৪ জুন ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৮:১৪

৫ মাসে বিশ্বে আক্রান্ত দাঁড়াল ৬৫ লাখ

প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাসে বিশ্বে শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা ৬৫ লাখ ছাড়িয়েছে। চীনের উহানে ভাইরাসটি শনাক্ত হওয়ার পাঁচ মাসের মাথায় এ বিপুলসংখ্যক মানুষ সংক্রমিত হলো। এরই মধ্যে প্রাণহানির সংখ্যা তিন লাখ ৮৩ হাজার পেরিয়েছে। ভেঙে পড়েছে বৈশ্বিক অর্থনীতির চাকা। জীবন-জীবিকা সংকটে লাখ লাখ মানুষ। বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষ এখন নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি।

পরিসংখ্যানভিত্তিক ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারের উপাত্ত বলছে, গত ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে করোনা শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৩২ লাখ ৬২ হাজারে। এর ৩৩ দিনের মাথায় আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হলো। এরই মধ্যে প্রাণ হারিয়েছে পৌনে চার লাখেরও বেশি রোগী। অবশ্য পাঁচ মাসে শনাক্ত হওয়া রোগীর প্রায় অর্ধেকই ইতিমধ্যে সেরে উঠেছে।

বিশেষজ্ঞদের ধারণা, গত ডিসেম্বরের শেষদিকে চীনের উহান শহরের একটি বন্য প্রাণীর বাজার থেকে মানবদেহে প্রবেশ করে নভেল করোনাভাইরাস। অবশ্য ভাইরাসটির উৎসস্থল নিয়ে এখন পর্যন্ত নিশ্চিত তথ্য জানাতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। দেশভেদে রোগটি মোকাবেলায় নানা ওষুধের প্রয়োগ হলেও এখনো পুরোপুরি কার্যকর কোনো ওষুধের সন্ধান মেলেনি। তবে এরই মধ্যে নতুন উদ্ভাবিত বেশ কিছু প্রতিষেধকের ট্রায়াল চলছে। চলতি বছর নাগাদ একটি কার্যকর প্রতিষেধক উদ্ভাবনে আশাবাদী অনেক গবেষকই।

প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাস এখন পর্যন্ত বিশ্বের ২১৩টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। গতকাল বাংলাদেশ সময় রাত ১১টা পর্যন্ত শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৫ লাখ। এ সময়ে মারা গেছে তিন লাখ ৮৩ হাজার মানুষ। আর সুস্থ হয়েছে প্রায় ৩১ লাখ করোনা রোগী। বিশ্বে বর্তমানে ৫৪ হাজার রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন, যা চিকিৎসাধীন ব্যক্তির ২ শতাংশ। ১০ দিন ধরেই সংকটাপন্ন রোগীর সংখ্যা স্থিতিশীল আছে।

এদিকে গত সোমবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) মহাপরিচালক টেড্রোস আধানম গ্রেব্রিয়েসিস বলেছেন, করোনা মহামারির শুরু থেকেই বিশ্বজুড়ে অসংক্রামক ব্যাধি (ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, হৃদেরাগ, শ্বাসতন্ত্রের রোগ প্রভৃতি) প্রতিরোধ ও চিকিৎসা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের দেশগুলোয় এই পরিস্থিতি সবচেয়ে জটিল আকার ধারণ করেছে।

গত মে মাসে ১৫৫টি দেশে পরিচালিত এক জরিপের ভিত্তিতে ডাব্লিউএইচও প্রধান বলেন, প্রায় ৫৩ শতাংশ দেশে উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসাসেবা আংশিক বা পুরোপুরি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ৪৯ শতাংশ দেশে ব্যাহত হচ্ছে ডায়াবেটিস ও সংশ্লিষ্ট জটিলতার চিকিৎসা। ৪২ শতাংশ দেশে ক্যান্সার এবং ৩১ শতাংশ দেশে হৃদেরাগজনিত জরুরি চিকিৎসাসেবা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আর পুনর্বাসন সেবা ব্যাহত হয়েছে দুই-তৃতীয়াংশ দেশে। টেড্রোস আধানম বলেন, যেসব ব্যক্তির অসংক্রামক ব্যাধি আছে, তারা করোনার সংক্রমণে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার এবং মারা যাওয়ার ঝুঁকিতে আছে। কিন্তু অসংক্রামক ব্যাধি রয়েছে—এমন অনেক ব্যক্তিই এখন আর তাদের প্রয়োজনীয় ওষুধ বা চিকিৎসা পাচ্ছে না।

