১২ মার্চ ২০২০, বৃহস্পতিবার, ১:০২

ওরা করোনা ভাইরাস থেকেও ভয়ঙ্কর

বর্তমান বিশ্বে নানা প্রসঙ্গে সংবিধানের বিষয়টি উত্থাপিত হয়ে থাকে। সংবিধান আসলেই উত্থাপিত হওয়ার মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সংবিধান নাগরিকদের অধিকারও কর্তব্য প্রসঙ্গে কথা বলে, শাসন-প্রশাসন প্রসঙ্গে কথা বলে, কথা বলে রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও লক্ষ্য প্রসঙ্গেও। আসলে সংবিধান ছাড়া জনগণের জীবন মান উন্নয়ন, দেশের প্রগতি ও শৃঙ্খলা বিধান সম্ভব নয়। আর এসবের সাথে গভীরভাবে ছড়িয়ে আছে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা, বোধ-বিশ্বাস তথা জীবন দর্শনের বিষয়টি। প্রসঙ্গত এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সংবিধান কোনো খণ্ডিত কিংবা একদশের বিষয় নয়; বরং সরার বিষয়, সামগ্রিক বিষয়। তাই সংবিধানের সুফল পেতে হলে প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সবার সচেতনতা ও কর্তব্যবোধ। এই সচেতনতা ও কর্তব্যবোধ বর্তমান সভ্যতায়, বিশ্ব ব্যবস্থায় কতটা বিরাজমান সেই প্রশ্নই এখন বড় হয়ে উঠেছে। সংবিধান প্রসঙ্গে সবার সচেতনতা ও কর্তব্যবোধ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও সবার করণীয় কিন্তু একরকম নয়। একজন সাধারণ নাগরিক, জনপ্রতিনিধি, সচিব, মন্ত্রী, বিচারক, প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব বা করণীয় কি একপর্যায়ের? উপলব্ধি করা যায় দায়িত্ব যার যত বড়, তার করণীয়ও তত উচ্চ পর্যায়ের। ফলে সংবিধানের বাস্তবায়ন ও মর্যাদা রক্ষার দায়িত্বে তারতম্য আছে। বড়দের দায়িত্ব তো বড় হবেই। ফলে সংবিধান প্রসঙ্গে বড়দের কথাই বারবার উচ্চারিত হয়ে থাকে।

বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় আমরা সংবিধানে সংযোজন, বিয়োজন তথা পরিবর্তনের ঘটনা লক্ষ্য করেছি। যারা ক্ষমতায় থাকেন সাধারণত তারাই সংবিধান পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়ে থাকেন এবং তারা দেশ ও জনগণের কল্যাণের কথা বলেই কাজটি করে থাকেন। কিন্তু অনেক সময়ই কথাও কাজে মিল লক্ষ্য করা যায় না। বরং লক্ষ্য করা যায় ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে ব্যক্তি ও দলের স্বার্থে সংবিধানে কাঁচি চালানো হয়। আজকাল তো এমনও লক্ষ্য করা যায় যে, দেশের সংহতি ও বৈচিত্র্যের ঐক্যকে বিসর্জন দিয়ে সংকীর্ণ ও উগ্র সাম্প্রদায়িক চেতনাকে প্রতিষ্ঠিত করতেও সংবিধানে হাত দেওয়া হয়। তবে যত দিন যেতে থাকে ততই স্পষ্ট হয়ে ওঠে ক্ষমতাসীনদের কুৎসিত মানসিকতা। তখন দেশের মানুষই বলে ওঠেন, ওরা করোনা ভাইরাস থেকেও ভয়ঙ্কর।

করোনার ভয়ঙ্কর রূপ বিশ্ববাসী দেখেছে। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের সাথে যখন ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদের তুলনা, করা হয়, তখন উপলব্ধি করা যায় বর্তমান সভ্যতায় রাজনীতি কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। মানুষের রাজনীতি এমন হবে কেন? প্রশ্ন জাগে, মানুষ কি তাহলে এখন আর কাক্সিক্ষত মানুষ নেই? তবে সংবিধানে হাত দেওয়া এখনো পৃথিবীতে অব্যাহত আছে।

