২৮ আগস্ট ২০১৯, বুধবার, ১:৩১

খেলাপি ঋণ নিয়ে উদ্বেগ আইএমএফের

ব্যাংক খাতে অস্বাভাবিক হারে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। খেলাপি ঋণের পরিমাণ কেন বাড়ছে, সংজ্ঞা পরিবর্তনের কারণে কোনো প্রভাব পড়ছে কি না তা জানতে চাওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। একই সাথে উচ্চ আদালতে রিট করে বিপুল খেলাপি ঋণ হিসাবের খাতায় না রাখার বিষয়েও প্রশ্ন করেছে। এ থেকে প্রতিকারের জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামোগতভিত্তি শক্তিশালী করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

সফররত আইএমএফের চার সদস্যের এক প্রতিনিধিদল গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সাথে পৃথক দু’টি বৈঠকে এ বিষয়গুলোর অবতারণা করে বলে জানা গেছে। বৈঠকগুলোতে খেলাপি ঋণ কিভাবে কমানো যায় তারও উপায় খুঁজতে বলা হয়েছে।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা গতকাল বৈঠক সম্পর্কে নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, আইএমএফের এটি একটি রুটিন ভিজিট। আইএমএফের সাথে চুক্তির শর্ত হিসেবে তারা ব্যাংকিং খাতের বিভিন্ন সূচকের অগ্রগতি ও অবনতি বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জানতে চান। এর অংশ হিসেবে তারা গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন বিভাগের প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করেছেন। তারা জানতে চেয়েছেন খেলাপি ঋণ এমন অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার কারণ কী। আর এ থেকে উত্তরণের উপায় কী। একই সাথে খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার পেছনে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামোগত কোনো দুর্বলতা আছে কি না। আর বিপুল অঙ্কের খেলাপি ঋণ উচ্চ আদালতে রিট করার কারণে খেলাপি ঋণ হিসেবে দেখানো যাচ্ছে না। এ থেকে করণীয় কী।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এসব বিষয়ে আইএমএফের প্রতিনিধিদের কাছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে সর্বশেষ পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, গত ডিসেম্বর শেষে দেশে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৩ হাজার কোটি টাকা। সেখানে মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে খেলাপি ঋণ অবলোপন করা হয়েছে প্রায় ৪৮ হাজার কোটি টাকা। সব মিলে মার্চ থেকে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৮ হাজার কোটি টাকা। তবে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় জুন মাসের সর্বশেষ খেলাপি ঋণের চিত্র নিয়েও তারা কথা বলেছেন। গত জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল এক লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকায়। খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশে। এই সময়ে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত মোট ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ৬২ হাজার ৭৭ কোটি টাকা। এর বাইরে খেলাপি হওয়া ঋণ রাইট অফ বা অবলোপন হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। এই হিসাবে দেশের ব্যাংক খাতে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে এক লাখ ৬২ হাজার ৫১৪ কোটি টাকা। খেলাপির হার দাঁড়াবে ১৬ দশমিক ৮৯ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নানা কারণে খেলাপি ঋণ আদায়ের গতি শ্লথ। এর বাইরে ডিসেম্বর শেষে যেসব ঋণ নবায়ন করা হয়েছিল তা পরবর্তী তিন মাসে আদায় না হওয়ায় আবার তা খেলাপি হয়ে গেছে। এর মধ্যে যারা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি তাদের শনাক্ত করা হচ্ছে। আর যারা ব্যবসায় প্রকৃতপক্ষে লোকসান গুনে ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করতে পারছেন না তাদের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এ জন্য ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ১০ বছরের জন্য নবায়ন করার সুযোগ দেয়া হয়েছিল, যা উচ্চ আদালতে রিট করায় তা বাস্তবায়ন পর্যায়ে এসে স্থগিত করে রাখা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের অপর এক কর্মকর্তা এ বিষয়ে জানিয়েছেন, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাখ্যার বিষয়ে তারা সন্তুষ্ট হতে পারেননি। বরং খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য কিছু পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বাংলাদেশ ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো শক্তিশালী করা। কোনো ঋণখেলাপি রাজনৈতিক বিবেচনায় ছাড় না পান সে জন্য এসব প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী কঠামোতে দাঁড় করাতে বলা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ থেকেই ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, সামগ্রিক সময়ে ব্যাংক খাতের ঋণ আদায় অস্বাভাবিক হারে কমে গেছে। বিশেষ করে গত জানুয়ারি মাসে নতুন অর্থমন্ত্রী ঋণখেলাপিদের বিভিন্ন সময়ে কিছু ছাড় দেয়ার ঘোষণায়। ঋণখেলাপিদের ছাড় দিতে অর্থমন্ত্রীর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঘোষণা দেয়ায় যারা ব্যাংকের নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতেন তারাও একপর্যায়ে ঋণ পরিশোধ বন্ধ করে দেন। এতেই ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/435415/