১১ এপ্রিল ২০২০, শনিবার, ২:১৫

নিউইয়র্কে গণকবর

বিশ্বে লাখো মানুষের প্রাণ নিল করোনা

যুক্তরাষ্ট্রে একদিনে ১৯০০ মৃত্যু * ইউরোপে ৩-৪ দিনে দ্বিগুণ হচ্ছে রোগী * ভেন্টিলেশনের ৮০ ভাগ রোগীর মৃত্যু * ইতালিতে প্রাণ গেল শতাধিক চিকিৎসকের

বিশ্বের লাখো মানুষের প্রাণ কেড়ে নিল করোনাভাইরাস। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর চীনে প্রথম আঘাত হানে ভাইরাসটি। এরপর ১০২ দিনে বিশ্বের ২১০টি দেশ ও অঞ্চলে কোভিড-১৯ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে। ইউরোপের দেশগুলোকে বিপর্যস্ত করে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্রকেও মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছে করোনাভাইরাস। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হার্ডসন নদীপাড়ের ছবির মতো সুন্দর শহর নিউইয়র্ক- সুউচ্চ বিল্ডিংগুলো যেন আকাশকে মাটিতে নেমে আসার হাতছানি দেয়। রাত নামলেও এখানে দিনের আলো যেন নেভে না। আমেরিকানরা গর্ব করে বলেন- পৃথিবীর বুকে শ্রেষ্ঠ শহর নিউইয়র্ক। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহে তার চেহারাটা নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে। করোনার ভয়াল থাবায় সর্বদা জেগে থাকা নিউইয়র্ক এখন ভুতুড়ে নগরী। বিপুলসংখ্যক মৃতের সৎকারের জন্য কয়েক দিন ধরে গণকবর খোড়া হচ্ছে শহরটিতে। ইতালিতে শতাধিক চিকিৎসকের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে এই করোনা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, প্রতি তিন-চার দিন অন্তর ইউরোপে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হচ্ছে। কোভিড-১৯ নিয়ে প্রথমবারের মতো বৈঠক করেছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। এতে মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেন, করোনার কারণে বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে।

বাংলাদেশ সময় শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত ওয়ার্ল্ডওমিটারসের তথ্য অনুযায়ী- বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৯৭ হাজার ২৯২ জন, আক্রান্তের সংখ্যা ১৬ লাখ ২৩ হাজার ১৩০ জন। আর সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন ৩ লাখ ৬৬ হাজার ৪০৭ জন।

করোনায় দিশেহারা যুক্তরাষ্ট্রে বেড়েই চলছে মৃত ও আক্রান্তের সংখ্যা। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে মারা গেছেন ১ হাজার ৯০০ জন। মোট মৃত্যুতে স্পেনকেও ছাড়িয়ে গেল দেশটি। যুক্তরাষ্ট্রে এ পর্যন্ত মারা গেছেন ১৬ হাজার ৭১০ জন। মৃত্যুর সংখ্যায় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকলেও বিশ্বে করোনায় আক্রান্তের দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ধারেকাছেও নেই কোনো দেশ; এখানে আক্রান্ত ৪ লাখ ৬৯ হাজার ৪২১ জন। শুধু নিউইয়র্কে আক্রান্তের সংখ্যাই বিশ্বের সব দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। রাজ্যটিতে আক্রান্ত হয়েছেন ১ লাখ ৫৯ হাজার ৯৩৭ জন। বিপুলসংখ্যক মৃতের সৎকারের জন্য গণকবর খুঁড়ছে নিউইয়র্ক সিটি কর্তৃপক্ষ। হার্ট আইল্যান্ড নামক স্থানে এই গণকবরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে উনিশ শতক থেকেই বেওয়ারিশ ও সহায় সম্বলহীনদের লাশ দাফন হয়ে আসছিল। সাধারণত হার্ট আইল্যান্ডে প্রতি সপ্তাহে গড়ে ২৫ জনকে সমাহিত করা হয়। তবে এখন তা অনেক বেড়েছে। যেসব মৃত ব্যক্তি নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই তাদেরই এ কবরগুলোতে দাফন করা হচ্ছে। শুক্রবার বিবিসি অনলাইনের একটি প্রতিবেদনে ড্রোন থেকে তোলা ছবি প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে দেখা যায়, কয়েকজন ব্যক্তি সুরক্ষা পোশাক (পিপিই) পরে গণকবর খুঁড়ছেন। পরে সারি সারি কফিন রেখে দেয়া হচ্ছে সেসব কবরে।

নিউইয়র্ক সিটি স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, করোনায় আক্রান্ত যেসব রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কম, তাদের ৮০ ভাগই ভেন্টিলেটর লাগানোর পর মারা যাচ্ছেন। ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির ক্রিটিক্যাল কেয়ার স্পেশালিস্ট ডা. টিফেনি বলেন, যেসব রোগীর ইতোমধ্যে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত তাদের ভেন্টিলেটর লাগানোর পর অবস্থা আরও খারাপের দিক যায়। ভেন্টিলেটর নিজেই ফুসফুসের টিস্যুকে নষ্ট করে ফেলায় রোগী আর বাঁচতে পারে না। পালমোনারি ক্রিটিক্যাল কেয়ারের ডা. নেগিন হাজিজাদে বলেছেন, ভেন্টিলেটর নিউমোনিয়ার মতো রোগীদের জন্য ভালোভাবে কাজ করেছে; তবে কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য সেটা কাজ করছে না।

