১৬ মার্চ ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:৩৪

আসলে সহিংসতার শিকার হয়েছে কারা

 


উগ্রতা, সহিংসতা, সন্ত্রাস- এই শব্দগুলো মানুষ পছন্দ করে না। কারণ এই শব্দগুলো মানুষের জীবনে অশান্তি ডেকে আনে। তাই মনুষ্য সমাজে যারা এই শব্দগুলো চর্চা করে তারা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করে। এমন মানুষ সমাজে বসবাসের যোগ্যতা হারায়। তাদের বিচারের আওতায় আনতে হয়। তবে ইচ্ছেমাফিক কেউ কাউকে উগ্র বা সন্ত্রাসী বানাতে পারে না। এ জন্য প্রয়োজন হয় উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ। আর এই কাজগুলো যারা করবেন তাদের যথেষ্ট দায়িত্বশীল হতে হয় এবং হতে হয় নৈতিক মানে উন্নত। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, বর্তমান সময়ে এসব ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতা ও নৈতিক মানের অভাব প্রকটভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফলে বিদ্বেষ ও বিশেষ মতলবের কারণে নির্দোষ ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানকেও অনেক সময় উগ্রতা ও সন্ত্রাসের অপবাদে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এমন আচরণের কারণে প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। এমন অশুভ প্রোপাগান্ডা চলতে দেয়া যায় না।
প্রসঙ্গত এখানে মুসলিম ব্রাদারহুডের কথা উল্লেখ করা যায়। এই সংগঠনটির বিরুদ্ধে কিছু মানুষ এবং মহল উগ্রতা ও সহিংসতার অভিযোগ করে আসছেন। এদের একজন সৌদি আরবে নিযুক্ত তৎকালীন বৃটিশ হাইকমিশনার জন জেনকিনস। তিনি তাঁর রিপোর্টে মুসলিম ব্রাদারহুডের কর্মকা-কে সহিংস উগ্রপন্থার ‘সূচনা’ হিসেবে মন্তব্য করেছিলেন। তবে আশার কথা হলো, ২০১৪ সালের বিতর্কিত সেই রিপোর্টের মূল্যায়ন থেকে পিছু হটেছে বৃটিশ সরকার। সম্প্রতি এই রিপোর্টটি বাতিল করে দেয়া হয়েছে। এটির পরিবর্তে এখন পার্লামেন্টের বৈদেশিক সম্পর্ক কমিটির (এফএসি) মূল্যায়নের সাথে একমত পোষণ করতে যাচ্ছে সরকার। ইসলামী আন্দোলন বা ইসলামপন্থী রাজনীতি বিষয়ে বৃটিশ সরকারের নীতির আলোকে গত বছর একটি তদন্ত করেছে এফএসি। ওই তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইসলামপন্থী রাজনীতিকরা সহিংস উগ্রবাদের বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধের দেয়াল হিসেবে কাজ করছেন। ক্ষমতার ভেতর বা বাইরে যে অবস্থায়ই থাকুক, তাদের সাথে সহযোগিতা করা উচিত।
গত ৬ মার্চ এফএসির তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশের পর বৃটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বেশ কিছু প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে একমত যে, ইসলামপন্থী রাজনীতিবিদরা কখনই সহিংসতার সাথে জড়িত ছিলেন না। উল্টো তারা সহিংসতার শিকার হয়েছেন। মন্ত্রণালয় এটি নিশ্চিত করেছে যে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ইসলামপন্থী রাজনীতিকদের নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া উচিত এবং বৃটিশ সরকারের উচিত সর্বাবস্থায় তাদের সাথে কাজ করা। এমন মূল্যায়নের পর মুসলিম ব্রাদারহুড ও অন্যান্য ইসলামী আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর প্রকৃত অবস্থা উপলব্ধি করা যায়। এতে মিথ্যা প্রোপাগান্ডার অন্তঃসারশূন্যতাও স্পষ্ট হয়েছে।
