভরণের নামে। এরপরও নতুন করে বেসিক, জনতা ও রূপালী ব্যাংক আরও ৪ হাজার ১০০ কোটি টাকা চেয়েছে।


বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুর্নীতি, পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনাগত অদক্ষতার কারণেই ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বের হয়ে গেল। এরপর সরকারের তহবিল থেকে টাকাও দেওয়া হলো। আমার মনে হয়, ব্যাংকগুলোর অভ্যাস খারাপ করে দেওয়া হচ্ছে। তারা মনে করছে যে যা-ই করি না কেন, সরকার তো দিচ্ছেই।’


জানতে চাইলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. ইউনুসুর রহমান আজ রোববার বৈঠক হবে—এর বাইরে আর কিছু বলতে চাননি।


ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, মূলধন ঘাটতি পূরণের জন্য বেসিক, জনতা, রূপালী এবং গ্রামীণ ব্যাংক ৪ হাজার ১৪১ কোটি ২২ লাখ টাকার বন্ড ছাড়ার অনুমতি চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে। এর মধ্যে বেসিক ব্যাংকের একারই চাওয়া ২০ বছর মেয়াদি ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার ‘রি-ক্যাপিটালাইজেশন বন্ড’। আর সাত বছর মেয়াদি ‘সাব-অর্ডিনেটেড বন্ড’ চায় জনতা ও রূপালী ব্যাংক। এর মধ্যে জনতা ব্যাংকের চাওয়া ১ হাজার কোটি ও রূপালী ব্যাংক চায় ৫০০ কোটি টাকার বন্ড। অন্যদিকে মূলধনে সরকারি শেয়ার এক-চতুর্থাংশ বজায় রাখার জন্য গ্রামীণ ব্যাংক মাত্র ২২ লাখ টাকার বন্ড ছাড়তে চেয়েছে। বেসিক ও রূপালী ব্যাংক আবেদনে ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়ন এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যবসা করার জন্য অর্থ প্রয়োজনের কথা বলেছে। কেননা মূলধন ঘাটতি থাকায় তারা ব্যবসা করতে পারছে না।


কার্যপত্রে বন্ডের ব্যাপারে অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। বলেছে, ব্যাংকগুলোতে বর্তমানে আমানতের সুদ হার কমবেশি ৫ শতাংশ এবং বিভিন্ন ব্যাংকে হাজার হাজার কোটি টাকা অলস পড়ে রয়েছে। ব্যাংকগুলো যেখানে কম সুদের আমানত বিনিয়োগ করে মুনাফা অর্জনের মাধ্যমে মূলধন বাড়াতে পারছে না, সেখানে আমানতের সুদের প্রায় দ্বিগুণ অর্থাৎ ১০ শতাংশ সুদে বন্ড বিক্রির মাধ্যমে পাওয়া অর্থ বিনিয়োগ করে কীভাবে মুনাফা অর্জন করবে? মেয়াদ শেষে সুদাসলে অর্থ পরিশোধ ব্যাংকগুলোর পক্ষে কতটা সম্ভব হবে, তাও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে।


বিসমিল্লাহ গ্রুপের কেলেঙ্কারির পর জনতা ব্যাংককে ৮১৪ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাংকের এখন মূলধন ঘাটতি নেই। তারপরও ১ হাজার কোটি টাকার বন্ড চেয়েছে জনতা ব্যাংক। এ নিয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকটির এমডি আবদুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রভিশন বা খেলাপি ঋণ কোনো কারণে বেড়ে গেলে মূলধন উদ্বৃত্ত না-ও থাকতে পারে। তাই বন্ড ছাড়তে চাই।’
বেসিক ব্যাংকের বিতর্কিত চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর নেতৃত্বাধীন কয়েক বছর ধরে চলা দুর্নীতি ও লুটপাটের পর ব্যাংকটিকে সরকার দিয়েছে ২ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা।


এদিকে মূলধন ঘাটতি পূরণের চার সম্ভাব্য উপায় এবং এর সুবিধা-অসুবিধাগুলো কার্যপত্রে তুলে ধরেছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। উপায়গুলো অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক চিহ্নিত করেছে। এগুলো হচ্ছে সরাসরি নগদ মূলধন সরবরাহ, বন্ড ছাড়া, বোনাস শেয়ার ছাড়া এবং খেলাপি ঋণ কমানো।


বলা হয়েছে, সরাসরি মূলধন সরবরাহ একটি ভালো উপায় হলেও চলতি অর্থবছরের বাজেটে মূলধন পুনর্গঠন খাতে শুধু ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ আছে। আর বন্ড ছাড়লে আপাতত সরকারের কোনো আর্থিক দায় তৈরি হবে না। কিন্তু মেয়াদ শেষে সুদাসলে বন্ড ক্রেতাদের অর্থ পরিশোধ করতে না পারলে ওই দায় সরকারের ওপরই বর্তাবে।


সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত উপায় চিহ্নিত করা হয়েছে নিট মুনাফা অর্জন করে তা বণ্টনের পরিবর্তে বোনাস শেয়ার ছাড়াকে। তবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ মনে করে, দীর্ঘদিন রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলো মুনাফা অর্জনের ধারায় নেই, ফলে এ উপায় আপাতত বিবেচনা করার কোনো সুযোগ নেই। তবে ভালো উপায় হচ্ছে খেলাপি ঋণ কমিয়ে প্রভিশন ঘাটতি কমানো। কিন্তু ব্যাংকগুলোর এ ব্যাপারেও সাফল্য নেই।


মূলধন ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকগুলো বন্ড ছাড়তে পারে কি না—এ বিষয়ে জানতে চাইলে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকারের উচিত হবে ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণ আদায়ে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দেওয়া।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1112671/