পদ্মার বুকে চলছে ঘোড়ার গাড়ি। ছবিটি পাবনার শিলাইদহ ঘাট এলাকা থেকে তোলা :নয়া দিগন্ত
১৬ মার্চ ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:৫২

প্রমত্তা পদ্মার বুকে এখন চলছে ঘোড়ার গাড়ি: পানিপ্রবাহের তথ্য দেয়নি হাইড্রোলজি বিভাগ

 

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির ২০ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে। এ বছর জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত শুষ্ক মওসুমে ফারাক্কা ব্যারাজ দিয়ে বাস্তবে চুক্তিমাফিক পানিপ্রবাহ নজরে পড়েনি। এপ্রিল-মে মাসকে চুক্তির শর্তে শুষ্ক মওসুম ধরে ভারতের ফারাক্কা পয়েন্টে পানিপ্রবাহ যাই থাক তা কোনোভাবেই বাংলাদেশের পদ্মা নদীর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে ৩৫ হাজার কিউসেকের নিচে আসবে না; কিন্তু বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। পর্যাপ্ত পানি থাকা দূরের কথা, এক সময়ের প্রমত্তা পদ্মার বুকে এখন চলছে ঘোড়ার গাড়ি।
গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি ১৯৯৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়ার পর পানি সর্বনি¤œপর্যায়ে পৌঁছে যায়। ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবে গৌড়া নতুন দিল্লির হায়দারাবাদ হাউজে গঙ্গা নদীর পানি বণ্টনসংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ৩০ বছর মেয়াদি এ চুক্তিতে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে শুষ্ক মওসুমে বাংলাদেশ ৩৫ হাজার কিউসেক পানি পাবে; কিন্তু বাংলাদেশ কোনো বছরই চুক্তির শর্ত অনুয়ায়ী পানি পাচ্ছে না। যদিও হাইড্রোলজি বিভাগের পাবনা অফিস চুক্তির পর থেকে পানিপ্রবাহের কোনো তথ্য সাংবাদিকদের দিচ্ছে না। কর্মকর্তাদের জিজ্ঞেস করলে বলা হয়, যৌথ নদী কমিশন তথ্য দিতে পারবে। বর্তমানে পদ্মা নদীর কোনো কোনো স্থানে হেঁটেই পার হওয়া যায়। অথচ পানিপ্রবাহ চুক্তির শর্ত কার্যকর থাকলে পদ্মা ও এর শাখা নদীর দুরাবস্থায় পড়ার কথা নয়; কিন্তু বাস্তবে সেটাই হচ্ছে।
পদ্মা নদীতে পানিস্বল্পতার কারণে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে মরুকরণ অবস্থা স্থায়ী রূপ নিতে যাচ্ছে। চৈত্র-বৈশাখ-জৈষ্ঠ মাসে দিনে প্রচণ্ড তাপদাহ আর গভীর রাতে শীতকালের মতো আবহাওয়া অনুভব করছে মানুষ, যা মরু আবহাওয়ার লক্ষণ বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে অনেক আগেই। পদ্মা পাড়ে এখন গাঙচিল, বেলেহাঁস আর দেখা যায় না। দৃষ্টিতে আসে না অন্যান্য পাখি। পদ্মা নদীতে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় প্রায় মাছশূন্য পদ্মা। যে কারণে সাদা বক গাঙচিল আর বেলেহাঁসের দেখা পাওয়া যায় না।
আন্তর্জাতিক নদী পদ্মার (গঙ্গা) উজানে ভারত বাঁধ দিয়েছে। ফারাক্কা ব্যারাজ দিয়ে ভাগিরথী নদীর মাধ্যমে পানিরপ্রবাহ ঘুরিয়ে নিয়েছে। ফারাক্কার উজানে পানি থৈ থৈ করছে। ভাটির বাংলাদেশ ক্রমেই তীব্র পানি সঙ্কটে নিপতিত হচ্ছে। পদ্মা নদীর সাথে এর প্রধান শাখা আত্রাই, গড়াইসহ ৫৩টি নদ-নদীর পানি প্রায় শুকিয়ে গেছে। এর সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়ায় নেমে গেছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর।
ফারাক্কার কারণে যশোর-খুলনা অঞ্চলে মিঠাপানির প্রবাহ কমে গেছে। পদ্মার তলদেশ ওপরে উঠে এসেছে। নদীর জীবনচক্র ধ্বংস হয়ে গেছে। জলজপ্রাণী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এখন পদ্মায় তেমন ইলিশ পাওয়া যায় না। ইলিশের বিচরণত্রে ছিল রাজশাহী থেকে পাবনা পর্যন্ত। মাছ আসার জন্য পানিতে যে পরিমাণ প্রবাহ থাকার কথা সেটি না থাকায় এখন আর পদ্মায় ইলিশ আসে না। গাঙ্গেয় পানিব্যবস্থায় দুই শতাধিক প্রজাতির মিঠাপানির মাছ ও ১৮ প্রজাতির চিংড়ি ছিল। সেগুলোর বেশির ভাগই এখন বিলুপ্তির পথে। পদ্মা নদীতে পানি স্বল্পতার কারণে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে মরুকরণ অবস্থা স্থায়ী রূপ নিতে যাচ্ছে। জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে অনেক আগেই।
দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ দেখছেন, নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। পদ্মা নদীতে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় এর প্রধান শাখা নদী আত্রাই ও গড়াই নদীতে পানির টান পড়েছে। গড়াই নদীর কুষ্টিয়া কয়ারা ব্রিজের নিচে বালু চর। জিকে প্রজেক্ট অকার্যকর হয়ে পড়েছে। পদ্মা, মধুমতি, নবগঙ্গা, কাজলা, মাথাবাঙ্গা, গড়াই, আত্রাই, চিকনাই, হিনসা, কুমার, সাগরখালী, কপোতাক্ষ, চন্দনাসহ পদ্মার ৫৩টি শাখা-প্রশাখা নদীর বুকে জেগে উঠেছে ছোট বড় অসংখ্য চর। কোনো কোনো স্থানে বালু স্থায়ী মৃত্তিকায় রূপ নেয়ায় ফসল আবাদ করেছেন অনেকেই। এলাকার মানুষ পদ্মায় এখন হেঁটে পারাপার হচ্ছে, চলছে ঘোড়ার গাড়ি।
বর্তমানে পদ্মা নদী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালন শাহ সড়ক সেতুর নিচে খাস জমিতে ফসলের সমারোহ। স্থানীয় কৃষক চিনাবাদাম, মিষ্টি আলু, মিষ্টিকুমড়া, ধান, গম, আখ, পটোল, খেসারি, মাসকালাই, মটর, কাউন, মরিচসহ নানান ফসল আবাদ করেছেন। চিনাবাদাম উত্তোলনের প্রস্তুতি চলছে। বর্ষা মওসুমের আগেই অন্যান্য ফসল ঘরে তুলতে চাচ্ছেন কৃষক। কারণ আষাঢ়-শ্রাবণ মাস শুরু হলে পদ্মা নদীতে পানি বেড়ে যাবে। এ সময় ফারাক্কার গেট খুলে দেয়া হলে পদ্মা নদীর গভীরতা কমে যাওয়ায় বন্যা দেখা দেবে।
পাবনার মধ্য দিয়ে পদ্মার আর একটি শাখা নদী মরা পদ্মা হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে মূল পদ্মা, গড়াই এবং পাবনার চাটমোহরের বড়াল, ছোট যমুনা, পুনভবা, আত্রাই, ইছামতি, গুমানী, গোমতী, ভদ্রবতী, গোহালা, নন্দকুজা, গাড়াদহ, কাকন, কানেশ্বরী, সরস্বতী, মুক্তাহার ঝবঝবিয়া, ফুলজোর এলাকা ঘুরে দেখা যায় এসব নদীর অস্তিত্ব হারিয়ে যাচ্ছে। পদ্মা নদীতে পানির টান পড়ায় এসব নদী শুকিয়ে গেছে। নদীর কোনো কোনো স্থানে এখন হাঁটু পানি। এলাকার প্রবীণ লোকদের মতে, ফারাক্কা ব্যারাজের আগে এসব নদ-নদীতে সারা বছর পানি থাকত।
অপর দিকে তিস্তা নদীতে পানি না থাকায় ব্রহ্মপুত্র নদে পানির টান পড়ায় যমুনা নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। পাবনা নগরবাড়ী, বেড়া-নাকালিয়া যমুনা নদীর বুকজুড়ে অসংখ্য ছোট বড় চর। বেড়ার নিকটবর্তী শাহজাদপুরে বাঘাবাড়ি ব্রিজের নিচে বড়াল নদীতে বিশাল চর পড়েছে। যমুনা নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় জ্বালানি তেল, রাসায়নিক সারসহ অন্যান্য পণ্যবাহী জাহাজ আন্ডারলোড নিয়ে বাঘাবাড়ী নৌবন্দরে আসছে। জ্বালানি ও রাসায়নিক সার আমদানি ও রফতানি অর্ধেকের কমে নেমে এসেছে। নদ-নদীতে ভয়াবহ নাব্যতা সঙ্কট দেখা দিয়েছে।
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বিশিষ্ট নদীবিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী কামরুন নেছা বলেন, গঙ্গা, তিস্তার পানি বণ্টনের সাথে ব্রহ্মপুত্রসহ অন্যান্য নদীর বিষয়ও আলোচনাভুক্ত করতে হবে। পানি বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। এই নিরাপত্তার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। এ ব্যাপারে ভারত সরকারের সাথে বাংলাদেশের নিবিড় আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। প্রয়োজনে এ বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে তুলতে হবে।

www.dailynayadiganta.com/detail/news/203914