‘রাশিয়ার সংবিধানে যুক্ত হচ্ছে স্রষ্টায় বিশ্বাস’ শিরোনামে একটি খবর মুদ্রিত হয়েছে পত্রিকান্তরে। এএফপি পরিবেশিত খবরটিতে বলা হয়, রাশিয়ার সংবিধানে বেশ কিছু পরিবর্তনের প্রস্তাব জমা দিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছে, স্রষ্টায় বিশ্বাসের বিষয়টি নতুনভাবে সংবিধানের যোগ করা হবে এবং সমলিঙ্গে বিয়ের অধিকার রাখা হবে না। সংবিধান সংশোধনের খসড়ায় আরো বলা হয়েছে। স্রষ্টায় বিশ্বাস রয়েছে রাশিয়ার। বিয়ে কেবল একজন পুরুষের সাথে একজন নারীর হবে। প্রস্তাবে বিয়েকে নারী ও পুরুষের ঐক্য হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। গীর্জার সাথে রুশ প্রেসিডেন্টের একটা সম্পর্ক রয়েছে। তাই অনেকে বলছেন, এ কারণেই সংবিধানের ওই ধরনের পরিবর্তন আসছে। যাজকদের পরামর্শে এমন সংশোধন উদ্যোগের সমালোচনা করে কেউ কেউ বলছেন, সংবিধানে এ ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসার ফলে রাশিয়া নিজের অবস্থান থেকে অনেকটাই সরে আসবে। সংবিধান পরিবর্তনের এই উদ্যোগ নিয়ে আরো আলোচনা আছে। পুতিন তাঁর ক্ষমতার মেয়াদ শেষের আগেই সংবিধানে আমূল পরিবর্তনের প্রস্তাব আনলেন। পুতিন নিজের পক্ষে সমর্থন ও ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্যই এ ধরনের কৌশল অবলম্বন করছেন বলে মনে করেন অনেকেই। সামনের সপ্তাহেই হয়তো বিষয়গুলো সংবিধানে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত পাস হয়ে যাবে। উল্লেখ্য যে, রাশিয়ার সংবিধান অনুযায়ী কেউ টানা দুই মেয়াদের বেশি প্রেসিডেন্ট পদে থাকতে পারেন না। অথচ ১৯৯৯ সাল থেকে পুতিন চারবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন দুইবার। ২০১২ সালে আবার প্রেসিডেন্ট পদে ফিরেই আইন প্রণেতাদের দিয়ে প্রেসিডেন্টের মেয়াদ চার বছর থেকে বাড়িয়ে ছয় বছর করিয়ে নেন পুতিন। বর্তমানে পুতিন টানা দ্বিতীয়বারের মত প্রেসিডেন্ট পদে আছেন। তাঁর মেয়াদ শেষ হবে ২০২৪ সালে। তাই প্রশ্ন জেগেছে, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার জন্য কি পুতিন এবার ক্ষমতা ছাড়বেন, নাকি সংবিধান পরিবর্তন করে আবার ক্ষমতাই থাকার চেষ্টা করবেন? সংবিধান পরিবর্তনের উদ্যোগ তো তিনি ইতোমধ্যে গ্রহণ করেছেন।

