২৬ ডিসেম্বর ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৩:৪৩

পাটকল নিয়ে বেকায়দায় সরকার: লোকসানের চক্করে ২৫ সরকারি পাটকল

৮ বছরে লোকসান ৪ হাজার কোটি টাকা * ১৭৪০ কোটি টাকা চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাট মন্ত্রণালয়ের

লোকসানের বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের পাটকলগুলো। অনেক আশা নিয়ে বর্তমান সরকার পাটশিল্পের পুনরুজ্জীবনে নানা পদক্ষেপ নিলেও লোকসানের বৃত্ত থেকে বেরোতে পারছে না।

গত ৮ (২০১১-১৮) বছরে পাটকলগুলোর লোকসান দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার কোটি টাকা। ফলে বকেয়া বেতনের দাবিতে মাঝে মাঝেই রাজপথ কাঁপাচ্ছেন শ্রমিকরা। উত্তপ্ত হয়ে উঠছে গোটা দেশ। সারা দেশে চালু ২৫টি পাটকলের ২৫ হাজার ৬১৯ জন স্থায়ী শ্রমিকের বকেয়া বেতন-ভাতায় বছরে গুনতে হচ্ছে কয়েকশ’ কোটি টাকা।

নভেম্বর থেকে মজুরি কমিশন বাস্তবায়ন, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) ব্যবস্থা বাতিলসহ ১১ দফা দাবিতে এখন মাঠে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ সংগ্রাম ঐক্য পরিষদ।

উৎপাদন বন্ধ রেখে নানা কর্মসূচিতে ব্যস্ত আছেন শ্রমিকরা। পরিস্থিতি সামাল দিতে বেতন-ভাতাসহ কাঁচা পাট ক্রয়ে এক হাজার ৭৪০ কোটি টাকা চেয়ে অর্থ বিভাগে চিঠি দিয়েছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়।

কথা হয় বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, পাটকল শ্রমিকরা তাদের মজুরি কমিশনসহ ১১ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলন করছে। শুধু মজুরি কমিশন বাস্তবায়ন করতেই দুই হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন।

তাদের সব দাবি মানতে হলে কয়েক হাজার কোটি টাকা লাগবে। এত টাকা দিতে পারবে কি না, তা বলতে পারবে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ মাসেই গত ৪ মাসের বকেয়া বেতন-ভাতা বাবদ ১০০ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে। সুনির্দিষ্ট অঙ্ক না জানাতে পারলেও সম্প্রতি আরও কয়েকশ’ কোটি টাকা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে চাওয়া হয়েছে বলে জানান পাটমন্ত্রী।

সূত্র বলছে, সম্প্রতি শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি, বেতন-ভাতা পরিশোধ ও কাঁচা পাট কেনার জন্য এক হাজার ৭৪০ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এ সংক্রান্ত চিঠিতে বলা হয়েছে- রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল, বকেয়া মজুরি, বেতন-ভাতা পরিশোধসহ নানা দাবিতে গত ২৩ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত নানা কর্মসূচি পালন করে।

বাংলাদেশ জুট মিল কর্পোরেশন (বিজেএমসি) বলছে, শ্রমিক-কর্মচারীদের বকেয়া বেতন ভাতা ও বিভিন্ন পাওনা জরুরি ভিত্তিতে পরিশোধ করা প্রয়োজন। বর্তমানে এসব শ্রমিক কর্মচারীদের ১০-১১ সপ্তাহ পর্যন্ত মজুরি ও বেতন বাকি আছে।

গত অক্টোবর পর্যন্ত বকেয়া বেতন-ভাতা বাবদ ১০৩ কোটি টাকা, ডিসেম্বর পর্যন্ত ২২৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা এবং আগামী বছরের মার্চ পর্যন্ত এ খাতে প্রয়োজন ৪১২ কোটি ২৭ লাখ টাকা।

এ ছাড়া কাঁচা পাট কেনার জন্য এক হাজার কোটি টাকা আবর্তক তহবিল হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে চাওয়া হয়েছে। আগামী মার্চ পর্যন্ত বেতন-ভাতা খাতে আরও ৪১২ কোটি ২৭ লাখ টাকা জরুরি ভিত্তিতে ছাড় করতে বলা হয়েছে চিঠিতে।

