৩১ জুলাই ২০১৯, বুধবার, ২:৫২

পোশাক রফতানি : যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান পিছিয়েছে

বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানি বাণিজ্যের গতি দুর্বল বলে জানিয়েছেন মার্কিন ক্রেতারা। পাশাপাশি শিল্পের কমপ্লায়েন্স ব্যবস্থাপনায় এখনো ঝুঁকি দেখছেন তারা। আবার বাংলাদেশ থেকে পোশাকের আমদানি ব্যয়ও বাড়ছে। সব মিলিয়ে পোশাক পণ্যের রফতানি বিবেচনায় গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান পিছিয়েছে।
মার্কিন পোশাক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীদের অংশগ্রহণে পরিচালিত এক জরিপের ওপর ভিত্তি করে তৈরি প্রতিবেদন বলছে ২০১৮ সালে পঞ্চম অবস্থানে থাকলেও ২০১৯ সালে ষষ্ঠ স্থানে এসেছে বাংলাদেশ।

‘২০১৯ ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি বেঞ্চমার্কিং স্টাডি’ শীর্ষক জরিপটি করেছেন ইউনিভার্সিটি অব ডেলাওয়ারের ফ্যাশন অ্যান্ড অ্যাপারেল স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. শেং লু। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংগঠন ইউনাইটেড স্টেটস ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন (ইউএসএফআইএ) এ জরিপে সহযোগিতা করেছে। ২০১৪ সাল থেকে ইউএসএফআইএ এমন জরিপ করছে। এ বছরের জরিপ প্রতিবেদনের ষষ্ঠ সংস্করণ প্রকাশ হয়েছে গত ২২ জুলাই। যুক্তরাষ্ট্রে ফ্যাশন পণ্য বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর যেসব নির্বাহী পোশাক ক্রয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত (সোর্সিং এক্সিকিউটিভ), তাদের দেয়া বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরের ভিত্তিতে জরিপ প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে, যেখানে বিভিন্ন দেশের পোশাক শিল্প সম্পর্কে তাদের মতামত উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনের প্রারম্ভিক বক্তব্যে চীন থেকে পোশাক আমদানিতে মার্কিন ক্রেতাদের ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়টি উঠে এসেছে। তবে জরিপে দেখা গেছে, শুধু চীন নয় পোশাক পণ্যের উৎস হিসেবে দেশটির বিকল্প বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম ও ভারত থেকে পোশাক ক্রয়ের ব্যয়ও বেড়েছে। তিনটি দেশ থেকেই পোশাক আমদানি ব্যয় ২০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। সব মিলিয়ে উৎপাদন ও পণ্যের সোর্সিং ব্যয় বৃদ্ধি ২০১৯ সালে ব্যবসার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে মত প্রকাশ করেছেন মার্কিন পোশাক ক্রেতা প্রতিনিধিরা।

চীন থেকে সোর্সিং কমে গিয়ে পোশাকের সরবরাহে বড় ভূমিকা রাখবে ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশ, এমন তথ্য উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জরিপে অংশ নেয়া নির্বাহীদের তথ্যমতে মার্কিন বাজারে বিক্রিত পোশাক তৈরির গন্তব্য হিসেবে চীনের পরেই দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ভিয়েতনাম। পোশাকের উৎস হিসেবে মার্কিন ক্রেতাদের মাধ্যমে দেশটিকে ব্যবহারের হার ৮৬ শতাংশ। যদিও জরিপে অংশ নেয়া মাত্র ৭ শতাংশ জানিয়েছে, তারা দেশটি থেকে আগামী দুই বছরে উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করবে। দেশটির উৎপাদন সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা ও ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মার্কিন ক্রেতা প্রতিনিধিরা।

এদিকে মার্কিন পোশাক আমদানির গন্তব্য হিসেবে ২০১৮ সালের জরিপে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল পঞ্চম। এবার অবস্থান হয়েছে ষষ্ঠ। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের দ্বারা এ বাজারটি ব্যবহারের হার ৬০ শতাংশ। ২০১৮ সালে ব্যবহারের হার ছিল ৭৫ শতাংশ। যদিও ৮০ শতাংশ অংশগ্রহণকারী মার্কিন ক্রেতা প্রতিষ্ঠান নির্বাহী জানিয়েছেন আগামী দুই বছরে বাংলাদেশ থেকে পোশাক ক্রয় বৃদ্ধিতে আগ্রহী তারা। এ মত প্রকাশ করেছে জরিপে অংশ নেয়া ১৭ শতাংশ। যদিও তাদের মতে বাজার গতি, নমনীয়তা, ক্ষিপ্রতা ও কমপ্লায়েন্স ঝুঁকি বিবেচনায় অন্য অনেক প্রতিযোগীর তুলনায় কম আকর্ষণীয় গন্তব্য বাংলাদেশ। চীন, ভিয়েতনাম ও ভারতই হলো মার্কিন ক্রেতাদের বহুল ব্যবহৃত শীর্ষ তিন বাজার। এরপরের দেশগুলো হলো ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া, বাংলাদেশ ও ফিলিপাইন।

