১৮ মার্চ ২০১৭, শনিবার, ১০:১৫

সিলেটে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন

এক বছরের প্রাণহানির সংখ্যা ছাড়াল ২ মাসে

গভীর গর্ত খোঁড়া হয়। তাতে পাইপ বসিয়ে মাটির প্রায় ৫০ থেকে ৬০ ফুট নিচ থেকে তোলা হয় পাথর। এতে ভূগর্ভস্থ মাটির স্তর পরিবর্তন হবে, সবশেষে প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারিয়ে মাটি ধস অথবা ভূকম্পনে ক্ষতির মাত্রা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। সিলেটের পাথর কোয়ারিতে বোমা মেশিন নামের যন্ত্র দিয়ে পাথর উত্তোলনে এ রকম পরিবেশগত প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে সাত বছর আগে অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন উচ্চ আদালত। নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল এ যন্ত্রের ব্যবহার বন্ধে টাস্কফোর্স গঠন করে অভিযান অব্যাহত রাখা।
আদালতের এই নির্দেশে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ স্থানীয় প্রশাসন গত সাত বছরে পাঁচ শতাধিক অভিযান পরিচালনা করে ধ্বংস করেছে সহস্রাধিক বোমা মেশিন। এরপরও ব্যবহার বন্ধ হয়নি। বোমা মেশিনের জন্য খোঁড়া গর্ত থেকে পাথর তুলতে গিয়ে একের পর এক শ্রমিক হতাহতের ঘটনার পেছনে অবৈধ যন্ত্র দিয়ে পাথর উত্তোলনে পরিবেশগত ক্ষতির ‘সর্বশেষ সর্বনাশ’কে মুখ্য কারণ হিসেবে দেখছেন পরিবেশবাদীসহ বিশেষজ্ঞরা।
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ শাহেদুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘যন্ত্র দিয়ে গভীর থেকে পাথর তুললে স্বাভাবিকভাবেই মাটির নিচের স্তরে নানা রকম পরিবর্তন দেখা দেয়। এগুলো পর্যবেক্ষণে না রেখে বরং মাটির গভীর থেকে পাথর উত্তোলন অব্যাহত রাখলে সর্বশেষ সর্বনাশ ঘটে। মাটির নিচে প্রাকৃতিক স্তরের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ায় ঘটছে ঘন ঘন ধসের ঘটনা। তাঁর মতে, এই অবস্থা মোকাবিলা করতে হলে অবশ্যই যন্ত্র দিয়ে মাটির গভীর থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধ করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ সূত্রে পাওয়া হিসাবে দেখা গেছে, গত এক বছরের তুলনায় এ বছরের প্রায় দুই মাসে প্রাণহানি দ্বিগুণ ছাড়িয়ে গেছে। গত বছরের ১০ মে থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয়টি গর্ত ধসের ঘটনায় কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ, শাহ আরেফিন টিলা, জাফলং, বিছনাকান্দি পাথর কোয়ারিতে মারা গেছেন ১২ জন পাথরশ্রমিক। এ বছর ২৩ জানুয়ারি থেকে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পৃথক নয়টি গর্ত ধসের ঘটনায় ১৬ জন নিহতের মধ্যে শুধু শাহ আরেফিন টিলায় প্রাণ হারালেন ৭ জন।
এসব ঘটনায় কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট থানায় আটটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। কিন্তু আট মামলায় এ পর্যন্ত কোম্পানীগঞ্জে একজন গর্তমালিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাটে আটটি মামলায় এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হওয়া ১০ জনই নিরীহ পাথরশ্রমিক।
কোম্পানীগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) রুহুল আমিন বলেন, ঘটনার পরপরই গর্তমালিকেরা গা ঢাকা দেওয়ায় গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয় না। অন্যদিকে গোয়াইনঘাটের পরিদর্শক (তদন্ত) জাহাঙ্গীর হোসেন সরদার বলেন, পাথরশ্রমিকদের একটি অংশ গর্ত খোঁড়ার পেছনে আছে। তাই এঁদের ছাড় দেওয়ারও সুযোগ নেই।
সিলেটে বোমা মেশিনে প্রথম ধ্বংসযজ্ঞের মুখে পড়ে ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারিসংলগ্ন বাংলাদেশ রেলওয়ের একমাত্র রজ্জুপথ (রোপওয়ে)। পাথর পরিবহনে স্থল ও জলপথের বিকল্প পথ হিসেবে ভোলাগঞ্জ থেকে সুনামগঞ্জের ছাতক পর্যন্ত রজ্জুপথ ১৯৬৪ সালে স্থাপন করা হয়। ধলাই নদের তীর ঘেঁষে ২০০৮ সাল থেকে বোমা মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলন করার একপর্যায়ে রজ্জুপথের সংরক্ষিত বাংকার এলাকায় বোমা মেশিন চালিয়ে পাথর উত্তোলন শুরু হয়। সংরক্ষিত এলাকার ৩৫৯ একর জায়গার মধ্যে ১৪১ একর ভূমিধসের মুখে পড়লে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ওই ভূমি রক্ষায় ১৪৪ ধারা জারি করে রেলের নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন রেখেছে।
পাথর কোয়ারিতে এ বছর নয়টি ঘটনায় ১৬ জনের প্রাণহানির পর সিলেটের জেলা প্রশাসনের পক্ষে সরেজমিন তদন্ত করেছেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) আবু সাফায়াৎ মুহম্মদ শাহেদুল ইসলাম। জাফলংয়ে বৃহস্পতিবারের প্রাণহানির পর তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব ঘটনাকে আগে নিছক দুর্ঘটনা বলে ধরা হতো। এখন আর এভাবে দেখার অবকাশ নেই। তাই একেকটি ঘটনার পরপরই থানায় হত্যা মামলা দায়ের করা হচ্ছে। গত প্রায় দুই মাসে যে তিনটি স্থান আমি পরিদর্শন করেছি, তাতে রীতিমতো সর্বনাশ ঘটে গেছে। সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এ সর্বনাশ কাটানোর কোনো উপায় নেই।’

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1111708/