সূত্র বলছে, এ পর্যন্ত মাত্র ১০০ কোটি টাকা পাওয়া গেছে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে। ওই অর্থ দিয়ে গত অক্টোবর পর্যন্ত কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হয়েছে।

জানতে চাইলে পাটকল শ্রমিক লীগের সিনিয়র সহসভাপতি মাহবুব আলম জানান, পাটকলগুলোর শ্রমিক-কর্মচারীদের সমস্যার অন্ত নেই। প্রতিবছর এ খাতে সরকারের খরচ আছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। এখনও সরকারের ঘোষিত মজুরি কমিশন বাস্তবায়ন হয়নি। শুনেছি পাট মন্ত্রণালয় থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে বিজেএমসির অধীন রাষ্ট্রায়ত্ত ২৫টি পাটকলে স্থায়ী শ্রমিক আছে ২৫ হাজার ৫১৯ জন। বদলি তালিকাভুক্ত শ্রমিক ২২ হাজার ৯৯৮ জন। দৈনিকভিত্তিক তালিকাভুক্ত শ্রমিক ৪ হাজার ৯১০ জন। এসব মিলে বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে কাজ করে ২৭ হাজার ৯৫৭ জন শ্রমিক।

এসব শ্রমিকের জন্য ২০১৫ সালের মজুরি কমিশন গঠিত হলেও তা অদ্যাবধি বাস্তবায়ন করা হয়নি। এখনও তারা ২০১০ সালের বেতন কাঠামোতেই বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। এরপরও মাসের পর মাস বাকিই থাকছে।

২০১১-১২ অর্থবছরে বিজেএমসির লোকসান ছিল ৭৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এরপর ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৩৯৬ কোটি ৯৭ লাখ টাকা, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৫১৩ কোটি ৮ লাখ টাকা, পরের অর্থবছরে ৭২৯ কোটি টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৬৬৯ কোটি ২০ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে।

এ ছাড়া ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪৮১ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪৯৭ কোটি ১৮ লাখ টাকা এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫৭৩ কোটি ৫৮ লাখ টাকা লোকসান হয়।

লাভজনক না হওয়ায় পাটকল শ্রমিকদের প্রতি সরকারের অবহেলা রয়েছে বলে অভিযোগ শ্রমিক নেতাদের। এরই জেরে গত ১৭ নভেম্বর ১১ দফা দাবিতে ৬ দিনের কর্মসূচির ডাক দেয় রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদ।

দাবির মধ্যে রয়েছে- বকেয়া মজুরি পরিশোধ, পিচ রেটে (ঘণ্টা অনুযায়ী) মজুরি দেয়া, বকেয়া থাকা অবসর ও মৃত্যু বীমার টাকা পরিশোধ, নিজ নিজ মিলের পিএফ ফান্ডের টাকা আবার ওই ফান্ডে ফেরত দেয়া, মৃত্যুজনিত শ্রমিকদের বীমা দাবি ৩৬ মাস হিসেবে পরিশোধ করা, টার্মিনেশন ও বরখাস্ত সব শ্রমিক-কর্মচারীকে পুনর্বহাল করা, বদলি শ্রমিকদের স্থায়ী করা, চাহিদা অনুযায়ী পাটের মৌসুমে পাট কেনার জন্য মিলগুলোকে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দেয়া, পাটশিল্পকে কৃষিশিল্পে রূপান্তর করা, মিলগুলোর আধুনিকায়ন করা ইত্যাদি।

পাটকল শ্রমিকদের এসব দাবি বাস্তবায়নের দাবিতে গত ২৫ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া কর্মসূচি আমরণ অনশনে রূপ নেয় ১০ ডিসেম্বর। এতে অসুস্থ হয়ে ১২ ডিসেম্বর মারা যান এজন শ্রমিক।

গত ১৩ ডিসেম্বর ৩ দিনের জন্য কর্মসূচি স্থগিত করা হয়। পরে দ্বিতীয় দফায় ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় নেয়া হয়। পরে তা ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। দাবি বাস্তবায়ন না হলে ২৯ ডিসেম্বর থেকে আমরণ অনশন শুরুর হুশিয়ারি রয়েছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/259689/