১৬ নভেম্বর ২০১৯, শনিবার, ২:০০

বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালে ৩২৫ কোটি টাকা বেহাত

উন্নত ও ভালো চিকিৎসা পেতে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশ থেকে রোগীরা ভিড় করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে। তারা এখানে টিকিট কেটে ও ফি দিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখায়, নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করায়। সেসব অর্থ ইউজার ফি হিসেবে জমা হওয়ার কথা বিশেষ তহবিলে। সেখান থেকে হাসপাতালের সব খরচ সেরে অবশিষ্ট লভ্যাংশের ৩০ শতাংশ পাওয়ার কথা ঝুঁকিপূর্ণ বিভাগগুলোতে কাজ করা চিকিৎসক-কর্মচারীদের। কিন্তু নিয়মের তোয়াক্কা না করে মোট আয় থেকেই ৩০ শতাংশ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এখানকার চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

দেশের চিকিৎসা খাতের সবচেয়ে বড় ও উন্নত এই বিদ্যাপীঠে এমন ঘটনা ঘটেছে প্রায় ১২ বছর ধরে। কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে কেবল হাতিয়ে নেওয়া অতিরিক্ত অর্থ ফেরত দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে; এক বছরেই যে টাকার পরিমাণ প্রায় ১২ কোটি হয় বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

কেবল তাই নয়, সর্বশেষ সরকারি নিরীক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ে গত এক অর্থবছরেই সব মিলিয়ে প্রায় ৩২৫ কোটি টাকার অনিয়ম ধরা পড়েছে। যে অনিয়মের প্রতিবেদন এরই মধ্যে জমা দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে।

এদিকে এসব বিষয় ধরা পড়ার পর নড়েচড়ে বসেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তারা ভেতরে ভেতরে হিসাব শুরু করেছে কে কোথা থেকে কিভাবে কত টাকা বেহাত করেছে। সে অনুসারে তারা হাতিয়ে নেওয়া অর্থ দ্রুত ফেরত দেওয়ারও নোটিশ দিয়েছে। অতিরিক্ত টাকা ফেরত দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল হান্নান গত ১৯ অক্টোবর অফিস আদেশও জারি করেছেন।

বিএসএমএমইউর কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যে তালিকা করা হচ্ছে তাতে নামিদামি অনেক অধ্যাপক, সাবেক একাধিক উপাচার্য, উপ-উপাচার্যসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। এ ক্ষেত্রে অধ্যাপক পর্যায়ের একেকজন বছরে ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা করে নিয়েছেন। শুধু মাইক্রোবায়োলজি, ভাইরোলজি, মলিকুলার বায়োলজি অ্যান্ড বায়োকেমেস্ট্রি বিভাগই নয়; অন্য সব বিভাগেরই চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিভিন্ন হারে বিধিবহির্ভূতভাবে ইউজার ফির ভাগ নিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে সাধারণ বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিয়েছেন ১০ শতাংশ করে, যাঁরা আদৌ ইউজার ভাতা পাওয়ার কথা নয়। অন্যদিকে মাইক্রোবায়োলজি, ভাইরোলজি, মলিকুলার বায়োলজি অ্যান্ড বায়োকেমেস্ট্রি বিভাগের যাঁরা মোট আয়ের ওপর ৩০ শতাংশ নিয়েছেন, তাঁরা যার যার ভাগের অতিরিক্ত অর্থ ফেরত দেবেন। তবে এই শ্রেণির সবাই এখন টাকা ফেরত দেওয়ার শাস্তি এড়ানোর পথ খুঁজছেন। আর প্রাথমিক হিসাব অনুসারে কেবল ইউজার ফি বাবদই প্রায় ৯০ কোটি টাকা ফেরত দিতে হতে পারে।

