এডিস মশা।ফাইল ছবি
৩ আগস্ট ২০১৯, শনিবার, ৬:২১

রাজধানীতে এডিস মশা নিধন: ওষুধ কেনায় ধোঁয়াশা কাটছে না

ডেঙ্গুজ্বরের বাহক এডিস মশা নিধনে নতুন ওষুধ কেনা নিয়ে ধোঁয়াশা কাটছে না। কবে নাগাদ নতুন ওষুধ কেনা হবে বা চলতি মৌসুমে ওষুধ কেনা আদৌ হবে কিনা সেটাও পরিষ্কার করছে না দায়িত্বপ্রাপ্ত দুই সংস্থা।

এদিকে প্রায় মহামারী আকার ধারণ করা ডেঙ্গু প্রতিরোধে দুই সিটি কর্পোরেশন এখনও অকার্যকর ওষুধ ছিটিয়ে মশা নিধনের অভিনয় করছে। এ ব্যাপারে জনগণের দাবি ও উচ্চ আদালতের কঠোর নির্দেশনাও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না।

এডিস মশা নিধনে কোন সংস্থা বিদেশ থেকে কার্যকর ওষুধ আনবে- এটা নিয়ে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সিটি কর্পোরেশন ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় একে অপরের কাঁধে দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ওষুধ কে আনবে তা স্পষ্ট করতে বৃহস্পতিবার সকালে হাইকোর্ট স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবকে ডেকে পাঠান।

আদালতে উপস্থিত হয়ে তিনি জানান, মশার ওষুধ বেসরকারিভাবে উৎপাদন হয়। তাই সরকার টু সরকার (জি টু জি) পদ্ধতিতে আমদানি করা কষ্টকর হবে। ইতিমধ্যে ওই ওষুধ আনার জন্য সিটি কর্পোরেশনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সব পক্ষের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট এডিস মশা নিধনে বিদেশ থেকে নতুন ও কার্যকরী ওষুধ আনার নির্দেশ দেন রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশনকে। আর এ কাজে সার্বিক সহযোগিতা করার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে (এলজিআরডি) নির্দেশ দেয়া হয়।

কবে আসছে নতুন ওষুধ এ বিষয়ে জানতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনকে টেলিফোন করা হয়। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘আজ শুক্রবার, ছুটির দিন। বাসায় ব্যক্তিগত কাজ করছি। অফিস ডেতে ফোন করেন বা অফিসে চলে আসেন; তখন এসব ব্যাপারে কথা বলব।’ একই বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোস্তাফিজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।’

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) সচিব রবীন্দ্র শ্রী বড়ুয়া যুগান্তরকে বলেন, ‘যতটুকুন জানি দু’দিন আগে মশার ওষুধের স্যাম্পল আসার কথা ছিল। সেটা এসেছে কিনা জানি না। বিষয়টা ভালো বলতে পারবেন প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা।’ ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মোমিনুর রহমান মামুন যুগান্তরকে বলেন, ‘ওষুধ ক্রয় সংক্রান্ত কোনো কিছুই আমার জানা নেই।’

