ক্যাসিনো বন্ধে গতকালও মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় অভিযান চালানো হয়। মোহামেডান ক্লাবে অভিযানের দৃশ্য। ছবি : কালের কণ্ঠ
২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯, সোমবার, ১:০৪

মতিঝিলে চার ক্লাবে একযোগে অভিযান

পুলিশের সহায়তায় পালায় বিদেশি জুয়াড়িরা!

বিপুল ক্যাসিনো সরঞ্জাম জব্দ ►কর্মকর্তারা আগেই পালিয়ে যান

ক্লাবগুলোতে ক্যাসিনোর আসর বন্ধের চলমান অভিযানে গতকাল রবিবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে মোহামেডান ক্লাব ঘিরে ফেলে পুলিশ। এ অবস্থায় ক্লাবে ঢুকতেই চোখে পড়ে বিশাল বোর্ডরুম। ক্লাবটির উন্নয়নে মিটিং করার জন্য নির্ধারিত এ কক্ষে জুয়ার আসর যে বসত তা স্পষ্ট। কক্ষজুড়ে জুয়ার সামগ্রী। দেশের ঐতিহ্যবাহী এই ক্লাবের কোথাও তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাওয়া যায়নি খেলার কোনো সামগ্রী। দামি সোফা, কারুকার্যখচিত বড় বড় ক্যাসিনো টেবিলে এলোমেলোভাবে রাখা ছিল জুয়ার বোর্ড, মদের বোতলসহ বিভিন্ন বাহারি আহারসামগ্রী। দেয়ালে টানানো টিভি।

অভিযানের সময় ক্লাবটির কোনো কর্মকর্তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এক সাংবাদিক অভিযানের সময় বলে ওঠেন, ‘যে ক্লাবটি নিয়ে আমাদের এত অহংকার, সেটার পুরোটায় ক্যাসিনো সামগ্রী, কিন্তু নেই কোনো ফুটবল, ক্রিকেট ব্যাট।’ হাতের বাঁ পাশে তাকাতেই চোখে পড়ে একটি সুসজ্জিত কক্ষ। সেখানে নতুন একটি ক্যাসিনো বোর্ড। এর চারপাশে দামি সোফা। কক্ষটির ওপরের দেয়ালে ঝুলছিল দামি বাতি। এর পাশের কক্ষে ঢুকেও পাওয়া গেল ক্যাসিনো বোর্ডসহ জুয়ার সরঞ্জাম। সেখান থেকে ক্যাশ কাউন্টারে ঢুকে দেখা যায়, তাস ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। চেয়ার-টেবিল সব এলোমেলো। এর পাশেই রয়েছে একটি স্টোর রুম।

এখানেও মদের বোতলসহ বিভিন্ন ক্যাসিনো সরঞ্জাম। ওয়াশরুমগুলোতে ছড়িয়ে রয়েছে জুয়ার কড়ি। এরপর চোখে পড়ে একটি গোপন কক্ষ। সেখানেও জুয়ার সরঞ্জাম। ভিক্টোরিয়া ক্লাবের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুখে চোখে পড়ে টেবিলের ওপর থরে থরে সাজানো তাস। পাশাপাশি রয়েছে খোলা তাসের প্যাকেট ও তাসের অসংখ্য বান্ডেল এবং তার পাশেই একটি মদের বোতল। তার পাশের অন্য একটি টেবিলে রয়েছে ক্যাসিনোর কয়েন।

গতকাল রাজধানীর মতিঝিল এলাকায় অবস্থিত মোহামেডানসহ চারটি ক্লাবে একযোগে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। অন্য তিনটি ক্লাব হচ্ছে ভিক্টোরিয়া, আরামবাগ ও দিলাকুশা। সব ক্লাবেই ঢুকে একই চিত্র চোখে পড়ে। ক্লাবগুলো থেকে ক্যাসিনো তথা জুয়ার বিপুল পরিমাণ সরঞ্জাম জব্দ করা হয়েছে। অভিযানের সময় সঙ্গে ছিল ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)।

এদিকে মতিঝিলে প্রথম দফায় অভিযানের সময় বিদেশী জুয়ারীদের পালিয়ে যেতে সহায়তার অভিযোগ উঠেছে পুলিশের কতিপয় সদস্যের বিরুদ্ধে। ওই এলাকায় নেপালের নাগরিকসহ ১৯জন বিদেশী জুয়ারী ছিলেন, যারা অভিযানের সময় গ্রেপ্তার এড়িয়ে সটকে পড়েছিল।