ভারতে শনাক্ত দুই লাখ ছাড়াল

ভারতে প্রথমবারের মতো করোনাভাইরাস শনাক্ত হয় গত ৩০ জানুয়ারি। এর চার মাসের মাথায় প্রতিবেশী দেশটিতে শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা দুই লাখ ছাড়িয়ে গেছে। ভারতের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গতকাল জানিয়েছে, ২৪ ঘণ্টায় আরো আট হাজার ৯০৯ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হওয়া কভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দুই লাখ সাত হাজার ৬১৫ জনে। শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যায় বিশ্বে ভারত এখন সপ্তম স্থানে। শীর্ষে আছে যুক্তরাষ্ট্র, দ্বিতীয় স্থানে ব্রাজিল ও তৃতীয় স্থানে রাশিয়া। এরপর আছে যুক্তরাজ্য, স্পেন ও ইতালি।

তবে ভারতের বর্তমান পরিস্থিতিকে সংক্রমণের সর্বোচ্চ পর্যায় বা ‘পিক’ বলে মনে করছেন না ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চের ড. নিবেদিতা গুপ্তা। তাঁর কথায়, ‘আমরা পিক থেকে এখনো অনেক দূরে আছি।’

এর আগে ভারতের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলেছিলেন, জুনের শেষ দিকে অথবা জুলাইয়ে ভারতে সংক্রমণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে। অর্থাৎ দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা ওই সময়ই সবচেয়ে বেশি থাকবে, তারপর ধীরে ধীরে কমতে শুরু করবে। ভারতে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখে পৌঁছাতে লেগেছে ১১০ দিন। কিন্তু এক লাখ থেকে দুই লাখে পৌঁছতে লেগেছে মাত্র ১৫ দিন। কভিড-১৯-এ ভারতে এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে পাঁচ হাজার ৮১৫ জনের।

ব্রাজিলে মৃত্যু ৩০ হাজার পেরোল

মহামারি করোনাভাইরাসে ব্রাজিলে মৃতের সংখ্যা গত মঙ্গলবার ৩০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যেই লাতিন আমেরিকার দেশটিতে ভাইরাসটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়া অব্যাহত আছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় করোনায় এক হাজার ২৬২ জন প্রাণ হারিয়েছে। এতে করে করোনায় মোট প্রাণহানির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩১ হাজার ১৯৯ জনে। এ সময়ের মধ্যে নতুন করে আরো ২৮ হাজার ৯৩৬ জন ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়েছে। এ নিয়ে ব্রাজিলে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে মোট পাঁচ লাখ ৫৫ হাজার ৩৮৩ জনে দাঁড়িয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যার দিক থেকে ইতিমধ্যে বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে ব্রাজিল। আর মৃতের সংখ্যার দিক থেকে দেশটি ইতিমধ্যে বিশ্বে চতুর্থ সর্বোচ্চ অবস্থানে উঠে এসেছে। এদিক থেকে প্রথম স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর যথাক্রমে যুক্তরাজ্য ও ইতালি আছে। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্রাজিলে সরকারিভাবে ঘোষিত সংখ্যার চেয়ে দেশটিতে করোনাভাইরাসে প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেশি হতে পারে। কেননা দেশটিতে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম পরীক্ষা করা হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রে বিক্ষোভে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি

শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাতে এক কৃষাঙ্গের প্রাণ হারানোর ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রে হাজার হাজার লোক বিক্ষোভ করছে। চিৎকার করে তাদের দাবি জানাচ্ছে। টিয়ার গ্যাসের কারণে জোরে কাশি দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, বিক্ষোভের কারণে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাবে। এ ছাড়া আফ্রিকান আমেরিকানদের জনস্বাস্থ্য এমনিতেই অবহেলিত। এর মধ্যে পুলিশি সহিংসতা এসব জনগোষ্ঠীর জন্যে তৈরি করছে বাড়তি চাপ। এ কারণে তৈরি হচ্ছে হৃদেরাগ থেকে ক্যান্সার ঝুঁকি।

গত ২৫ মে মিনেপোলিসে শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাতে জর্জ ফ্লয়েড নামের নিরস্ত্র এক কৃষাঙ্গ প্রাণ হারালে তা নিয়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। হত্যাকাণ্ডের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বর্ণবাদবিরোধী বিক্ষোভ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে।

ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়া হসপিটালের চিকিৎসক এবোনি হিলটন বলেন, করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাবে বলেই আমরা আশঙ্কা করছি। কারণ কোনো সামাজিক দূরত্ব নেই এবং দুর্ভাগ্যবশত বেশির ভাগ লোক ভুলভাবে তাদের মাস্ক পরছে। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা নিয়মিতভাবেই পিপার স্প্রে, টিয়ার গ্যাস ও নার্ভ এজেন্ট ব্যবহার করছে। ফলে কাশি ও জ্বলুনি হচ্ছে। এ ছাড়া চোখে ড্রপলেট পড়ার কারণেও করোনা ছড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন এই চিকিৎসক।

সূত্র : ডাব্লিউএইচও, এএফপি, আনন্দবাজার।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2020/06/04/918973