স্বাস্থ্য অধিদফতরের পূর্বাভাস অনুযায়ী, এপ্রিল থেকে অক্টোবর বাংলাদেশে এডিস মশার প্রজনন সময়। এ সময় এডিস মশাবাহী ডেঙ্গু ভাইরাস মানবশরীরে ছড়িয়ে পড়ে। আর এতে প্রতি বছর মানুষ আক্রান্ত হয়। এবার বর্ষার মৌসুম আগে শুরু হওয়ায় আগে থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে রাজধানীর বাসিন্দারা। বর্তমানে রাজধানী থেকে ডেঙ্গু ভাইরাস সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। সারা দেশে প্রতিদিনই শত শত মানুষ ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে। এ মৌসুমের বাকি সময় এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করতে না পারলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কীটতত্ত্ববিদ খলিলুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, এডিস মশার বংশ বিস্তারের মৌসুম চলছে। এ মৌসুমে মশার বংশ বিস্তার রোধ করা না গেলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তিনি আরও বলেন, ‘মৌসুম শুরুর সময় স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে আমরা যখন দুই সংস্থাকে সতর্ক করেছিলাম, সে সময়ই পদক্ষেপ নেয়া দরকার ছিল। সেটা না নেয়ায় বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আরও ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হতে হবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্ল্যানার্স ইন্সটিটিউটের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ও পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান যুগান্তরকে বলেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দ্রুততম সময়ের মধ্যে কার্যকর ওষুধ আনতে হবে। ওষুধ আনা নিয়ে এসব টালবাহানা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তিনি বলেন, সঠিক সময় পদক্ষেপ না নেয়ার ক্ষয়ক্ষতি কে বহন করবে? কোনোরকম শৈথিল্য প্রদর্শন না করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ওষুধ এনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহবান জানান তিনি।

চীন থেকে আনা হবে নতুন ওষুধ : প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ২৮ জুলাই অনুষ্ঠিত সভায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, কৃষি মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্যসেবা অধিদফতরের সচিবকে নিয়ে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। মশার ওষুধ চূড়ান্ত করা হবে কমিটির কাজ। ওইদিনই কমিটির বৈঠকে চীন থেকে নতুন চার ধরনের ওষুধ আমদানির সিদ্ধান্ত হয়।

এর মধ্যে রয়েছে- ম্যালথিয়ন ৫৭ ভাগ ইসি, ম্যালথিয়ন ৫ ভাগ আরএফইউ, ডেল্টামেথ্রিন+পিআরও ২ ভাগ ইডব্লিউ এবং পিরিমিফস-মেথিল ৫০ ভাগ ইসি। সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে এসব ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। বৃহস্পতিবার সকালের মধ্যেই বিমানযোগে এসব ওষুধ সিটি কর্পোরেশনের কাছে চলে আসার কথা ছিল। কিন্তু ওই ওষুধ এসেছে কিনা সেটা পরিষ্কার করছে না সংশ্লিষ্টরা। এ ওষুধ আসার সঙ্গে সঙ্গে তা খামারবাড়ি ও আইইডিসিআরে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হবে। পরীক্ষায় মান সন্তোষজনক হলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নতুন ওষুধ বিমানযোগে আমদানি করবে দুই সিটি কর্পোরেশন।

এ বিষয়ে সম্প্রতি মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেন, নতুন ওষুধ প্রয়োজনে বিমানযোগে আমদানি করা হবে। তবে কবে আমদানি করা হবে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি জানান, দ্রুততম সময়ের মধ্যে। এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ওষুধ কেনার যে প্রক্রিয়া রয়েছে সেটা সম্পন্ন করতে অন্তত ১০ থেকে ১৫ দিন সময় লাগবে।

ওষুধের মান পরীক্ষা হবে যেভাবে : ওষুধ বুঝে নেয়ার আগে ওষুধের মান মাঠ পর্যায়ে প্রথমে পরীক্ষা করা হয়। মশারির ভেতরে কিছু মশা রেখে সেগুলোর ওপর স্প্রে করা হয়। ২০ শতাংশ মশা সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লে এবং পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অবশিষ্ট মশার মৃত্যু নিয়ে ওষুধের রাসায়নিক বিশ্লেষণ (কেমিক্যাল অ্যানালাইসিস) করা হয়। খামারবাড়ির উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং ও মহাখালীর রোগ নিরীক্ষা, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এসব দায়িত্ব পালন করে। তারা ল্যাবরেটরিতে ওষুধের জৈবিক কার্যকারিতা (বায়ো ইফিকেসি) পরীক্ষা করে। উভয় প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষায় ওষুধের মান সন্তোষজনক বলে প্রমাণিত হলে সিটি কর্পোরেশন তা আমদানি করে থাকে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/206243/