গতকালের অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া ডিএমপির মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) আনোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ক্লাবগুলো থেকে টাকা, মদ, সিসা, ক্যাসিনো ও জুয়ার সামগ্রী জব্দ করা হয়েছে। চারটি ক্লাবেই ক্যাসিনো ও জুয়ার সামগ্রী পাওয়া গেছে।’

এত দিন কেন অভিযান চালানো হয়নি—প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এর আগেও এ এলাকার কয়েকটি বহুতল ভবনে ক্যাসিনো বারে অভিযান চালিয়ে সরঞ্জাম জব্দ করা হয়েছিল। তবে এর আগে আমাদের কাছে ক্লাবগুলোতে ক্যাসিনো সরঞ্জামের বিষয়ে কোনো গোয়েন্দা তথ্য ছিল না। তথ্য পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে এত বড় পরিসরে হয়নি।’ মতিঝিল থানার ওসি ওমর ফারুক বলেন, ক্যাসিনোর ব্যাপারে তিনি উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে আগে জানিয়েছেন।

বিপুল সরঞ্জাম উদ্ধার

অভিযানে মোহামেডান ক্লাব থেকে দুটি রুলেট টেবিল, ৯টি বোর্ড, বিপুল পরিমাণ কার্ড, ১১টি ওয়্যারলেস সেট ও ১০টি বিভিন্ন ধরনের চাকুসহ বিপুল পরিমাণ জুয়ার সামগ্রী জব্দ করা হয়েছে। ভিক্টোরিয়া ক্লাব থেকে একটি বড় টেবিল, বিভিন্ন ধরনের জুয়া খেলার ৯টি বোর্ড, চেয়ার, সোফা, ক্যাসিনো কয়েন, বোর্ডসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম, এক লাখ টাকা, বিপুল পরিমাণ তাস, জুয়ায় ব্যবহৃত চিপস ও মদ জব্দ করা হয়েছে। আরামবাগ ও দিলকুশা ক্লাবেও বাকারা ও রুলেটসহ বিভিন্ন জুয়ার সরঞ্জাম পেয়েছে পুলিশ।

ক্লাবের আশপাশের দোকানদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিকেলে ক্লাবপাড়ায় অভিযান চালানো হবে বলে খবর আগেই ছড়িয়ে পড়ে। ক্লাবের হোতারা পুলিশ আসার আগেই পালিয়ে যায়।

পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে র‌্যাব ও পুলিশ সূত্র জানায়, গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ফকিরেরপুল ইয়ংমেন্স ক্লাব ও ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের ক্যাসিনোতে র‌্যাবের আকস্মিক অভিযানের পর থেকেই আরামবাগ, দিলকুশা, ভিক্টোরিয়া ও মোহামেডান ক্লাবের ক্যাসিনো ছিল বন্ধ। গতকালও পুলিশ বন্ধ ক্যাসিনোর তালা ভেঙে সেখান থেকে সরঞ্জাম জব্দ করে। ওই এলাকায় ৯ জন নেপালের বড় জুয়াড়িসহ ১৯ জন বিদেশি জুয়াড়ির তথ্য মিলেছে। এরা কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। অথচ এরা ক্লাবের আশপাশের বাড়িতে ভাড়া থাকত। অভিযানের সময় কয়েকজন পুলিশ সদস্য তাদের বাসায় গিয়ে খবর জানিয়ে পালাতে সাহায্য করে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজে এমনই তথ্য পেয়েছেন তদন্তকারীরা। গোপন খবর দিয়ে ওই পুলিশ সদস্যরা মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছেন বলেও জানিয়েছে সূত্র। কয়েকজনকে ব্যাগ হাতে বাসা থেকে বের হতে দেখা গেছে। এসব পুলিশ সদস্যকে শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।

