১৮ মার্চ ২০১৭, শনিবার, ১০:৩৯

দখল দূষণে বুড়িগঙ্গার অস্তিত্ব হুমকির মুখে

পানিতে ৬২ প্রকার কেমিক্যাল, মিশছে পয়:বর্জ্য তলদেশে পলিথিন জমাট বেঁধেছে অন্তত: ১০ ফুট, আদালতের রায় বাস্তবায়নের তাগিদ বিশেষজ্ঞদের

দখল ও দূষণে ধুঁকছে বুড়িগঙ্গা। মারাত্মকসব কেমিক্যাল বর্জ্যে অনেক আগেই দূষিত হয়েছে বুড়িগঙ্গার পানি। বাতাসে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধময় বিষ। নদীর তলদেশে জমাট বেঁধেছে ৮ থেকে ১০ ফুট পুরু পলিথিনের স্তর। এছাড়া নদীটির পানিতে হাসপাতাল বর্জ্য থেকে নিঃসৃত অ্যান্টিবায়োটিক মিশে যাওয়ার আতঙ্কজনক খবরও পাওয়া গেছে। সর্বোপরি বুড়িগঙ্গা নদীকে গিলে খাচ্ছে পলিথিন, ট্যানারিসহ শিল্পকারখানার বিষাক্ত কেমিক্যালস ও বর্জ্য, হাসপাতাল-ক্লিনিকের পরিত্যক্ত কেমিক্যালস, লঞ্চ-জাহাজের পোড়া তেল, মবিল, ওয়াসার পয়ঃবর্জ্য, গৃহস্থালী বর্জ্য ও নদীর পাড়ে নির্মিত কাঁচা পায়খানা।

এদিকে দূষণের পাশাপাশি বাড়ছে নদী দখলের ঘটনাও। আদালতের রায় উপেক্ষা করে প্রতিদিনই নদীর কোনো না কোনো স্থান ভরাট করা হচ্ছে। বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর এম মোজাম্মেল হক জানান, নদীর উভয় তীরে এখনো কাঁচা-পাকা কয়েকশ স্থাপনা রয়েছে উচ্ছেদের অপেক্ষায়। আশা করা হচ্ছে, এবছরই এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা সম্ভব হবে।

নদীর দূষণ সম্পর্কে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিক থেকে ট্যাবলেট-ক্যাপসুলের খোলস, স্যালাইন, সিরিঞ্জ, ব্যান্ডেজ, সিরাপ ইত্যাদি হাসপাতাল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে বুড়িগঙ্গায়। ফলে পানিতে মিশছে উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক। এছাড়া হাজারীবাগের দেড় শতাধিক ট্যানারির বিষাক্ত তরল ও কঠিন বর্জ্য প্রতিদিন মিশছে বুড়িগঙ্গার পানিতে।

যারা সরাসরি এ পানি ব্যবহার করছেন তারা তো বটেই, যারা ব্যবহার করছেন না তারাও পড়ছেন এর ক্ষতিকর প্রভাবের আওতায়। এসব দ্রব্য ঢাকাবাসীর দেহে কোনো না কোনোভাবে প্রবেশ করছে। শাকসবজি, বায়ু, বন্যার পানি বা মানবদেহ থেকেও মানবদেহে বিস্তার লাভ করছে উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক।

এছাড়া ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিরাজ করছে নানারকম অব্যবস্থাপনা। ফলে পাইপ লাইন দিয়ে স্যুয়ারেজের ময়লা এসে সরাসরি মিশে যাচ্ছে বুড়িগঙ্গার পানিতে।

উপরন্তু নদী তীরবর্তী লালবাগ, সোয়ারীঘাট, শহীদনগর, চাঁদনীঘাট, লালকুঠি, মালিটোলা, মিলব্যারাক, পোস্তগোলা, পাগলা, ফতুল্লা ইত্যাদি এলাকায় অভ্যন্তরীণ পয়ঃলাইনের সংযোগ রয়েছে পুরনো ড্রেনেজ লাইনে। বাদামতলী ও শ্যামবাজারের কাঁচা সবজির বাজার থেকে পরিত্যক্ত সবজি ও ময়লা ফেলা হচ্ছে বুড়িগঙ্গার পানিতে। পাশের শিল্প কারখানার সায়ানাইড, পারদ, ক্লোরিন, নানা রকম এসিড, সীসা, দস্তা-নিকেল, রাসায়নিক বর্জ্য, টেক্সটাইল, ব্যাটারি, লোহা, রং, রাবার কারখানার বর্জ্য, এমেক্সাসিলিন, পেনিসিলিন, সিপ্রোফ্লোক্সাক্সিন আর অ্যাজিথ্রোমাইসিনের মতো উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিকসহ ৬২ প্রকার কেমিক্যাল ভাসছে বুড়িগঙ্গার পানিতে মিশে। ফলে ঢাকাবাসীর শরীরে রোগ প্রতিরোধের কার্যকারিতা হারাচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক।

বুড়িগঙ্গার এই পঁচা পানির কারণে নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষ জন্ডিস, কলেরা, আমাশয়, ডায়রিয়াসহ নানা চর্ম ও পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিনই কোনো না কোনো হাসপাতালে ছুঁটছেন। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন ইত্তেফাককে বলেন, আমরা বারবার হাসপাতাল বর্জ্য নিয়ে কথা বলেছি। কিন্তু সরকার কর্ণপাত করেনি। বুড়িগঙ্গার পানি আর পানি নেই। বিষ হয়ে গেছে। কারণ, বুড়িগঙ্গা নদীর পানিতে এখন ৬২ প্রকার কেমিক্যাল মিশে আছে।

এ ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক মানবদেহে কি ধরনের প্রভাব রাখে এ সম্পর্কে বিশিষ্ট চিকিত্সা বিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. এম মুজিবুল হক ইত্তেফাককে বলেন, এসব বর্জ মানবদেহে নানাভাবে প্রবেশ করার ফলে দেহে কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে অ্যান্টিবায়োটিক।

অধ্যাপক ডা. এম মজিবুল হক আরো বলেন, বুড়িগঙ্গায় স্রোত না থাকায় বিষাক্ত বর্জ্য, ময়লা-আবর্জনা পঁচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। সে সঙ্গে ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদীর তলদেশ। ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম এমনকি পারদের মতো ক্ষতিকর বিষাক্ত পদার্থের ভারে নদীর অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, পরিশোধন করেও এ পানি ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না।

নগর গবেষণা কেন্দ্রের সভাপতি ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম ইত্তেফাককে বলেন, প্রতিদিন ১০ হাজার ঘনমিটারের বেশি বর্জ্য সরাসরি ফেলা হচ্ছে বুড়িগঙ্গা নদীতে। এছাড়াও নদীর তলদেশে জমা হয়েছে ৮ থেকে ১০ ফুট পলিথিনের স্তর। বুড়িগঙ্গার পানির বিষাক্ততা বহু আগেই মাত্রা অতিক্রম করেছে । এই বিষাক্ত ও দূষিত পানি কোনো না কোনোভাবে মানবদেহে মিশে গিয়ে ক্ষতি সাধন করছে।

তিনি উচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়নের মাধ্যমে বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশের নদী রক্ষায় সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান।

http://www.ittefaq.com.bd/print-edition/city/2017/03/18/183050.html