১৭ মার্চ ২০১৭, শুক্রবার, ১০:০৭

ইসলামি সভ্যতা পুনর্জাগরণের সম্ভাবনা

 

|| শাহ্ আব্দুল হান্নান ||
আমি সম্প্রতি ‘মুসলিম সভ্যতা অবক্ষয়ের কারণ ও সংস্কারের আবশ্যকতা’ শীর্ষক একটি অসাধারণ বই পড়লাম। বইয়ের লেখক স্বনামধন্য অর্থনীবিদ ইসলামি গবেষক, ইসলামিক স্টাডিজে কিং ফয়সাল পুরস্কার পাওয়া লেখক ড. এম উমর চাপড়া। বইটি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থ্যট (BIIT), থেকে প্রকাশিত হয়েছে। তাদের ঠিকানাÑ বাড়ি নং ৪, রোড নং ২, সেক্টর ৯, উত্তরা, ঢাকা।
ড. উমর চাপড়া এ বইটি যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রিসার্চ প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ফাউন্ডেশন, লেস্টার এর অনুরোধে লিখেন। এই বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে তিনি বিশ্ববিখ্যাত ইসলামি ইতিহাস ও সমাজবিদ ইবনে খলদুনের বই ‘কিতাবুল ইবারের’ ভূমিকা বা ‘মুকাদ্দিমাহ’ থেকে জাতির উন্নয়ন ও অবক্ষয় তত্ত্ব তুলে ধরেন। খলদুন বলেছেন যে, উন্নয়ন ও অবক্ষয়ে ন্যায়বিচার ও সম্পদের ভূমিকা রয়েছে। মুকাদ্দিমাতে ইবনে খলদুন যেসব মূলনীতি বলেছেন তা হচ্ছে যেÑ (১) জনগণের সমর্থনেই শাসক ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে; (২) ন্যায়বিচার ব্যতীত উন্নয়ন সম্ভব নয়; (৩) উন্নয়ন ব্যতীত সম্পদ অর্জন করা যায় না; (৪) সম্পদ ছাড়া জনগণের সমস্যা সমাধান করা যায় না; (৫) শাসকের দায়িত্ব শরিয়ত ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা এবং আল্লাহ ন্যায়বিচারের মাপকাঠিতেই মানুষের বিচার করবেন।
বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ে ড. উমর চাপড়া রাসূলুল্লাহর আগমনের পর কয়েক শতাব্দী ধরে মুসলিমদের যে উন্নয়ন হয়েছিল, তার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। সে আমলে ইসলামের ভিত্তিতে ব্যক্তিপর্যায়ে ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আমূল পরিবর্তন হয়েছিল। মুসলিম শাসনাধীন সব এলাকা ছিল একটি সাধারণ বাজার (Common Market)। ফলে সব এলাকার দ্রুত উন্নয়ন হয়েছিল। কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতির অগ্রগতি হয়েছিল, নগরও সমৃদ্ধ হয়েছিল। জ্ঞান জগতের ব্যাপক উন্নতি হয়েছিল, অনেক কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল, বৈজ্ঞানিক উন্নয়ন নতুন মাত্রা পেয়েছিল। স্বাধীন আইন ও বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ অধ্যায় পর্যন্ত তিনি মুসলিম রাষ্ট্র ও সমাজের অবক্ষয়ের ধরন ও কারণ আলোচনা করেছেন। কিছু লেখক ইসলামের উত্তরাধিকার আইনের মাধ্যমে ব্যাপক বণ্টনকে দায়ী করেছেন, এর ফলে পুঁজি গঠন হয় না। জাকাতকে এবং ওয়াকফকেও তারা দায়ী করেছেন। ড. উমর চাপড়া এসব দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন।
মুসলমানদের অবক্ষয়ের কারণ ছিল নির্বাচিত খিলাফত থেকে রাজতন্ত্রে ফিরে যাওয়া, অবশ্য তারা খলিফা পদবিটি ধরে রেখেছিলেন। তাদের মধ্যে অনেক ন্যায়পরায়ণ শাসকও তৈরি হয়েছিলেন যেমনÑ ওমর ইবনে আবদুল আজিজ আব্বাসীয় খলিফা হারুনুর রশীদ, নূরুদ্দীন শহীদ, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী। শরিয়তের নিয়ন্ত্রণ এভাবে অব্যাহত ছিল।
তিনি অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের কারণ হিসেবে অভিহিত করেছেন সরকারের আয় থেকে ব্যয় বেশি করা, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক পদ-পদবি বিক্রয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অবক্ষয়ের কারণ ছিল রাষ্ট্রীয় অর্থসহায়তায় ভাটা, বেসরকারি খাতের কার্যকর ভূমিকা পালনে ব্যর্থতা। দার্শনিক ক্ষেত্রে যুক্তিবাদী ও রক্ষণশীলদের দ্বন্দ্ব। তারা এসব বিষয়ে বিতর্ক করছিল যে স্রষ্টার প্রকৃতি কী রূপ, সৃষ্টি কি স্রষ্টার মতো চিরন্তন, কুরআন কি আল্লাহর সৃষ্টি না কেবল ‘কালাম’? এসব ছিল অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক, এসবের ওপর মূল ইমান নির্ভরশীল ছিল না।’ এসব সমস্যা সমাধানের জন্য ইমাম গাজ্জালী, ইবনে রুশদ, ইবনে তাইমিয়া চেষ্টা করেন। যা-ই হোক এর ফলে শেষ পর্যন্ত মুসলিম সমাজে রক্ষণশীলতা বৃদ্ধি পায়। সামাজিক ক্ষেত্রে ফিকাহ শাস্ত্র স্থবির হয়ে পড়ে এবং নারীদের অবস্থার অবনতি হয়।
নবম অধ্যায়ে তিনি মুসলিমদের সম্ভাব্য সংস্কার কর্মসূচি সম্পর্কে আলাপ করেছেন। তিনি নৈতিক সংস্কারকে প্রথম গুরুত্ব দিয়েছেন। ন্যায়বিচার, উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে উদ্যোগী হওয়ার কথা বলেছেন। তিনি শিক্ষার প্রসারের ও ুদ্রঋণ বিস্তার করার কথা বলেছেন। তিনি রাজনৈতিক সংস্কারের ক্ষেত্রে যতই সময় লাগুক শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। গণতন্ত্র ইসলামি খিলাফত বা রাষ্ট্রব্যবস্থার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। যেহেতু ইসলামি পুনর্জাগরণ মুসলিম বিশ্বে দানা বেঁধেছে তা প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না। সেকুলারিজম কায়েম করার চেষ্টা তুরস্কে, তিউনিসিয়ায় সফল হয়নি। তবে ভবিষ্যতে ফিকাহকে স্থবিরতা থেকে উদ্ধার করতে হবে, এ কাজ অনেকটা হয়েও গেছে। ভবিষ্যতে ইসলামের বিজয়ের সম্ভাবনা উজ্জ্বল।

www.dailynayadiganta.com/detail/news/204172