সংবিধান প্রয়োজনে সংশোধন করা যেতেই পারে। রাষ্ট্র ও জনগণের কল্যাণে সংবিধান পরিবর্তন করা হলে তা উত্তম কর্ম হিসেবেই বিবেচিত হবে। কিন্তু বর্তমান সভ্যতায় লক্ষণীয় বিষয় হলো, মুখে কল্যাণের খই ফুটলেও সংবিধান পরিবর্তনের পেছনে অনেক ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা যায় ব্যক্তি ও দলের ক্ষুদ্র স্বার্থ। পুতিনের কথাই ধরা যাক। সংবিধানে স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন এবং সমলিঙ্গে বিয়ের অধিকার না রাখার যে প্রস্তাব তিনি করেছেন তাতো ভালো বিষয়। কিন্তু এই সব ভালো ভালো প্রস্তাবের মতলব থাকে, আবার প্রেসিডেন্ট হবার কোনো কৌশল থাকে, তাহলো সেটাতো উত্তম কর্ম হিসেবে বিবেচিত নাও হতে পারে। এখানেই চলে আসে বিয়ত বা উদ্দেশ্যের প্রসঙ্গ, কথাও কাজে মিলের প্রসঙ্গ। বর্তমান সভ্যতা জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনেক এগিয়ে গেলেও পিছিয়ে আছে নীতি-নৈতিকতার প্রশ্নে। ফলে শান্তি, সভ্যতা। অথচ এই পৃথিবীতে একজন মানুষ এসে ছিলেন, যিনি কথাও কাজে মিল রেখেছেন। ফলে এমন এক সভ্যতা বিনির্মাণে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন- যেখানে শান্তি ছিল, স্বস্তি ছিল, ছিল নর-নারী নির্বিশেষে সব মানুষের মুক্তির নিশ্চয়তা। সেই মানুষটির কথা আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে হাউস অব কমন্সের আলোচনা সভায় এবার স্মরণ করলেন যুক্তরাজ্যের নারী ও সমতা বিষয়ক ছায়ামন্ত্রী নাজ শাহ। তিনি বলেন, নারী হিসেবে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-ই আমার অনুপ্রেরণা। বৃটিশ মুসলিম নারী নাজ শাহ লেবা পার্টি থেকে ব্র্যাডফোর্ড ওয়েস্টের সংসদ সদস্য। তিনি হাউস অক কমন্সে আরো বলেন, ১৯৩৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট হযরত মুহাম্মদ (সা.)কে বিশে^র সেরা বিধান দাতাদের একজন বলে আখ্যা দেন। আর সেই মুহাম্মদ (সা.)ই একমাত্র ব্যক্তি যার কাছ থেকে আমি অনুপ্রেরণা পেয়েছি। লেবার পার্টির এই এমপি বলেন, এমন একটা সময়ে মুহাম্মদ (সা.) পৃথিবীতে এসেছিলেন, যখন নারীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত করা হতো। নারীরা ছিলেন শোষিত, বঞ্চিত ও হত্যাকাণ্ডের শিকার। কন্যাশিশুদের জীবন্ত পুঁতে ফেলা হতো। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় মুহাম্মদ (সা.) এমন একটি সমাজ উপহার দেন; যেখানে নারীরা শুধু তাদের বেঁচে থাকার অধিকারই পায়নি- সম্পত্তি, বিয়ে, উত্তরাধিকার, ভোটপ্রদান, সম্মান, মর্যাদা এবং স্বাধীনতা সবই পেয়েছে। মুহাম্মদ (সা.)-এর পাশাপাশি ১২ জন নারীকেও কৃতজ্ঞতাচিত্তে স্মরণ করেন হাউস অব কমন্সে প্রতিনিধিত্বকারী নারী এমপি নাজশাহ।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসে হাউস অব কমন্সে নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় যে মহান নবী কাজ করে গেছেন, তাঁর কথা স্মরণ করলেন এমপি নাজশাহ। তিনি তো তাঁর দায়িত্ব পালন করলেন কিন্তু আমরা বিশ্বনবীকে কতটা স্মরণ করছি? নবীর নির্দেশনার আলোকে আমরা নারীর অধিকার ও মর্যাদা কতটা রক্ষা করছি? মুহাম্মদ (সা.) শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য রহমত স্বরূপ। এই সত্যটি উপলব্ধি করলে বর্তমান সভ্যতার অনেক সঙ্কটই দূর হতে পারে।

http://dailysangram.info/post/409679