১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৫:৫৫

বিপজ্জনক 'বদলি' চালক

ঢাকায় বাস চালাচ্ছে কারা

গত ২৭ আগস্ট ট্রাস্ট সার্ভিসের যে বেপরোয়া বাস বাংলামটরের ফুটপাতে বিআইডব্লিউটিসির কর্মকর্তা কৃষ্ণা রায়কে চাপা দিয়েছিল, সেটা চালাচ্ছিলেন একজন 'বদলি' চালক। পুলিশের কাছে ধরা পড়া চালক মোরশেদ স্বীকার করেছেন এ কথা। তিনি মূল চালকের পরিবর্তে 'বদলি' হিসেবে গাড়িটি নিয়েছিলেন। ওই দিনই প্রথম বাসের স্টিয়ারিং ধরার অভিজ্ঞতা ছিল তার। গত ৬ সেপ্টেম্বর উত্তরায় ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহনের যে বেপরোয়া বাস সঙ্গীতশিল্পী পারভেজ রবকে ফুটপাত ঘেঁষে চাপা দিয়ে হত্যা করে, পরে জানা যায় সে বাসটিও চালাচ্ছিলেন 'বদলি' চালক। একই দিন মহাখালীতে 'ক্যান্টনমেন্ট মিনি সার্ভিসের' বেপরোয়া বাস বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে ফুটপাতে তুলে হত্যা করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ফারহা নাজকে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এই বাসটি চালাচ্ছিল ১৫-১৬ বছরের এক কিশোর। গত সোমবার দুপুর ১টা ৫০ মিনিটে চেয়ারম্যানবাড়ি ক্রসিংয়ের কাছে ক্যান্টনমেন্ট মিনি সার্ভিসের বাস একটি সিএনজি অটোরিকশাকে ধাক্কা দেয়। এ বাসটিও চালাচ্ছিল ১৪-১৫ বছরের এক কিশোর। এর আগে গত ১৯ মার্চ রাজধানীর নদ্দায় সুপ্রভাত পরিবহনের যে বাসটি জেব্রা ক্রসিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র আবরারকে চাপা দিয়েছিল, সে বাসটিও চালাচ্ছিলেন বদলি চালক এবং বাসমালিকের নির্দেশেই 'বদলি' হিসেবে বাসে উঠেছিলেন বলে পুলিশকে জানিয়েছেন তিনি।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, রাজধানীর বাস সার্ভিসে এখন 'বদলি' চালক প্রথা বেশ জনপ্রিয়। এসব বাস সার্ভিসের বাস আগের মতোই দিন চুক্তিতে চলছে। আর দিন চুক্তির চালকরা সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে গাড়ি তুলে দিচ্ছেন বদলি চালকের হাতে। খোদ পরিবহন নেতারা বলছেন, ঢাকায় এখন যেসব কোম্পানির বাস চলছে, সেগুলোর ওপর মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেই। বিভিন্ন কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন এক শ্রেণির রাজনৈতিক নেতা। তারাই ঢাকায় চুক্তিতে গাড়ি চালানোর প্রথা টিকিয়ে রেখেছেন এবং 'বদলি চালক' ব্যবস্থাকেও সাধারণ নিয়মে পরিণত করেছেন। সমকালের সঙ্গে আলাপকালে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলি কোম্পানির বাস চলার নামে অরাজকতার যথাযথ তদন্ত দাবি করেছেন।