নিরীক্ষা বিভাগের নথি থেকে জানা যায়, বিএসএমএমইউতে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৩০টি খাতে প্রায় ৩২৫ কোটি টাকার অনিয়ম পাওয়া গেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত নিরীক্ষাকালে নিরীক্ষকদল দেখতে পায় যে বেশ কয়েকটি প্রকল্পের আওতায় কেনাকাটার কোনো ভাউচার নেই। আবার বিদেশি অতিথিদের উপস্থিতিতে বিভিন্ন আয়োজনের বিপরীতে ব্যয়ের হিসাব দিলেও কোন অতিথির জন্য কত টাকা ব্যয় হয়েছে এবং তাঁরা কোথায় ছিলেন এর কোনো বিল-ভাউচার নেই। এমনকি জন্মগত হৃদেরাগীদের চিকিৎসার তহবিল থেকে খরচের হিসাবেও গরমিল রয়েছে। অনেক বিভাগের টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল তহবিলে জমা না দিয়ে নিজ নিজ বিভাগীয় হিসাবেই রেখে দেওয়া হয়েছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো নথি থেকে জানা যায়, ইউজার ফিসহ আরো কয়েকটি খাতের প্রায় ১২৮ কোটি টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল তহবিলে জমা হয়নি। এ ছাড়া প্রায় ৪৫ কোটি টাকা কম জমা দেওয়া হয়েছে কোনো কোনো তহবিলে। প্রায় ৪৮ কোটি টাকার সঠিক বিল-ভাউচার নেই। এমন ঘটনাও আছে, যেখানে কাজ না করেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বিল দেওয়া হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত ছাড়াই ১০ কোটি টাকা দুই ইউনিটের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বণ্টন করা হয়েছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইউনিটের টাকা খরচের ক্ষেত্রেও অনিয়ম পেয়েছে অডিট টিম। টাকার নয়ছয় হয়েছে গবেষণাগারেও। সেখান থেকে প্রায় আড়াই কোটি টাকা স্থানান্তর হয়েছে অনিয়মের মাধ্যমে। ক্রয় বিধি অমান্য করে খরচ করা হয়েছে প্রায় ২০ কোটি টাকা। অনিয়মিত কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ খরচের বিপরীতে কোনো রেজিস্টার বা স্বাক্ষর দেখাতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।

রেজিস্ট্রার এ বি এম আব্দুল হান্নান এ ব্যাপারে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অডিট আপত্তি একটি চলমান প্রক্রিয়া। আমরা সেই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এগোচ্ছি। ইউজার ফি নিয়ে জটিলতা অনেক দিন আগের। গত বছর কয়েকটি বিভাগ থেকে বিষয়টি নিয়ে আদালতে যাওয়ার পর এ নিয়ে নতুন করে জটিলতা তৈরি হয়।’

আব্দুল হান্নান আরো বলেন, ‘এখন আদালতের নির্দেশ মেনে আমরা কাজ শুরু করেছি। কার কাছে কত টাকা পাওনা তা হিসাব করা হচ্ছে। তবে প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ। কেননা বিষয়টি ২০০৭ সাল থেকে হিসাব করতে হবে। আবার এর মধ্যে অনেকেই চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। অনেককে যে পরিমাণ টাকা ফেরত দিতে হবে তা তার পেনশনের টাকার কয়েক গুণ বেশি। আর এমন লোকের সংখ্যাও কম নয়।’

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব (সেবা) আসাদুল ইসলাম গতকাল বৃহস্পতিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঘটনাটির সঙ্গে সেবা খাতের কিছু বিষয় জড়িত থাকলেও এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় হওয়ায় বিষয়টি দেখছে শিক্ষা বিভাগ (স্বাস্থ্য)।’

স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব (আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও অডিট) ফেরদৌস আলম বলেন, ‘অডিট আপত্তির জবাব সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিরা সঠিকভাবে দিতে না পারলে তাঁদের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয় যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। এ ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ে অর্থ ফেরত দিলে অভিযুক্ত ব্যক্তি শাস্তির বাইরে থাকতে পারেন। তবে সব খাতের ক্ষেত্রে সেটা প্রযোজ্য হবে না। কোনো কোনো খাতের টাকা পরে ফেরত দিলেও সেটা দুর্নীতির পর্যায়েই পড়বে। আবার কোনো কাজ না করে বিল করাটাও দুর্নীতি।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2019/11/16/839733