অভিজাত এলাকায় এখনো চলছে

অভিযানের ভয়ে মতিঝিল ও পল্টন এলাকার বেশির ভাগ ক্লাবে জুয়ার সরঞ্জাম সরিয়ে তালা ঝুলিয়েছে কর্তৃপক্ষ। দু-একটি খোলা থাকলেও সেখানে ক্লাব কর্তৃপক্ষসহ অন্য কাউকে দেখা যায়নি। র‌্যাব পুলিশের তালিকা অনুযায়ী, মতিঝিল এলাকায় মোট ১২টি ক্লাব রয়েছে। এর মধ্যে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাব, সোনালী অতীত ক্লাব, আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, ভিক্টোরিয়া, আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব, ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাবে নিয়মিত জুয়ার আসর চলত। এ ছাড়া পল্টনের ঢাকা রেস্টুরেন্ট ও রিক্রিয়েশন সেন্টারে জুয়ার আসর ছিল। গতকাল চারটি ক্লাবে অভিযান চালালেও অন্যগুলোতে অভিযান চালানো হয়নি। এদিকে অভিজাত এলাকা গুলশান ও বনানীতে অনেক ক্লাবে ‘জুয়া’র আসর এখনো চলছে। তবে পুলিশের দাবি, সব ক্লাবেই যে জুয়া বা ক্যাসিনো বা অনৈতিক কাজ চলে তেমন নয়।

র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বলেন, ‘ক্লাবগুলো এখন শুধু নামেই চলে, বাস্তবে ক্লাবগুলোতে কোনো ক্রীড়াসামগ্রী বা কোনো খেলোয়াড়কে দেখা যায়নি। ক্লাবের কক্ষগুলোতে ক্যাসিনো, ডার্ট বোর্ডসহ জুয়াসামগ্রী মদ বিয়ার ছাড়া খেলার সামগ্রী নেই।’

বেশির ভাগ স্টাফ বান্দরবানের

গতকাল অভিযান চালানো ক্লাবগুলোতে দুই শিফটে যেসব কর্মচারী কাজ করত তাদের বেশির ভাগ বান্দরবান ও রাঙামাটির বাসিন্দা। সেখানে চাকরিপ্রার্থীদের সিভি থেকে এ তথ্য পায় পুলিশ। ক্যাসিনো চালাতে নেপালি নাগরিকদের পাশাপাশি খরচ কমাতে পার্বত্য জেলার তরুণ-তরুণীদের পাশাপাশি উপজাতিদেরও কাজে লাগায় ক্লাব কর্তৃপক্ষ। মোহামেডান ক্লাবের কাগজপত্র যাচাই করে দেখা যায়, তাদের কেউ এসএসসি পাস। আবার কেউ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। ক্যাসিনোতে কাজ করা তরুণীদের ডিউটি থাকত রাতে।

গুলশানের স্পা সেন্টারে অভিযান

গত রাতে গুলশানের নাভানা টাওয়ারের ১৮, ১৯ ও ২০ তলায় তিনটি স্পা সেন্টারে অভিযান চালিয়ে ১৬ নারী ও তিন পুরুষকে আটক করেছে গুলশান থানা-পুলিশ। স্পা সেন্টারগুলো হলো লাইভ স্টাইল হেলথ ক্লাব অ্যান্ড স্পা অ্যান্ড সুেলন, ম্যাঙ্গো স্পা ও রেডিডেন্স সেলুন-২ অ্যান্ড স্পা।

ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান বিভাগের ডিসি সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বলেন, ‘আমাদের কাছে অভিযোগ আছে, সেখানে স্পার পাশাপাশি অসামাজিক কার্যক্রম পরিচালনা হয়।’

প্রসঙ্গত, গত ১৮ সেপ্টেম্বর র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন ঢাকা দক্ষিণ মহানগর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। অস্ত্র ও মাদকের দুই মামলায় তাঁকে সাত দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। এর আগে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কয়েকজন নেতার বিষয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর পরই ছাত্রলীগের পদ হারান শোভন-রাব্বানী। এরপর আটক হন খালেদ। শুক্রবার যুবলীগের নেতা জি কে শামীমকে সাত দেহরক্ষীসহ নিকেতনের নিজ কার্যালয় থেকে আটক করে র‌্যাব। উদ্ধার হয় কয়েকটি আগ্নেয়াস্ত্র ও মাদক। জব্দ করা হয় এক কোটি ৮০ লাখ নগদ টাকা, ১৬৫ কোটি টাকার ওপর এফডিআর (স্থায়ী আমানত)। শুক্রবার রাতেই কলাবাগান ক্রীড়াচক্র ক্লাবে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয় ক্লাবটির সভাপতি শফিকুল আলম ফিরোজকে। তাঁর কাছ থেকে সাত প্যাকেট গন্ধহীন হলুদ রঙের ইয়াবাসহ অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়। ওই রাতেই ধানমণ্ডি ক্লাবে অভিযান চালিয়ে সেখানকার বারটি সিলগালা করে দেন র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2019/09/23/817797