২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯, শুক্রবার, ১২:০৩

শেয়ারবাজারে টানা দরপতন: বিপর্যয় ঠেকানোর সব উদ্যোগ ব্যর্থ

পুঁজি হারানোর আতঙ্কের নাম দেশের শেয়ারবাজার। কোনো উদ্যোগেই এ বাজারে রক্তক্ষরণ বন্ধ হচ্ছে না। প্রতিদিনই উধাও হয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার বাজার মূলধন।

গত ৫০ কার্যদিবসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজার মূলধন ৩২ হাজার কোটি টাকা কমেছে। সর্বশেষ বাজার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে সরকারের নীতি-নির্ধারকরা বৈঠক করে বিভিন্ন আশ্বাস দেয়ার পরও টানা পতন চলছেই।

সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার শীর্ষ লেনদেন হওয়া দুটি কোম্পানি ছিল ক্রেতাশূন্য। পুরো বাজারেই এর প্রভাব পড়ছে। আর নেপথ্যে রয়েছে বড় কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউসের কারসাজি।

এর মধ্যে চলতি সপ্তাহে বেপরোয়াভাবে বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ফোর্সড সেল (জোরপূর্বক বিক্রি) করেছে ইউসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট। অন্যদিকে ফোর্সড সেল বন্ধের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাজারের মূল সমস্যা- সুশাসনের অভাব। দীর্ঘদিন থেকে এ সমস্যা চলতে থাকায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। সামগ্রিকভাবে শেয়ারের প্রতি নেতিবাচক ধারণা রয়েছে দেশের মানুষের। জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বাজারে চাহিদার দিক থেকে সংকট হল- বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট। আর সরবরাহের দিক থেকে সংকট হল- এখানে খুব বেশি ভালো কোম্পানি নেই।

সামগ্রিকভাবে বাজারে সুশাসনের অভাব। ফলে দীর্ঘদিন থেকেই একটি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে শেয়ারবাজার। তিনি বলেন, সংকট কাটাতে সরকার ও বিএসইসিকে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। আইন লঙ্ঘন করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। অর্থাৎ বিনিয়োগকারীদের বার্তা দিতে হবে- কারসাজির মাধ্যমে কেউ তাদের পুঁজি হাতিয়ে নিলে তার বিচার হবে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বড় ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংক এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসের ইক্যুইটি নেতিবাচক। কোনো হাউসের কাছেই শেয়ার কেনার মতো টাকা নেই। এছাড়া আইসিবিসহ প্রতিষ্ঠানগুলোর বাজারে সাপোর্ট দেয়ার সক্ষমতা নেই। শেয়ারবাজারে এটি ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এরপর ফোর্সড সেল দিয়ে ব্রোকারেজ হাউসগুলোর বাজারে আতঙ্ক তৈরি করেছে।

ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে শেয়ার সংরক্ষণকারী কোম্পানি সিডিবিএল ও ডিএসইর সার্ভিলেন্স সূত্রে জানা গেছে, বিনিয়োগকারীদের ব্যাপকভাবে ফোর্সড সেল করছে ইউসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট।

বৃহস্পতিবার বাজারে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে ফরচুন সুজ এবং সরকারি কোম্পানি ন্যাশনাল টিউবসের শেয়ার। এরমধ্যে ফরচুন সুজের ৫৫ লাখ ৪২ হাজার শেয়ার বিক্রি হয়েছে।

যার বড় অংশ বিক্রি হয়েছে ইউসিবি থেকে। বেশি শেয়ার বিক্রি হয়েছে ১২০৫৫৯০০৬৭৯৭৬৭৩৮ এবং ১২০৫৫৯০০৬৭৮১৫৫০৩সহ আরও বেশ কিছু বিও অ্যাকাউন্ট থেকে। অন্যদিকে বড় কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউসের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে।
জানতে চাইলে ইউসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রহমত পাশা যুগান্তরকে বলেন, ফোর্সড কেন হয় তা আপনি জানেন না, মার্জিন ঋণ মাত্রা অতিক্রম করলে হয়।

তিনি বলেন, প্রতিদিনই শেয়ার বিক্রি করি, আজও করেছি, কোনো কিছুই আইনের বাইরে করা হয়নি। আইনের বাইরে হলে তখন আপনি প্রশ্ন করতে পারেন। ফরচুন সুজের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি হাউসের বাইরে আছি। কোন ট্রেডার করেছে তা দেখতে হবে। আপনার কাছে ডাটা থাকলে আমাকে পাঠান, তারপর জবাব দেব।

জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, বাজারের উন্নয়নের জন্য ইতিমধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বিএসইসির দিক থেকে সব ধরনের চেষ্টা রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, লেনদেন বাড়াতে বাজারে এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা রয়েছে। ব্রোকারেজ হাউসগুলো অস্বাভাবিক বেতন দিয়ে এক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের অন্য প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যাচ্ছে।

এরপর এসব কর্মকর্তাদের মাধ্যমে অতিরিক্ত মার্জিন ঋণ সুবিধা দিয়ে এবং বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাহক সংগ্রহ করছে। আর ফাঁদে পড়ে গ্রাহকরাও আইন লঙ্ঘন করে মার্জিন নিয়ে শেয়ার কিনছে।

কিন্তু শেয়ারের দাম ঋণ সীমার কাছাকাছি চলে এলেই ফোর্সড করছে প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে গ্রাহকরা পথে বসে যাচ্ছে। এসব আইন লঙ্ঘনের বিষয়টি জানার পরও নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে বিএসইসি।
সব উদ্যোগ ব্যর্থ : চলতি বছরের মার্চ থেকে বাজারে টানা দরপতন শুরু হয়। সর্বশেষ ১৬ জুন ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৪ লাখ কোটি টাকা। কিন্তু বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তা কমে ৩ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকায় এসেছে। এ হিসাবে ৫০ কার্যদিবসে বাজার মূলধন কমেছে ৩২ হাজার কোটি টাকা। বাজারের পতন ঠেকাতে সরকারের পক্ষ থেকে বেশকিছু প্রণোদনা ছাড়াও চলতি বাজেটেও শেয়ারবাজারে বিভিন্ন খাতে কর ছাড় দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।

ব্যাংকগুলোর শেয়ার কেনার সীমার ব্যাপারেও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ছাড় দেয়া হয়েছে। কিন্তু টেকসই হয়নি বাজার। এরপর বাজার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে নানা সুবিধা ও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বিএসইসি চেয়ারম্যান। কিন্তু দরপতন বন্ধ হয়নি। সর্বশেষ সোমবার অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে দেশের আর্থিক খাতের নীতি-নির্ধারকরা শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি ও উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন। তাতেও পতন বন্ধ হয়নি।

বৃহস্পতিবারের বাজার চিত্র : একক দিন হিসেবে ডিএসইতে বৃহস্পতিবার ৩৫৩টি কোম্পানির ৯ কোটি ৭৩ লাখ শেয়ার লেনদেন হয়েছে। যার মূল্য ৩৮৪ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। ডিএসইর ব্রড সূচক আগের দিনের চেয়ে ৩২ পয়েন্ট কমে ৪ হাজার ৮৫৫ পয়েন্টে নেমে এসেছে। লেনদেনকৃত কোম্পানিগুলোর মধ্যে দাম বেড়েছে ৪৬টি শেয়ারের, কমেছে ২৬৯টি এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ৩৮টি কোম্পানির শেয়ারের দাম।

শীর্ষ দশ কোম্পানি : বৃহস্পতিবার ডিএসইতে যেসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বেশি লেনদেন হয়েছে সেগুলো হল- ন্যাশনাল টিউবস, ফরচুন সুজ, স্কয়ার ফার্মা, মুন্নু স্টাফলার, বীকন ফার্মা, জেএমআই সিরিঞ্জ, ইউনাইটেড পাওয়ার, লিগ্যাসী ফুটওয়ার, মুন্নু সিরামিক এবং ন্যাশনাল পলিমার।

ডিএসইতে এদিন যেসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম বেশি বেড়েছে সেগুলো হল- গ্রামীণফোন, ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স, এআইবিএল ফার্স্ট ইসলামী মিউচুয়াল ফান্ড, ইস্টার্ন ব্যাংক, প্রভাতী ইন্স্যুরেন্স, ন্যাশনাল পলিমার, গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স, ফাইন ফুডস, ইস্টার্ন ব্যাংক মিউচুয়াল ফান্ড এবং ম্যাকসন্স স্পিনিং।

অন্যদিকে যেসব কোম্পানির শেয়ারের দাম বেশি কমেছে সেগুলো হল- বিআইএফসি, ফরচুন সুজ, মুন্নু সিরামিক, জিকিউ বলপেন, ন্যাশনাল টিউবস, সিনোবাংলা ইন্ডাস্ট্রিজ, সিএন্ডএ টেক্সটাইল, কাশেম ইন্ডাস্ট্রিজ, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং এবং ফার্স্ট ফাইন্যান্স।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/222541/