১ আগস্ট ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৮:৪৭

অসঙ্গতি আর অসম্পূর্ণতায় ভরপুর ফলাফল তালিকা ॥ নির্বিকার ইসি

সরদার আবদুর রহমান : একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কেন্দ্রভিত্তিক ফলের সুরতহাল রিপোর্টে দেখা যায়, নানাপ্রকার অসঙ্গতি আর অসম্পূর্ণতায় ভরপুর নির্বাচন কমিশন প্রণীত ফলাফলের তালিকা। এতদসত্বেও নির্বিকার অবস্থান ইসি’র।

কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলের যে তালিকা নির্বাচন কমিশন প্রকাশ করেছে তাতে আসনভিত্তিক যোগফল দেয়া হয়নি। শুধু কেন্দ্রের ক্রমিক নম্বর দেয়া হয়েছে। সেই আসনের মোট ভোটার, মোট বৈধ ভোট, প্রার্থী ও প্রতীকের মোট প্রাপ্ত ভোট, শতকরা হার প্রভৃতির কোন কলামেই যোগফল দেয়া হয়নি। ফলে আসনভিত্তিতে একনজরে ভোটের চিত্র পাওয়া সম্ভব নয়। নির্বাচনের ৬ মাস পরেও নির্বাচনী পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়নি। ফলে ভোটের সার্বিক চিত্র ইসি’র ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া সম্ভব হয় না।

ভোটের হিসাবে গরমিল : ভোটের দিনের রিটার্নিং অফিসারের দেয়া হিসাব আর পরবর্তীকালে ইসি’র প্রকাশিত হিসাবেও হেরফের হওয়ার চিত্র পাওয়া যায়। বেসরকারিভাবে ঘোষিত ফলের সঙ্গে ইসির প্রকাশিত কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলের গরমিল দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, ৩০ ডিসেম্বর ভোট গ্রহণ শেষে বেসরকারি ফলাফলে চট্টগ্রাম-১০ আসনের একজন প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট শূন্য দেখানো হয়েছিলো। এখন নির্বাচন কমিশন (ইসি) থেকে প্রকাশিত কেন্দ্রভিত্তিক প্রাপ্ত ভোট যোগ করে দেখানো হয় ২৪৩টি ভোট। সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন বিশ্লেষণ করে জানায়, ঢাকা-১০ আসনে তাৎক্ষণিক ফলাফলে ভোট পড়ার হার ছিলো ৬৯.৯২% ভাগ। কিন্তু ইসির ফলে দেখানো হয়েছে ৭৩.০৯% ভাগ- যা ৩.১৭% ভাগ বেশি। ঢাকা-১১ আসনে এটি ছিল ৬০.৪৬% ভাগ। আর পরে ইসির তালিকায় দেখানো হয়েছে ৬২.৬৫% ভাগ। এটি ২.১৯% ভাগ বেশি। চট্টগ্রাম-৮ আসনে বেসরকারি ফলাফলে ভোটের হার ছিল ৭৪.৪৪% ভাগ। আর ইসির দেয়া তথ্য অনুযায়ী ৭৬.৭২% ভাগ। এটি ২.২৮% ভাগ বেশি। এ ছাড়া গোপালগঞ্জ-৩ আসনে বেসরকারি ফলাফলে ভোটের হার ছিল ৯৩.২৮% ভাগ। কিন্তু ইসির প্রকাশিত ফলাফল তালিকায় দেখানো হয়েছে ৯৪.৩৩% ভাগ- যা ১.৯% ভাগ বেশি। ইসির প্রকাশিত কেন্দ্রভিত্তিক ফল অনুযায়ী মাগুরা-২ আসনের থৈপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে কোনো ভোট পায়নি নৌকা। অথচ রিটার্নিং কর্মকর্তার দেয়া তথ্য বলছে, ওই কেন্দ্রে ধানের শীষ কোনো ভোটই পায়নি; বরং কেন্দ্রটিতে বৈধ ভোটের শতভাগই পেয়েছে নৌকা।

বাতিল ভোটের বন্যা : একাদশ সংসদ নির্বাচনে বাতিল ভোটের আধিক্যও লক্ষ্য করা যায়। এবার মোট ভোট বাতিল হয়েছে ৮ লাখ ৮৭ হাজার ৬৯০টি। ভোট বাতিলের গড় হার ১.০৬% ভাগ। তবে ১০০% ভাগ ভোট পড়া ২১৩টি ভোটকেন্দ্রে বাতিল ভোটের হার ছিল ১৫.১৬% ভাগ। এ ছাড়া ৩৪২টি ভোটকেন্দ্রে ১১% থেকে ৬১% ভাগ পর্যন্ত ভোট বাতিল হয়েছে। এর পাশাপাশি ৪,৭৯৫টি কেন্দ্রে কোনো ভোটই বাতিল হয়নি। সর্বোচ্চ ৬১ শতাংশ ভোট বাতিল হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের নোয়াগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে।