বদলি চালক কারা :পরিবহন-সংশ্নিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বর্তমানে রাজধানীতে গণপরিবহন চলে নানা কোম্পানির নামে। ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী ঢাকার সিটি সার্ভিসে এখন রুটসংখ্যা ২৮৯। মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী ১৭৬টি রুটে নিয়মিত বাস চলছে। বাকিগুলোতে কখনও বাস চলে, কখনও চলে না। পরিবহন-সংশ্নিষ্ট সূত্রের তথ্য অনুযায়ী প্রতি রুটে একটি, কোনো কোনো রুটে একটির বেশি পরিবহন কোম্পানির বাস চলছে। কোম্পানি শুধু রুট বরাদ্দ নেয়। আর কোম্পানির ব্যানারে প্রকৃতপক্ষে বাস চালান ব্যক্তি মালিকরাই। কোম্পানির ব্যানার ব্যবহার করে নির্দিষ্ট রুটে গাড়ি চালানোর জন্য তারা কোম্পানির ব্যবস্থাপনা কমিটিকে দিনে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা দেন। এ টাকার পরিমাণ কোম্পানি ভেদে বাসপ্রতি ৪০০ থেকে ৮০০ টাকা। কোম্পানি গাড়ির জ্বালানি খরচ, মেরামত, যন্ত্রাংশ ক্রয় কিংবা দুর্ঘটনার কোনো দায় নেয় না। তারা শুধু ব্যানার ব্যবহারের জন্য ফি নেয়। এর সত্যতা পাওয়া যায় রাজধানীর কয়েকটি আলোচিত দুর্ঘটনার পরবর্তী অনুসন্ধানেও। যেমন- ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর পরিবহনের দুই বাসের মরণ দৌড়ের প্রতিযোগিতার শিকার হয়ে শহীদ রজিম উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হলে পরবর্তী সময়ে গ্রেফতার হন শুধু বাসের ব্যক্তি মালিক। একইভাবে নদ্দায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র আবরার আহমেদ চৌধুরী নিহত হওয়ার পর সুপ্রভাত পরিবহনের সংশ্নিষ্ট বাসের ব্যক্তি মালিককেই ধরা হয়। মূল কোম্পানির কর্মকর্তারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যান।

সূত্র জানায়, প্রকৃতপক্ষে ঢাকার বাস সার্ভিস কোম্পানিগুলো শুধু একটি ব্যানার, যাদের কাজ হচ্ছে কোম্পানির নামে রুট ব্যবসা করা। এমনকি এসব কোম্পানির অধীনে চলা অধিকাংশ বাসেরও সংশ্নিষ্ট রুটের রুট পারমিট থাকে না। এ কারণে যে ব্যক্তি মালিকরা কোম্পানির অধীনে বাস চালান, তারা দিন চুক্তিতেই বাস চালান। মালিকরা একজন চালকের হাতে দিন চুক্তি হিসেবে বাস তুলে দেন। অর্থাৎ দিনে একজন মালিককে বাসচালক নির্দিষ্ট অঙ্কের একটা টাকা দেবেন (বর্তমানে ২৫০০ থেকে ৪০০০ টাকায় দিন চুক্তি হয়)। এই চুক্তি নিয়ে চালকরা আবার 'বদলি চালকে'র সঙ্গে 'ট্রিপ চুক্তি' করেন। বদলি চালকদের বৈধ লাইসেন্স থাকে না, বয়স কম এবং অনভিজ্ঞ। এ কারণে তারা ট্রিপপ্রতি '২০০ থেকে সর্বোচ্চ ৩০০' টাকা পায়। এই ট্রিপ চুক্তির বদলি চালকদের হাতেই এখন রাজধানীর বাস সার্ভিসের স্টিয়ারিং।

মূল চালকরা গাড়ি চুক্তিতে নেওয়ার পর 'বদলি' চালকের হাতে দিয়ে নিজেরা আন্তঃজেলা রুটে কিংবা অন্যত্র গাড়ি চালাচ্ছেন। ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের পর রাজধানীতে এই 'দিন চুক্তি'র বাস চালানো বন্ধ করার ঘোষণা এসেছিল পরিবহন নেতাদের কাছ থেকে। কিন্তু এক বছরেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। বরং এই এক বছরে আরও বিপজ্জনক 'বদলি' চালক ব্যবস্থা চালু হয়ে গেছে রাজধানীতে।

পরিবহন নেতার বক্তব্য :বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের অন্যতম নেতা ওসমান আলি সমকালকে জানান, রাজধানীতে 'বদলি চালকে'র দৌরাত্ম্য বেড়ে যাওয়ার ঘটনা সত্য। এটা তারা অস্বীকার করেন না। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, রাজধানীতে এখন যেসব কোম্পানির বাস চলছে, সেগুলোর ওপর বৈধ মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেই। এসব কোম্পানি ফ্রি স্টাইলে লাভজনক রুট বরাদ্দ নিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। কোম্পানিগুলোই বেশি লাভের আশায় কম পয়সায় অনভিজ্ঞ, অপরিণত চালকের হাতে গাড়ি তুলে দিচ্ছে। তাদের উদাসীনতার কারণেই মূল চালকের বদলে 'বদলি চালক' গাড়ি চালানোর সুযোগ পাচ্ছে। তিনি বলেন, অবিলম্বে এসব কোম্পানি কীভাবে চলছে, কারা চালাচ্ছে, কেন 'বদলি চালকে'র হাতে গাড়ি, সে বিষয়ে তদন্ত হওয়া উচিত।

https://samakal.com/capital/article/1909941/