৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯, সোমবার, ১:৩৪

গবাদি পশুর চিকিৎসা

এক্সিসের অবৈধ ভেজাল ওষুধ অবাধে বিক্রি

বিদেশ থেকে প্রাণিজ প্রিমিক্স ভিটামিন আমদানি করে বাজারজাত করার লাইসেন্স নিয়ে ২০১৬ সালে ঢাকার মিরপুরের দক্ষিণ কল্যাণপুরের ইস্টার্ন হাউজিং প্রজেক্ট ২-এর ৪/৩ নম্বর বাড়িতে ব্যবসা শুরু করে ‘এক্সিস অ্যাগ্রোভেট লিমিটেড’। প্রতিষ্ঠানটির অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রির কোনো অনুমোদনই নেই। ঢাকার প্রাণিসম্পদ দপ্তরের রেকর্ডপত্র অনুযায়ী প্রতিষ্ঠার পর এ পর্যন্ত এক তোলা পরিমাণ ওষুধ আমদানির ছাড়পত্র পায়নি প্রতিষ্ঠানটি। অথচ গাজীপুর, পাবনা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লাসহ দেশের অনেক স্থানে প্রাণীর জন্য ওষুধের বড় বাজারগুলো সয়লাব এক্সিসের অ্যান্টিবায়োটিক ও ভিটামিনে।

এক্সিস অ্যাগ্রোভেটের এসব ওষুধের উৎস জানতে গিয়ে বের হয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। অনুসন্ধানে জানা গেছে, চোরাপথে বিদেশ থেকে ওষুধের উপাদান এনে নিজেরাই ভিটামিন, প্রিমিক্স ও অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করছে প্রতিষ্ঠানটি। পরে ভারত ও জর্দানের নামিদামি প্রতিষ্ঠানের মোড়ক লাগিয়ে বাজারজাত করছে। তাদের নেই কোনো ল্যাব, কেমিস্ট, ফার্মাসিস্ট, এমনকি মানসম্পন্ন যন্ত্রপাতি। অফিসের গোপন একটি কক্ষে ওষুধ তৈরি করা হয়। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে প্রতিষ্ঠানটি এই ভেজাল ওষুধ ছড়িয়ে দিচ্ছে দেশের সর্বত্র। প্রাণিচিকিৎসকদের তথ্য মতে, এক্সিসের মানহীন ও ভেজাল ওষুধ প্রাণিস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর ও ঝুঁকিপূর্ণ।

সম্প্রতি গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা, শ্রীপুর ও কাপাসিয়ার বিভিন্ন ভেটেরিনারি ওষুধের দোকান ঘুরে দেখা গেছে, এক্সিসের ছয় ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক এবং আট ধরনের ভিটামিন ওষুধ বাজারে বিক্রি হচ্ছে। অ্যান্টিবায়োটিকগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্রো ফসফিন ফোর্ট, ক্রো ফ্লক্স ফোর্ট, ক্রো কক্স প্লাস, ক্রো ফ্লোর ফোর্ট, এ মক্স প্লাস ও কলিস্টিন ৮০ প্লাস। এসব ওষুধের প্যাকেটে উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নাম হিসেবে জর্দানের ‘ক্রাউন ভেট’ কম্পানির নাম ও ঠিকানা লেখা। কিন্তু প্যাকেটে নেই উত্পাদন লাইন্সেস নম্বর।

ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কমিটির ২৫০তম সভার সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাণিদেহের ক্ষতি বিবেচনা করে ওষুধ প্রশাসন গত ৭ মে কলিস্টিন, সিপ্রোফ্লক্সাসিন, অ্যামোক্সলিনসহ ২৭ ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করেছে। অথচ বাতিলের তালিকায় থাকা কলিস্টিন, সিপ্রোফ্লক্সাসিন, অ্যামোক্সলিন এখনো দেদার বিক্রি করছে এক্সিস।

অন্যদিকে প্রোজাইম এএক্স, লিভোজাইম এফই প্লাস, লিভএক্স ওরাল, ক্যালচিভেট গোল্ড, মেরিমিক্স পাউডার, বোভি এক্স, রুমেনজাইম এএক্স বোলস, ইনজেকশন ভিটাফস ১২ ও ইউনি পাওয়ার ফ্যাট ভিটামিন জাতীয় ওষুধের লেভেলে উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে আসামের গুয়াহাটির ‘মেরিয়ন ফার্মা ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড’ লেখা আছে। এসব ওষুধ ও ভিটামিন হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল ও মাছের খাদ্য ও চিকিৎসায় বিক্রি হচ্ছে। প্যাকেট, লেভেল ও প্রডাক্ট ম্যানুয়ালে গুণগান ও সফলতার কথা উল্লেখ থাকলেও ব্যবহারকারীদের অভিযোগ, এক্সিস ওষুধ কিনে তারা প্রতারিত হয়েছে। ওষুধ কোনো কাজই করে না। পাউডার জাতীয় বেশির ভাগ ওষুধ জমাটবাঁধা অথবা দুর্গন্ধযুক্ত।

