ফাইল ছবি
৪ মে ২০২০, সোমবার, ২:২৮

চ্যালেঞ্জের মুখে করোনা পরীক্ষা, মাঠে মাত্র পাঁচশ’ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট

চাহিদা দেড় লাখ, আছে ৫ হাজার * নমুনা সংগ্রহে দক্ষ মেডিকেল টেকনোলজিস্টের কোনো বিকল্প নেই -বিএসএমএমইউ উপাচার্য * টেকনোলজিস্টের কাজ অন্য কাউকে দিয়ে হবে না -ড. মুসতাক

দক্ষ মেডিকেল টেকনোলজিস্টের অভাবে কোভিড শনাক্তকরণ পরীক্ষা কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। দেশে চাহিদা দেড় লাখ টেকনোলজিস্ট। আছে মাত্র ৫১৬৫ জন। নমুনা সংগ্রহ করছেন মাত্র ৫০০ জন। এদের হাতেই দেশব্যাপী সন্দেহভাজন করোনা অক্রান্তদের নমুন সংগ্রহ ও পরীক্ষার ভার।

চাহিদার তুলনায় খুবই কম লোকবল দিয়ে যথাযথভাবে কাজটি হচ্ছে না। দেশের ল্যাবের সংখ্যা বাড়লেও দক্ষ লোকবলের অভাবে সঠিকভাবে রোগীর নমুনা সংগ্রহ হচ্ছে না। এতে পরীক্ষায় সঠিক ফল পাওয়া নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।

ফলে দেশে আসলে শনাক্ত কত তা যেমন জানা যাচ্ছে না। তেমনি নিজের অজান্তে আক্রান্তদের অনেকেই প্রাণঘাতী ভাইরাসটি ছড়িয়ে যাচ্ছেন কিনা তা কেউ বলতে পারছে না। কাজেই শনাক্তের প্রকৃত তথ্য পেতে এ অবস্থায় যোগ্যদের মাঠে নামানোর কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্যসংশ্লিষ্টরা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনাভাইরাসের নমুনা সংগ্রহ থেকে শুরু করে ল্যাবে পরীক্ষা করা পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল। এই কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করতে দরকার দক্ষ একটি কর্মীবাহিনী। অদক্ষ কর্মী দিয়ে নমুনা সংগ্রহ করলে বাড়বে স্বাস্থ্যঝুঁকি।

পাশাপাশি ছড়িয়ে পড়তে পারে ভাইরাসটি, ক্ষত সৃষ্টি হতে পারে রোগীর শরীরে। সর্বোপরি অদক্ষ হাতে নমুনা সংগ্রহ, প্রস্তুত ও মেশিনে পরীক্ষার জন্য প্রসেসিং করলে সেখান থেকে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়ার কোনো আশা থাকে না। যা শুধু সময় এবং অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, শুধু অদক্ষ হাতে নমুনা সংগ্রহ করায় দেশের বিভিন্ন ল্যাবে পরীক্ষার ফলাফল সঠিক বলে মনে হচ্ছে না। তিনি বলেন, একটি ল্যাবে সম্প্রতি সন্দেহজনক রোগীদের ৩৬টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে।

কিন্তু সব ফলাফলই নেগেটিভ এসেছে। এতে শুধু লক্ষাধিক টাকার কিট নষ্ট হয়েছে তাই নয়, নষ্ট হয়েছে অনেক কর্মঘণ্টা। পাশাপাশি নেগেটিভ ফল পেয়ে হয়তো অনেকে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে অবাধ মেলামেশা করে রোগটি ছড়িয়ে দিচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া নিজ কার্যালয়ে রোববার দুপুরে যুগান্তরকে বলেন, করোনা ভাইরাসের নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা একটি জটিল কারিগরি (টেকনিক্যাল) কাজ।

এই কাজে শুরু থেকে প্রত্যেকটি পর্যায়ে যারা দায়িত্ব পালন করবেন তাদের অবশ্যই সুপ্রশিক্ষিত ও দক্ষ হতে হবে। এক্ষেত্রে দক্ষ ভাইরোলজিস্টের পাশাপাশি দক্ষ মেডিকেল টেকনোলজিস্টের কোনো বিকল্প নেই।

জানা গেছে, দেশে সরকারি পর্যায়ে কর্মরত চিকিৎসকের মোট পদ আছে ৩০ হাজার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী একজন চিকিৎসকের বিপরীতে ৫ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট থাকতে হবে। সেই হিসেবে দেশে ১ লাখ ৫০ হাজার মেডিকেল টেকনোলজিস্ট প্রয়োজন।

