২০ মার্চ ২০২০, শুক্রবার, ১২:১৭

কাজ শেষ না করেই ১৫৭ প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণা!

খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে -পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান * প্রকল্প পরিচালকদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত -ড. জাহিদ হোসেন

শতভাগ কাজ শেষ না করেই সমাপ্ত করা হয়েছে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ১৫৭টি উন্নয়ন প্রকল্প। এর মধ্যে শূন্য থেকে দুই শতাংশ অগ্রগতির প্রকল্পও রয়েছে।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩১২টি প্রকল্প শেষ হয়েছিল। এর মধ্যে শতভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে- এমন প্রকল্প সংখ্যা ১৫৫টি। বাকিগুলো বিভিন্ন পর্যায়ে শেষ করা হয়েছে।

বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এডিপি অগ্রগতি পর্যালোচনা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চিত্র। বৃহস্পতিবার এটি উপস্থাপন করা হয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) বৈঠকে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি চিন্তার। কেন এমন হচ্ছে, এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

তবে এটা অবাক করার মতো বিষয়। প্রকল্পের প্রকৃত লক্ষ্য পূরণ না করেই কাজ বাকি রেখে সমাপ্ত ঘোষণাকে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই বলে মনে করছেন বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন।

ড. জাহিদ যুগান্তরকে বলেন, লক্ষ্য পূরণ না করে প্রকল্প শেষ করার বিষয়ে প্রকল্প পরিচালকদের জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসা উচিত। কেননা ভৌত অবকাঠামো সংক্রান্ত কোনো প্রকল্প যদি ৮০ ভাগ করে সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়, সেটি পুরোপুরি কাজে লাগে না। অর্থের অপচয় হয়। আবার বাকি ২০ ভাগ কাজ শেষ করতে নতুন প্রকল্প নিতে হয়। এক্ষেত্রে নতুন প্রকল্পের কাজ হতে হতেই যে কাজটি আগে করা হয়েছে, সেটিও নষ্ট হয়ে যায়। ফলে আবারও অপচয় হয়। অপচয়ের দুষ্টচক্রে পড়ে যায় এসব প্রকল্প। এক্ষেত্রে জবাবদিহির বিকল্প নেই।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ১ হাজার ৯৭৬টি প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর মধ্যে ৩৪৬টি প্রকল্প ২০১৯ সালের জুনের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়, যা মোট প্রকল্পের ১৭ দশমিক ৫১ শতাংশ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লক্ষ্য পূরণ হয়নি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ২৪৫টি প্রকল্প শেষ হয়। অপরদিকে শেষ করার জন্য নির্ধারিত না থাকলেও ৬৭টি প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণা করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। এতে ওই অর্থবছরে সমাপ্ত প্রকল্পের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩১২টিতে।

আইএমইডির সচিব আবুল মনসুর মো. ফয়েজউল্লাহ যুগান্তরকে জানান, প্রধানমন্ত্রীর সামনে বই আকারে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়েছে। তিনি বিষয়গুলো শুনেছেন। এরকম প্রকল্পগুলোর বিষয়ে খতিয়ে দেখা হবে। তারপর জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসার উদ্যোগ নেব।

আইএমইডির প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বাংলাদেশ পুলিশের মনিটর সোশ্যাল মিডিয়া শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। এটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১২৫ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।

২০১৮ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৯ সালের এপ্রিলের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এক টাকাও খরচ হয়নি। বাস্তব অগ্রগতিও শূন্য। কিন্তু এরপরও প্রকল্পটি সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে।

এছাড়া কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার জন্য মাস্টারপ্ল্যান তৈরির প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয় ৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। ২০১৭ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৯ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য ছিল। প্রকল্পের আওতায় ব্যয় হয়েছে ৭ লাখ ৯২ হাজার টাকা।

এক্ষেত্রে আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে শূন্য দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং বাস্তব অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ২ শতাংশ। এ অবস্থায় এটি সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। পিপিপিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ের জন্য কারিগরি ও পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৭ কোটি ৮৮ লাখ টাকা।

২০১৩ সালের মার্চ থেকে ২০১৯ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা। শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটিতে ব্যয় হয় ৭৯ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এটির আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়ায় ৮০ দশমিক ৮৮ শতাংশ এবং বাস্তব অগ্রগতি হয় ৮০ দশমিক ৮৯ শতাংশ।

এ অবস্থায় প্রকল্পটি সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্ট ইন বাংলাদেশ প্রিপারেটরি ফ্যাসিলিটি নামের প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৯ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।
এর মধ্যে ব্যয় হয়েছে ২ কোটি ৬৫ লাখ ৯৩ হাজার টাকা। এক্ষেত্রে আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ২৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ আর বাস্তব অগ্রগতি ২৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ। এ অবস্থায় প্রকল্পটি সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, টেকনিক্যাল অ্যাসিসট্যান্ট টু ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথরিটি নামের প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা ছিল ৩৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকা।

এর মধ্যে বৈদেশিক অর্থায়ন ছিল ২৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের জুনের মধ্যে এটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য ছিল।

শেষ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছিল ২১ কোটি ২০ লাখ টাকা। আর্থিক অগ্রগতি হয়েছিল ৬৩ দশমিক ৬১ শতাংশ এবং বাস্তব অগ্রগতি দাঁড়ায় ৬৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এ অবস্থায় প্রকল্পটি সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে।

শতভাগ কাজ শেষ না হলেও সমাপ্ত ঘোষিত কয়েকটি প্রকল্প হল- প্রি-মুনসন ফ্লাড প্রটেকশন অ্যান্ড ড্রেইনেজ ইমপ্র“ভমেন্ট ইন হাওর এরিয়াস প্রকল্প। এছাড়া বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ ক্যাপাসিটি বিল্ডিং, বাখরাবাদ-সিদ্ধিরগঞ্জ গ্যাস ট্রান্সমিশন পাইপলাইন প্রজেক্ট, অ্যাগ্রিকালচার সাপোর্ট ফর স্মল হোল্ডার ইন সাউথ-ওয়েস্টার্ন রিজিওন অব বাংলাদেশ, এলজিইডির কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরির জন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, ইমপরট্যান্ট আরবান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট, রিহ্যাবিলিটেশন অব ওয়াটার সাপ্লাই সিস্টেম ইন রাজশাহী সিটি প্রজেক্ট এবং টেকনিক্যাল অ্যাসিসট্যান্ট টু মুভ ফরওয়ার্ড দ্য ইনিশিয়েটিভস অব নন-রেভিনিউ ওয়াটার রিডাকশন অ্যান্ড ইন্সটিটিউশনাল ডেভেলপমেন্ট অব চিটাগং ওয়াসা প্রকল্প। আরও কয়েকটি প্রকল্প হচ্ছে- নর্দান এরিয়াস রিডাকশন অব প্রভার্টি ইনিশিয়েটিভ (নারী), ঝিনাইদহ বিসিক শিল্প পার্ক স্থাপন, মৌলভীবাজারের শেরপুর অর্থনৈতিক অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহ প্রকল্প, দুধ এবং মাংস উৎপাদন বৃদ্ধি, নরসিংদীর শিবপুরে বন্যা প্রতিরোধ-ড্রেন উন্নয়ন এবং কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প, জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের নিরাপত্তা নিয়ে স্টাডি প্রকল্প এবং নীলফামারী-জলঢাকা সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/290912/