১৯ মার্চ ২০১৭, রবিবার, ৮:৩৮

দুর্নীতি ও লুটপাটে হাওয়া রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মূলধন

১৫ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি * পূরণে কৌশল খুঁজতে আজ বৈঠক

দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়ার কারণে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা ঘাটতির মুখে পড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো। এ ঘাটতি পূরণে সরকারের কাছেও নগদ অর্থ নেই। বাজেট থেকে তা পূরণ করাও কঠিন। কেননা, চলতি বাজেটে এ খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ মাত্র ৪ হাজার কোটি টাকা। এরপরও বাজেট থেকে পূরণ করা হলে সরকারকে বড় চাপের মুখে পড়তে হবে।


জনগণের হাতিয়ে নেয়া অর্থের এ ঘাটতি পূরণ করতে আজ অর্থ মন্ত্রণালয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক ও সিইওদের নিয়ে বৈঠকে বসবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। মূলধন ঘাটতি নিয়ে অর্থমন্ত্রী নিজেও অসন্তুষ্ট। তাই বৈঠকে নগদ টাকার বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে নতুন শর্ত দেয়া হতে পারে।

সূত্রমতে, এ মুহূর্তে সোনালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ২ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা। অগ্রণী ব্যাংকের ২০০ কোটি, রূপালী ব্যাংকের ১ হাজার ৫৩ কোটি, বেসিক ব্যাংকের ২ হাজার ২৮৬ কোটি, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (বিডিবিএল) ৭৩৭ কোটি টাকা, কৃষি ব্যাংকের ৭ হাজার ৪৮৫ কোটি ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ৭০৫ কোটি টাকা ঘাটতি রয়েছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ড. ইব্রাহিম খালেদ শনিবার যুগান্তরকে বলেন, সমস্যা মূলধন ঘাটতি নয়। সমস্যা হচ্ছে দুর্নীতিবাজ ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইওদের সরকারি ব্যাংকে নিয়োজিত করা। এ ধরনের দুর্নীতিবাজ লোকদের ব্যাংক পরিচালনায় নিয়োগ না কমালে সমস্যা হতেই থাকবে। ফলে সেখানে আগে হাত দেয়া দরকার। না হলে মূলধন ঘাটতি পূরণ করলেও তা আবার খেয়ে ফেলবে। আর মূলধন ঘাটতির ব্যাপারে ব্যাংকগুলোকে বলা দরকার- সরকার নতুন করে অর্থ দেবে না। মুনাফা অর্জন করে তা পূরণ করার দায়িত্ব ব্যাংকগুলোকে দিতে হবে।

সূত্রমতে, লুটপাটের মাধ্যমে বেসিক ব্যাংকের মূলধন বস্তা ভর্তি করে ব্যাংক থেকে বের করে নেয়া হয়। ঋণের নামে এ টাকা বের করা হয়। একইভাবে হলমার্কের দুর্নীতির কারণে সোনালী ব্যাংক ঘাটতির মুখে পড়ে। অন্যান্য ব্যাংকের মূলধনও বের করা হয় ঋণের নামে। ফলে সব মিলে ব্যাংকগুলো বড় ধরনের মূলধন ঘাটতির মুখে পড়ে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি নিয়ে চাপের মুখে রয়েছে সরকার। কারণ বাজেটে এ খাতে বরাদ্দের চেয়ে ব্যাংকের ঘাটতির পরিমাণ অনেক বেশি। এজন্য ব্যাংকগুলোকে নগদ অর্থ না দিয়ে ভিন্ন কৌশলে ঘাটতি মেটানোর বিষয়টি আজকের বৈঠক থেকে বের করা হবে।

মূলধন ঘাটতি পূরণে ইতিমধ্যে বেসিক ব্যাংক ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বন্ড ইস্যুর প্রস্তাব দিয়েছে। রূপালী ব্যাংক দিয়েছে ৫০০ কোটি টাকার বন্ড ছাড়ার প্রস্তাব। তাদের বন্ড ইস্যুর যুক্তি হিসেবে বলা হয়, বড় অংকের মূলধন ঘাটতি থাকায় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাংকের ব্যবসা করার ক্ষেত্রে বড় রকমের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে।