অথচ সর্বসাকুল্যে আছে মাত্র ৫ হাজার ১৬৫ জন। এর মধ্যে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাবরেটরি) রয়েছেন ২ হাজার ১৮২টি। এই সামান্য সংখ্যক মেডিকেল টেকনোলজিস্ট দিয়ে করোনা মহামারীর বৈতরণী পার হওয়া এক প্রকার অসম্ভব।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী ১ জন চিকিৎসকের বিপরীতে ৫ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট থাকার কথা থাকলেও মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের মোট পদ (৬টি শাখা মিলিয়ে) ৭৯২০টি। কর্মরত আছে ৫১৬৫ জন, পদ শূন্য আছে ২৭৫৫টি।

এর মধ্যে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাবরেটরি) মোট পদ ২১৮২টি, কর্মরত ১৪১৭ জন, পদ শূন্য আছে ৭৬৫টি। নমুনা সংগ্রহ করছে প্রায় ৫০০ জন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১০ বছর ধরে মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের নিয়োগ হচ্ছে না। সম্প্রতি এক হাজার টেকনোলজিস্ট নিয়োগের কথা হলেও সেটি প্রত্যাখ্যান করেছে সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, দেশের করোনা প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর থেকেই ভাইরাসটি শনাক্তে রোগীদের নমুনা সংগ্রহ (রক্ত এবং নাক ও গলা থেকে লালা) পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আসছে সরকারি হাসপাতালে কর্মরত মেডিকেল টেকনোলজিস্টরা।

সরকারি হাসপাতালে কর্মরতদের দিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে স্বল্প পরিসরে করোনা রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে দেশব্যাপী করোনার সংক্রমণ হয়েছে। এতে রোগীর সংখ্যা এবং পরীক্ষা কেন্দ্র বৃদ্ধি পেয়েছে।

এ অবস্থায় সরকারি পর্যায়ের সীমিত সংখ্যক মেডিকেল টেকনোলজিস্ট দিয়ে সুষ্ঠুভাবে এ কাজ অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এছাড়া করোনা রোগীর নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষায় নিয়োজিত প্রায় অর্ধশত মেডিকেল টেকনোলজিস্ট করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন এবং অনেকে কোয়ারেন্টিনে আছেন।

এ পরিস্থিতিতে কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারদের দিয়ে নমুনা সংগ্রহ করার ফলে করোনা রোগীর নমুনা সংগ্রহ ও সঠিক রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হয়েছে।

অথচ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়াধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ৩ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল টেকনোলজি (ল্যাবরেটরি) কোর্স সম্পন্ন করা ১৫ হাজার প্রশিক্ষিত মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের করোনা রোগীর নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজে না লাগানো হচ্ছে না।

এ প্রসঙ্গে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, নমুনা সংগ্রহ, প্রস্তুত এবং প্রসেসিং- এসবই করে থাকে টেকনোলজিস্টরা। অন্য কোনো ব্যক্তি নমুনা সংগ্রহ করলে এক্ষেত্রে ক্ষতির আশঙ্কা থাকে।

সঠিকভাবে নমুনা সংগ্রহ নাও হতে পারে, রোগীর নাকের ভেতর ক্ষত সৃষ্টি হতে পারে এমনকি ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে। শুধু প্রশিক্ষিত মেডকেল টেকনোলজিস্টই পারে সঠিকভাবে এই কাজটি করতে।

তারাই সর্বপ্রথমে রোগীর নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর চিকিৎসকরা চিকিৎসা এবং নার্স সেবা প্রদান করে থাকেন। কাজেই ডাক্তার ও নার্স নিয়োগের পাশাপাশি মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের নিয়োগ প্রদান করা অত্যাবশকীয়।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পরিষদের সাবেক মহাসচিব সেলিম মোল্লা যুগান্তরকে বলেন, সরকার করোনা মোকাবেলায় দেশের স্বার্থে ২ হাজার ডাক্তার এবং ৬ হাজার নার্স নিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও করোনা যুদ্ধের প্রথম সারির সৈনিক মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের নিয়োগের বিষয়টি উপেক্ষিত হওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক। করোনা মোকাবেলায় বিপুলসংখ্যক মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দেয়া অত্যন্ত জরুরি।

সামগ্রিক বিষয়ে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুসতাক হোসেন যুগান্তরকে বলেন, নমুনা সংগ্রহ থেকে প্রস্তুত করা পর্যন্ত কাজটি মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের। এটি অন্য কাউকে দিয়ে করালে হবে না।

দেশে এমনিতেই টেকনোলজিস্টের ঘাটতি রয়েছে, তারপরও বর্তমান অবস্থায় সেটি আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। তিনি বলেন, করোনা মোকাবেলায় এখন টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দেয়ার কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে তাদের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নিয়োগ করা যেতে পারে। তবে তাদের কাজ অন্য কাউকে দিয়ে করালে ফল পাওয়া যাবে না।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/303908/