বর্তমান সভ্যতার গতি প্রবাহের দিকে নজর দিলে বিস্মিত হতে হয়। একদিকে আলো ঝলমলে বিশাল বিশাল প্রাসাদ, অন্যদিকে বাস্তুহারা লাখ লাখ মানুষ খাদ্যাভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। একদিকে কোটি কোটি ডলার খরচ করে তৈরি করা হচ্ছে নিত্যনতুন মারণাস্ত্র, অন্যদিকে চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করছে লাখ লাখ দরিদ্র মানুষ। আর ভোগবিলাসে মত্ত লাখো মানুষ এমন আছে যে, তারা অন্য মানুষকে নিয়ে ভাবার কোন প্রয়োজনই মনে করে না। ইতিহাসের পাতায় আমরা আইয়ামে জাহেলিয়াতের কথা পড়েছি, তবে এটা কোন্্ জাহেলিয়াত? বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, বর্তমান সময়ে আমরা আলো ঝলমলে এক নব্য জাহেলিয়াতে বসবাস করছি। নয়তো বর্তমান সভ্যতায় কোটি কোটি মানুষ অনাহারের ঝুঁকিতে বসবাস করবে কেন?
বিবিসি পরিবেশিত খবরে বলা হয়, খরা ও যুদ্ধের কারণে বিশ্বের ৪ দেশ ইয়েমেন, সুমালিয়া, দক্ষিণ সুদান ও নাইজেরিয়ার ২ কোটির বেশি মানুষ অনাহার তথা দুর্ভিক্ষের হুমকিতে রয়েছে। জাতিসংঘ এই তথ্য জানিয়ে বলেছে, এ কারণে বিশ্ব ১৯৪৫ সালের পর সবচেয়ে বড় মানবিক সংকটের মুখে পড়েছে। জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা বিষয়ক সংস্থার প্রধান স্টিফেন ও ব্রায়ান গত ১০ মার্চ নিউইয়র্কে নিরাপত্তা পরিষদের সভায় বলেন, মারাত্মক বিপর্যয় এড়াতে আগামী জুলাইয়ের মধ্যে ৪,৪০ কোটি ডলার প্রয়োজন। এদিকে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ হুঁশিয়ারি দিয়েছে, চলতি বছর না খেয়ে ১৪ লাখ শিশুর মৃত্যু হতে পারে। জাতিসংঘ বলছে, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও সংঘাতের কারণে ওই অঞ্চলে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর স্থিতিশীলতা দ্রুত নষ্ট হচ্ছে। এ কারণে অনেকে বাস্তচ্যুত হবে। বেঁচে থাকার জন্য মানুষের ছুটাছুটি অব্যাহত থাকবে। ফলে গোটা অঞ্চলে অস্থিতিশীলতার মাত্রা আরো বেড়ে যাবে।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, বর্তমান সভ্যতায় যুদ্ধের জন্য, অস্ত্র নির্মাণের জন্য ও ষড়যন্ত্রের জন্য অর্থের অভাব হয় না। কিন্তু বিপর্যস্ত মানুষকে রক্ষায় ও মানবিক সহায়তায় অর্থ সংকট বড় হয়ে দেখা দেয়। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ২০১৭ সালে জাতিসংঘ বিপর্যপ্ত ৪টি দেশে সহায়তার জন্য মাত্র ৯ কোটি ডলারের তহবিল যোগাড় করতে পেরেছে ওই দেশগুলোর জন্য। আরো বেশি আর্থিক সহায়তার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু বর্তমান সময়ে সক্ষম বড় বড় দেশগুলো জাতিসংঘের আহ্বানকে তেমন গুরুত্ব দেয় না। বিশ্বের পরাক্রমশালী নেতাদের কেউ কেউ তো এখন আর্তমানবতার সেবায় সাহায্যের পরিমাণ আরো হ্রাস করার মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। এরা আবার মারণাস্ত্র তৈরিতে অর্থের কোন অভাব হবে না বলে ঘোষণা দিয়েছেন। বিশ্ব নেতাদের মনোভাব এমন হলে দরিদ্র দেশগুলোর কোটি কোটি মানুষ তো খাদ্য ও চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর ঝুঁকিতে থাকবেই। এমন পরিস্থিতিতে আমরা নিজেদের সভ্য মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে পারবো কী? অথচ বিশ্ব নেতারা তাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে সভ্যতা নিয়ে বেশ গর্ব প্রকাশ করে থাকেন। বর্তমান সভ্যতায় যুদ্ধের কারণে লাখ লাখ মানুষ নিহত হচ্ছে। গৃহহীন হয়েছে অসংখ্য মানুষ। কিন্তু এর জন্য দায়ী কারা? বিশ্ব রাজনীতির ভ্রষ্টতা এর জন্য দায়ী। ফলে দায় এড়াতে পারেন না বিশ্বনেতারা। কিন্তু দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তারা সাড়া দিতে চান না। ফলে বিশ্বে মানবিক সংকটের মাত্রা বেড়েই চলেছে। আত্মসমালোচনার মাধ্যমে এখন প্রয়োজন তাদের দায় স্বীকার করে নেয়া এবং বিপর্যস্ত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসা। নয়তো ইতিহাস কখনও তাদের ক্ষমা করবে না।

 

http://www.dailysangram.com/post/