ইউরোপে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা খুব দ্রুত বাড়ছে উল্লেখ করে সতর্ক করেছে ডব্লিউএইচও (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)। সংস্থার কর্মকর্তা মারিয়া ভান কেরখোভে জানান, প্রতি তিন-চার দিন অন্তর ইউরোপে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হচ্ছে। তিনি বলেন, এ সময়ে ইউরোপজুড়ে ডাবলিং টাইম (যে সময়ের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হচ্ছে তাকে ডাবলিং টাইম বলা হয়) হল তিন থেকে চার দিন।

কয়েক সপ্তাহে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হওয়া স্পেন এবং জার্মানিতে করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা কিছুটা কমেছে। তবে বেড়েছে ইতালিতে। স্পেনে ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ৬৫৫ জন। এ নিয়ে মোট মৃতের সংখ্যা ১৫ হাজার ৮৪৩, মোট আক্রান্ত ১ লাখ ৫৭ হাজারের বেশি। জার্মানিতে গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ২৫৮ জন। আগের দিন এ সংখ্যা ছিল ৩৩৩। এ নিয়ে দেশটিতে মোট মৃতের সংখ্যা ২ হাজার ৬০৭ জন, আক্রান্ত ১ লাখ ১৮ হাজার ২৩৫ জন।

ইতালির হেলথ অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, ফেব্রুয়ারিতে দেশটিতে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকে সেখানে এখন পর্যন্ত শতাধিক চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে। করোনায় এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি মৃত্যুও ইতালিতে। দেশটিতে মোট প্রাণহানি ১৮ হাজার ২৭৯ জন, আক্রান্ত ১ লাখ ৪৩ হাজার ৬২৬। অপরদিকে সুস্থ হয়ে উঠেছেন ২৮ হাজার ৪৭০ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে মারা গেছেন ৬১০ জন। এমন পরিস্থিতিতে ইতালির প্রধানমন্ত্রী জিউসেপ কোঁতে সতর্ক করে বলেছেন, মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ঠিকভাবে সহায়তা করতে না পারলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ভেঙে যেতে পারে। বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, করোনায় সৃষ্ট সমস্যাগুলোকে অবমূল্যায়ন করা মোটেও উচিত হবে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

ফ্রান্সেও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে মারা গেছেন ১ হাজার ৩৪১ জন। ইউরোপের এ দেশটি করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যায় বিশ্বের চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে। ফ্রান্সে মৃতের সংখ্যা ১২ হাজার ২শ’ ছাড়িয়েছে, আক্রান্ত ১ লাখ ১৭ হাজারের বেশি।

যুক্তরাজ্যে করোনার প্রকোপ প্রতিদিনই বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে মৃত্যুর মিছিলে শামিল হয়েছেন আরও ৮৮১ জন। এ নিয়ে সেখানে মোট মৃত প্রায় ৮ হাজার, আক্রান্ত ৬৫ হাজারের বেশি। এদের মধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন মাত্র ১৩৫ জন। করোনা আক্রান্ত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছেন। ১০নং ডাউনিং স্ট্রিট থেকে জানানো হয়েছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তাকে আইসিইউ থেকে হাসপাতালের ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়েছে।

করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জনের পরামর্শ দিয়েছেন সৌদির শীর্ষ আলেমরা। দেশটির শীর্ষ আলেমদের সমন্বয়ে গঠিত বোর্ডের বিশেষ বৈঠকে বলা হয়, আধ্যাত্মিক উপায় অবলম্বনের শুরুটা হল- আল্লাহর ওপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখা এবং উদ্ভূত যে কোনো পরিস্থিতিতে আল্লাহর সিদ্ধান্তকে মেনে নেয়া। দেশটিতে এ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৩২৮৭ জন, মৃত্যু হয়েছে ৪৪ জনের।

এবার করোনাভাইরাস ধরা পড়ল যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেনেও। শুক্রবার হাদ্রামৌত প্রদেশে এক ব্যক্তির শরীরে ভাইরাস শনাক্তের কথা জানিয়েছে করোনা নিয়ন্ত্রণে গঠিত দেশটির সর্বোচ্চ কমিটি। দীর্ঘদিন ধরে চলমান যুদ্ধে ইয়েমেনের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা একেবারেই ভেঙে পড়েছে। জাতিসংঘ বলছে, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানবিক বিপর্যয়ে ভুগছে মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশটি। সেখানে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের হানায় ভয়াবহ দুর্যোগ নেমে আসতে পারে।

ফিলিপাইনে করোনায় আক্রান্ত হয়ে নতুন করে ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। অপরদিকে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ১১৯ জন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এ দেশটিতে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ২২১, আক্রান্ত ৪ হাজার ১৯৫ জন। দেশটিতে করোনা রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে এ পর্যন্ত ৯ চিকিৎসক প্রাণ হারিয়েছেন। চিকিৎসা সরঞ্জামাদির সংকট দেখা দিয়েছে বলে অভিযোগ করছেন তাদের চিকিৎসকরা।

থাইল্যান্ডে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৫০ জন। এদের মধ্যে তিনজন বহিরাগত বলে জানিয়েছে দেশটির স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ। এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ৪৭৩ জন, মারা গেছেন ৩৩ জন।

করোনা সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকায় দুই সপ্তাহ হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে বলা হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকান দেশ বতসোয়ানার সব সংসদ সদস্যকে। এমনকি প্রেসিডেন্ট মকগেতসি মাসিসিও সেই নির্দেশনা মেনে চলছেন। শুক্রবার এক টুইটে এ তথ্য জানিয়েছে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/297254