১৮ জানুয়ারি ২০২০, শনিবার, ১১:০১

দেশে ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাস ও ভূমিধসের আশঙ্কা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব

বাংলাদেশে চলতি ২০২০ এবং আগামী বছরের মধ্যে ভূমিধস, শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় এবং অস্বাভাবিক জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা রয়েছে। এ সময়ের মধ্যে এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ বছরে ৩ থেকে ১৫ বার আঘাত হানার আশঙ্কা রয়েছে। বায়ুমণ্ডলের পরিবর্তনের সাথে দিন দিন ঋতুচক্রও বদলে যাওয়াতে বায়ুমণ্ডলের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এর ফলে চলতি শতাব্দীর শেষে বাংলাদেশের উপকূল বরাবর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে। ফলে দেশে প্রবল ঘূর্ণিঝড়, অস্বাভাবিক জলোচ্ছ্বাস ও শিলাবৃষ্টি হতে পারে। সেই সাথে অতিরিক্ত তাপপ্রবাহেরও আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশের আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ ও যুক্তরাষ্ট্রের একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের গবেষণা প্রতিবেদনে এ আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে মৌসুমি জলবায়ুর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। এসব কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যায়। দারিদ্র্য পর্যবেক্ষণ সমীক্ষায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো উপকূলীয় অঞ্চলে দরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রা ঝুঁকিপ্রবণ হয়ে ওঠার পেছনে কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছে। এগুলোর মধ্যে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিক্ষয়, লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতা ও অতিবৃষ্টি অন্যতম।

১৮৯১ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ১০০ বছরে ছোট-বড় প্রায় ৭০০টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে উপকূলে। এর মধ্যে ১৯২টি ঘূর্ণিঝড় মৌসুমি-উত্তর ঋতুতে হয়। অন্য দিকে ১৭৯৩ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষতি করেছে এমন ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা ৪৫টি। এ প্রবণতা থেকেই ঘূর্ণিঝড়ের মাত্রা বৃদ্ধির প্রমাণ মেলে।

ইউএনডিপির ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি কমানো উন্নয়নের জন্য চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এশিয়ার মধ্যে ঘূর্ণিঝড়ের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। ১৯৮০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ২০ বছরে বিশে^ ঘূর্ণিঝড়ে মারা গেছে আড়াই লাখ মানুষ, যার ৬০ শতাংশই বাংলাদেশের।

বিরাজমান পরিস্থিতিতে আবহাওয়া অধিদফতরের আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক জানান, গ্লোবাল উষ্ণায়নের কারণে দিন দিন বায়ুমণ্ডলের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। তাই ঋতুর স্বাভাবিকতা থাকছে না। তারই প্রভাবে দেশে সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়, শিলাবৃষ্টি, অতিরিক্ত তাপপ্রবাহ পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ ছাড়া কালবৈশাখীর ছোবল, ভারী-হালকা বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, খরা বজ্রঝড়ের সংখ্যাও বাড়ছে। মৌসুমি বায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন অতিভারী বৃষ্টি আবার কখনো হালকা বৃষ্টিপাত বাড়ছে।

তার মতে, শীতকালে আগে টানা কুয়াশা পড়লেও তা পরিবর্তিত হয়ে এখন কমে গেছে। সেই সাথে কমছে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ। এ ছাড়া পরিবর্তন এসেছে তাপপ্রবাহে। এসব কারণেই এ বছরেও দেশে ভূমিধস, তীব্র ঘূর্ণিঝড় ও অস্বাভাবিক জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা রয়েছে।

অন্য দিকে মার্কিন গবেষকের আশঙ্কাÑ ভবিষ্যতে ভয়ঙ্কর ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের নিয়মিত শিকার হবে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির কৃষি, পরিবেশ এবং উন্নয়ন অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জয়েস জে চেন তার গবেষণা প্রতিবেদনে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে এমন তথ্য তুলে ধরেছেন। তিনি জলবায়ু পরিবর্তন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্যের জটিল সম্পর্কের ওপর গবেষণা করছেন। বাংলাদেশ বিষয়ে তার মতামত নিয়ে গত বছরের সেপ্টেম্বরে বিবিসির এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য তুলে ধরা হয়।

জয়েস জে চেনের মতে, জলোচ্ছ্বাস এখন বাংলাদেশে প্রতি দশকে একবার করে আঘাত হানছে। ২১০০ সালের মধ্যে তা প্রতি বছর ৩ থেকে ১৫ বার নিয়মিত আঘাত হানার আশঙ্কা রয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের প্রথাগত জীবনযাপন অসম্ভব হয়ে পড়েছে। পরিবেশের চরম অবস্থা তাদের যে দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তাতে যে কারো সহিষ্ণুতার মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে। প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি শতাব্দীর শেষে, বাংলাদেশের উপকূল বরাবর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ দশমিক ৫ মিটার বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। ২১০০ সালের মধ্যে প্রতি বছর ৩ থেকে ১৫ বার নিয়মিত সর্বনাশা ঝড় ও অস্বাভাবিক উচ্চতার জোয়ারের শিকার হতে পারে বাংলাদেশ।

জয়েস জে চেন বলেন, জলবায়ু এত বেশি প্রতিকূল হয়ে উঠছে যে লোকজনের স্থানান্তর বা অভিবাসনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতি বছর আনুমানিক এক লাখ লোক বন্যার কারণে স্থানান্তরিত হচ্ছে। তার মতে, বাংলাদেশে দুই ধরনের অভিবাসন ঘটতে দেখা যায়। কেউ ভালো সুযোগের আশায় শহরমুখী হন। কেউ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাড়ি ছাড়েন। নিচু এলাকা হিসেবে বাংলাদেশ সব সময় সমুদ্রপৃষ্ঠের পরিবর্তনজনিত কারণে ঝুঁকিতে রয়েছে।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/473112/