মার্কিন বাজারে পোশাক পণ্য সরবরাহকারী ১৪টি দেশের রেটিংও দেখানো হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে পণ্য সরবরাহের গতি, সোর্সিং ব্যয় ও কমপ্লায়েন্স ঝুঁকি-এ তিনটি বিষয়ের ভিত্তিতে নম্বর ও প্রতীক বা চিহ্ন ব্যবহারের মাধ্যমে দেশগুলোর রেটিং করা হয়েছে। রেটিং মানদন্ডে কোনো দেশ ৫-এর মধ্যে ১ নম্বর পেলে পারদর্শিতা অনেক কম এবং ৫ পেলে ভালো মানের পারদর্শিতা রয়েছে বোঝানো হয়েছে। এক্ষেত্রে বৃত্ত আকৃতির চিহ্ন পাওয়া দেশগুলোর (৪-৫ নম্বর) সক্ষমতা ভালো বোঝানো হয়েছে। ত্রিমাত্রিক চিহ্নের মাধ্যমে গড় পারদর্শিতা (৩-৩.৯ নম্বর) ও ডায়মন্ড চিহ্ন (১-২.৯ নম্বর) প্রাপ্তিতে অনেক দুর্বল ভিত্তির বিষয়টি বোঝানো হয়েছে। এক্ষেত্রে পণ্য সরবরাহ গতি বিবেচনায় বাংলাদেশ পেয়েছে ডায়মন্ড চিহ্ন, প্রাপ্ত নম্বর হলো ২। অর্থাৎ বাজারে সরবরাহ গতির প্রেক্ষাপটে মার্কিন ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক দুর্বল।

অন্যদিকে সোর্সিং কস্ট বা ব্যয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রাপ্ত নম্বর ৪ দশমিক ৫। এক্ষেত্রে চিহ্ন হলো বৃত্ত। অর্থাৎ সোর্সিং কস্ট বিবেচনায় বাংলাদেশের সক্ষমতা ভালো। আর কমপ্লায়েন্সের ঝুঁকির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পেয়েছে ২ দশমিক ৫ নম্বর বা ডায়মন্ড চিহ্ন। অর্থাৎ কমপ্লায়েন্স ঝুঁকি বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থা এখনো অত্যন্ত দুর্বল। তবে এ সূচকে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের নম্বর ছিল ১ দশমিক ৫। অর্থাৎ কমপ্লায়েন্স ঝুঁকিতে আগের থেকে ভালো করলেও এ বিষয়টিতে দুর্বলতা রয়ে গেছে। এ সূচক বিবেচনায় বাংলাদেশের চেয়ে ভালো নম্বর পেয়ে এগিয়ে থাকা অন্য দেশগুলো হচ্ছে ভিয়েতনাম, শ্রীলংকা ও মেক্সিকো।

চীনের বিকল্প হিসেবে মার্কিনীরা ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশকে বিকল্প ভাবলেও পণ্যের বৈচিত্র্য বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান অনেক দুর্বল বলেই প্রকাশ পেয়েছে প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে, পণ্য বৈচিত্র্যে চীনের বিকল্প বাজার এখনো তৈরি হয়নি। অন্যদিকে গত ১০ বছরে মার্কিন বাজারে বাংলাদেশের সরবরাহ করা পোশাকের ৬০ শতাংশই ছিল কটন শার্টস ও ট্রাউজার। এক্ষেত্রে প্রতিযোগী ভিয়েতনাম বাংলাদেশ থেকে অনেক এগিয়ে। জরিপে দেখা গেছে বৈচিত্র্যময় পণ্যে চীনের বাজারের মাত্র ১ দশমিক ৭ শতাংশ পারে বাংলাদেশ। অন্যদিকে ভিয়েতনাম পারে ৩৪ শতাংশ। পণ্য বৈচিত্র্য না থাকা বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সক্ষমতাকেও দমিয়ে রাখছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত কমপ্লায়েন্স টেকসই করার বিষয়টি মার্কিন ক্রেতাদের অগ্রাধিকারের বিষয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব ক্ষেত্র উন্নয়নে বিপুল পরিমাণ খরচের পরিকল্পনা রয়েছে বলেও জরিপে জানিয়েছেন ক্রেতা প্রতিনিধিরা। এ বিষয়টিকে বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক বলে মনে করছেন বাংলাদেশের পোশাক শিল্পসংশ্লিষ্টরা।

https://www.dailyinqilab.com/article/224092/