সূত্রমতে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণে ভিন্ন ভিন্ন চার ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার কথা ভাবছে সরকার। পদক্ষেপগুলো হচ্ছে- ব্যাংকের শেয়ার ইস্যু, নিট মুনাফা বণ্টন না করে বোনাস শেয়ার ইস্যু, শ্রেণীকৃত ঋণ হ্রাসের মাধ্যমে ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি কমানো এবং বন্ড ইস্যু। অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে আজকের বৈঠকে এ পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা হবে। সরকারের দায় কম থাকবে এমন পদক্ষেপের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে মূলধন ঘাটতি মেটাতে বলা হতে পারে। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রীর কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বিশেষায়িত ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি নিয়ে প্রতিবেদন পাঠায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। সেখানে বলা হয়, বিডিবিএল ছাড়া অন্যসব ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ, মূলধন সংরক্ষণের হারসহ অন্যান্য সূচক বিবেচনা করলে আগামী দিনগুলোতে ঘাটতির পরিমাণ আরও বাড়বে বলে প্রতীয়মান হয়।

ওই প্রস্তাবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. ইউনুসুর রহমান বলেন, ব্যাংকগুলোতে হাজার হাজার কোটি টাকা অলস পড়ে আছে। তা কম সুদে বিনিয়োগ করে মুনাফা অর্জন করে মূলধন বাড়াতে ব্যাংকগুলো সক্ষম হচ্ছে না। সেখানে আমানতের চেয়ে দ্বিগুণ সুদে বন্ড বিক্রির মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ বিনিয়োগ করে মুনাফা কতটা অর্জন করতে পারবে তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।

চার ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে মূলধন ঘাটতি মেটানোর একটি পর্যবেক্ষণ তৈরি করেছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। সেখানে বলা হয়, ব্যাংকগুলোকে সরাসরি নগদ মূলধন সরবরাহ বা শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে এ ঘাটতি পূরণ করা যেতে পারে। এজন্য বাজেট থেকে নগদ অর্থ বরাদ্দ করতে হবে। তবে চলতি বাজেটে ব্যাংক মূলধন পুনর্গঠন খাতে বরাদ্দ হচ্ছে ৪ হাজার কোটি টাকা। এ অর্থ ব্যাংকগুলোর ১৫ হাজার কোটি টাকা ঘাটতির তুলনায় সামান্য।

দ্বিতীয় পদক্ষেপ পর্যালোচনা করে বলা হয়, ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকগুলো নিট মুনাফা অর্জনের পর তা বণ্টন না করে বোনাস শেয়ার ইস্যু করতে পারে। এ পদ্ধতি সবচেয়ে বেশি কাক্সিক্ষত। তবে দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো এ ধারায় নেই। ফলে এটি আপাতত বিবেচনার সুযোগ নেই।

তৃতীয় পদক্ষেপে উল্লেখ করা হয়, শ্রেণীকৃত ঋণ কমিয়ে প্রভিশন ঘাটতি কমাতে পারে। এটি একটি কাক্সিক্ষত পন্থা হলেও ব্যাংকগুলো সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। শেষ প্রস্তাবে ঘাটতি পূরণে বন্ড ইস্যু প্রসঙ্গে বলা হয়, এর মাধ্যমে ঘাটতি পূরণ করা হলে সরকারের ওপর নগদ দায় বর্তাবে না। তবে নির্ধারিত মেয়াদ শেষে ব্যাংকগুলো সুদ-আসলে বন্ড ক্রেতাদের অর্থ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে এর দায় সরকারের ওপর বর্তাবে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে ঘাটতি মূলধন পূরণ করার পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ঋণ দেয়া ও আদায়সহ বিভিন্ন আর্থিক সূচকের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে এর দায় শেষ পর্যন্ত সরকারের ওপর পড়বেই।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/03/19/110187/