গাজীপুর মহানগরের বাসন এলাকার খামারি আবদুল মালেক অভিযোগ করেন, চান্দনা চৌরাস্তার এজি ল্যাবের এক পশু চিকিৎসকের পরামর্শে তাঁর অসুস্থ গাভিকে দেড় মাস এক্সিস কম্পানির এমক্স প্লাস অ্যান্টিবায়োটিক কিনে খাইয়েছিলেন। রোগ ভালো হয়নি, উল্টো প্রায় দেড় লাখ টাকা মূল্যের দুধেল গাভিটি মারা গেছে। পরে অন্য ডাক্তারের কাছে গিয়ে জানতে পারেন, এক হাজার ২০০ টাকা দিয়ে কেনা ওষুধটি ছিল ভেজাল ও মানহীন। ওষুধটি বিক্রির অনুমোদনও নেই প্রতিষ্ঠানটির। ওই খামারির প্রশ্ন, ‘অনুমোদনহীন ওষুধ কিভাবে দোকানগুলোতে বিক্রি হচ্ছে, তৈরিই বা হচ্ছে কোথায়? যাদের এসব দেখার দায়িত্ব তারাই বা কোথায়?’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মোজাম্মেল হক একজন বড় মাপের প্রতারক। এক্সিস খোলার আগে তিনি ওষুধ উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠান এসকেএফ লিমিটেডের গাজীপুরের বিক্রয় প্রতিনিধি ছিলেন। অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। পরে যোগ দেন পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালসে। সেখানেও একই অভিযোগে বরখাস্ত হন। পরে নিজেই এক্সিস অ্যাগ্রোভেট গড়েন। আটজন পরিচালক থাকলেও তাঁর একক সিদ্ধান্তেই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হয়। ভেজাল ওষুধ বিক্রি করে অল্প দিনেই ফুলেফেঁপে উঠেছেন তিনি।

এক্সিসের একজন সাবেক পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ২০১৭ সালের ১ এপ্রিল তিনি এক্সিসে যোগ দিয়েছিলেন। যোগদানের পর জানতে পারেন মোজাম্মেল হক চোরাপথে নামমাত্র কিছু উপাদান এনে স্থানীয় বাজার থেকে আরো কিছু ওষুধ মিশিয়ে প্যাকেট করে বিক্রি করছেন। প্রতিষ্ঠানের ছয়টি অ্যান্টিবায়োটিকের মধ্যে এমক্স প্লাস, কলিস্টিন ৮০ প্লাস ও প্রিমিক্স ইউনি পাওয়ার ফ্যাট অফিসের ভেতরেই তৈরি করা হয়। মোড়কে ভারত ও জর্দানের তৈরি উল্লেখ থাকলেও পুরোটাই প্রতারণা। নেই কোনো ল্যাব, কেমিস্ট, ফার্মাসিস্ট কিংবা ওষুধ তৈরির আধুনিক যন্ত্রপাতি। প্রতারণার বিষয়টি জানতে পেরে তিনি পদত্যাগ করেন।

গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তায় প্রাণিজ ওষুধের বড় বিক্রয় প্রতিষ্ঠান এমিটি মেডিসিনের মালিক এস এম হাসান কালের কণ্ঠকে জানান, দেখলে সহজেই বোঝা যায় এক্সিসের ওষুধ নকল। পশু চিকিৎসকরা লেখেন বলেই তাঁরা ওই সব ওষুধ দোকানে রাখতে বাধ্য হন।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে এক্সিস অ্যাগ্রোভেটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল হক নিজেরা ওষুধ তৈরির অভিযোগ অস্বীকার করে দাবি করেন, আমদানি করা ওষুধই বিক্রি করেন তাঁরা। সঙ্গে এটাও বলেন, সরকার নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় অ্যান্টিবায়োটিক শিগগিরই বাজার থেকে তুলে নেবেন।

গাজীপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা দীপক রঞ্জন রায় জানান, ভিটামিন ও প্রিমিক্স জাতীয় ওষুধ খাদ্যের দোকানে থাকার কথা। কিন্তু এসব উপাদান ওষুধের দোকানে বিক্রি হচ্ছে। অভিযান চালানোর এখতিয়ার তাঁদের নেই। এটি দেখার দায়িত্ব ঔষধ প্রশাসনের। প্রাণিসম্পদ বিভাগের শুধু খাদ্যের দোকানে অভিযানের এখতিয়ার রয়েছে। এক্সিসের ওষুধের মানহীনতার বিষয়ে তাঁর কাছেও অভিযোগ এসেছে। বিষয়টি তিনি জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় অবহিত করেছেন।

ঢাকা বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. এমদাদুল হক তালুকদার জানান, পশু ও প্রাণীর খাদ্য এবং ওষুধ আমদানি, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ নীতিমালা অনুযায়ী প্রাণিসম্পদ বিভাগের ছাড়পত্র ছাড়া কোনো ওষুধ বা খাদ্য আমদানির সুযোগ নেই। বৈধভাবে আমদানি করা হলেও প্যাকেট পরিবর্তন বা নতুনভাবে প্যাকেটজাত করে বিক্রিরও সুযোগ নেই। আমদানি করা ওষুধ যে গুদামে রাখা হয়েছে পরিদর্শন কমিটির সদস্যরা গুদামের জৈব নিরাপত্তা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, গুদামের আর্দ্রতা, প্যাকিং ও লেভেলিং সঠিক আছে মর্মে নিশ্চিত হয়ে প্রতিবেদন দিলেই শুধু বিক্রির সুযোগ রয়েছে। এক্সিসের এসব কিছুই নেই।

ঢাকা প্রাণিসম্পদ বিভাগের সহকারী পরিচালক (পরিদর্শন) আবু সুফিয়ান জানান, এক্সিসের অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রির অনুমোদন নেই। প্রতিষ্ঠার পর প্রিমিক্স আমদানির কোনো ছাড়পত্র পায়নি প্রতিষ্ঠানটি। ছাড়পত্রবিহীন আমদানি করা ওষুধ অবৈধ। তার পরও প্রতিষ্ঠানটি কিভাবে অ্যান্টিবায়োটিক, ভিটামিন ও খাদ্য বিক্রি করছে তা তদন্ত করে দেখা হবে। সত্যতা পাওয়া গেলে আমদানি লাইসেন্স বাতিলসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2019/09/09/812738