এর আগে অনুষ্ঠিত নির্বাচনসমূহে ভোট বাতিলের যে চিত্র পাওয়া যায় তাতে দেখা যায়, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে ভোট বাতিলের সংখ্যা ছিলো ৩ লাখ ৭৩ হাজার, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ৪ লাখ ৬২ হাজার, ২০০১ সালের নির্বাচনে ৪ লাখ ৪৯ হাজার, ২০০৮ সালের নির্বাচনে ৬ লাখ ৩৬ হাজার, ২০১৪ সালের (বিএনপি এই ভোট বর্জন করে) নির্বাচনে ভোট বাতিল হয় ২ লাখ ৬৩ হাজার এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভোট বাতিল হয় ৮ লাখ ৮৭ হাজার।
ব্যালট-ইভিএমএ অসঙ্গতি : নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর দেখা যায়, ব্যালট পেপারে ভোট নেয়া আসনের চেয়ে ইভিএমভুক্ত আসনে ভোট পড়েছে অনেক কম। ব্যালট পেপারের আসনের গড় ভোট যেখানে ছিলো ৮০.২০% ভাগ, সেখানে ইভিএমের আসনগুলোতে গড়ে ভোট পড়েছে ৫১.৪২% ভাগ। এই দুইয়ের মধ্যে ব্যবধান ২৮.৭৮% ভাগ। ইভিএমে সবচেয়ে বেশি ভোট পড়ে চট্টগ্রাম-৯ আসনে, ৬২.৮৭% ভাগ। সবচেয়ে কম পড়ে ঢাকা-১৩ আসনে, ৪৩.০৫% ভাগ। এ ছাড়া রংপুর-২ আসনে ভোট পড়ে ৫২.৩১%, খুলনা-২ আসনে ৪৯.৪১%, সাতক্ষীরা-২ আসনে ৫২.৮২% ও ঢাকা-৬ আসনে ৪৫.২৬% ভাগ। কিন্তু ব্যালট পেপারে ২১৩টি আসনে ১০০% ভাগ ভোট পড়ে। ইভিএম-এ সবচেয়ে কম ভোট পড়ে ১.৮৭% ভাগ রংপুর-৩ আসনের দ্য মিলিনিয়াম স্টারস স্কুল ও কলেজ কেন্দ্রে।

মজার ব্যাপার হলো, সব আসনে নৌকা প্রতীকে ভোটের প্রাপ্ত হার ৭৬.৮৬% ভাগ হলেও ইভিএম-এ এই হার ৫৪.৪৩% ভাগ। আর ধানের শীষ প্রতীকের ব্যালটে গড় ভোট যেখানে ১৩.৩০% ভাগ, সেখানে ইভিএম-এ ১৮.০১% ভাগ। জাতীয় গড়ের তুলনায় নৌকা প্রতীক ইভিএম-এ ২২.৪৩% ভাগ কম এবং ধানের শীষ জাতীয় গড়ের তুলনায় ইভিএম-এ ৪.৭১% ভাগ ভোট বেশি পায়। অর্থাৎ ইভিএম-এ ভোটের হার ও ব্যবধান দুটিই কম।

গত ৮ মার্চ প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালা উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেন, ইভিএম-এ ভোট হলে ভোটের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে রাখার কোনো সুযোগ থাকবে না। ভাষ্যকাররা বলছেন, সিইসি একটি ‘সফলতম’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি করার পর হঠাৎ কেন তাঁর মাথায় ‘রাতের ভোট’-এর কথা এলো- সেই প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠবে।

ভোটের পূর্বাপর অভিযোগের জবাব মেলেনি : একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনিয়মের নানা অভিযোগ অব্যাহত থাকলেও এসবের কোনো সুরাহা করতে, কোনো উদ্যোগই নেয়নি নির্বাচন কমিশন। বরং সবকিছু ‘আদালতে অভিযোগ করতে পারে’ বলে এড়িয়ে যাওয়া হয়। এসব অভিযোগের মধ্যে ছিলো, মনোনয়ন-বাণিজ্য, নির্বাচনী প্রচারণায় বাধাদান, বিরোধীজোটের পোলিং এজেন্টদের ভয়ভীতি দেখিয়ে বা মারধর করে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া, ভোটের আগের রাতে মহাজোট প্রার্থীদের প্রতীকে ভোট দিয়ে বাক্স ভরে রাখা, কোনো কোনো কেন্দ্রে বেলা ১১টার মধ্যেই ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যাওয়া, ভোটারদের প্রকাশ্যে সিল মারতে বাধ্য করা, দীর্ঘ সময় লম্বা লাইন করে দাঁড়িয়ে থাকলেও ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ না করা, নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে ব্যবহার, নির্বাচন কমিশনের নির্লিপ্ততা প্রভৃতি অভিযোগ উল্লেখযোগ্য ছিল। কেন্দ্রভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ ফলাফল প্রকাশের পর অনেক অভিযোগের যৌক্তিকতা পেয়েছেন বিশ্লেষকরা।

উল্লেখ করা যেতে পারে, ধানের শীষকে একাদশ সংসদ নির্বাচনে নৌকার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করা হলেও ৩০০ আসনের মধ্যে ১৮টিতে ধানের শীষ প্রতীকের কোনো প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে থাকতে পারেননি। একই সঙ্গে ধানের শীষ নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ১৬৩ জন প্রার্থীকেই জামানত হারাতে হয়; যাদের মধ্যে ছিলেন অনেক হেভিওয়েট প্রার্থী।

ফলাফলে এই অসংগতির বিষয়ে নির্বাচন কমিশন কোন আমলই দেয়নি। এবিষয়ে জানতে চাইলে একজন নির্বাচন কমিশনার বলেন, ইসি নিজে কিছু করেনি, রিটার্নিং কর্মকর্তার পাঠানো ফলাফল প্রকাশ করেছে। কোনো অসংগতি থাকলে যে কেউ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ করতে পারেন।

https://www.dailysangram.com/post/384908