৩১ জুলাই ২০১৯, বুধবার, ৩:৪৪

রাজধানীতে ডেঙ্গুর প্রকোপ

অকার্যকর ওষুধের পেছনে শক্তিশালী সিন্ডিকেট!

দক্ষিণে ওষুধ সরবরাহ করছে উত্তরে কালো তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান

রাজধানীর দুই সিটির ডেঙ্গুজ্বরের জীবাণুবাহক এডিস মশা নিধনে অকার্যকর ওষুধ ক্রয়ে শক্তিশালী সিন্ডিকেটের প্রভাব রয়েছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।

তাদের মতে, সিটি কর্পোরেশনের প্রভাবশালীদের আশীর্বাদপুষ্ট এই সিন্ডিকেট ওষুধ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে। নিুমানের ওষুধ সরবরাহ করায় ইতিমধ্যে আমদানিকারক একটি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে উত্তর সিটি কর্পোরেশন। কিন্তু এই কালো তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানটি দক্ষিণ সিটিতে ওষুধ সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে। আর সিন্ডিকেটভুক্ত আরেকটি প্রতিষ্ঠান উত্তর সিটিতে ওষুধ সরবরাহ করছে।

সংশ্লিষ্টদের আরও অভিযোগ, আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর.বি) এক বছর আগে দুই সিটির মশার ওষুধ কার্যকর নয়- এ মর্মে প্রতিবেদন দিলেও ওই সিন্ডিকেটের কারণেই নতুন ওষুধ আনতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে মুখ খুলেছেন উত্তর সিটি মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। ভবিষ্যতে সিন্ডিকেটভুক্ত দুই প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো ওষুধ নেবে না বলে ঘোষণা দিয়েছেন মেয়র। তবে এই ওষুধ কার্যকর বলে এখনও দাবি করে আসছেন দক্ষিণ সিটির মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন।

জানা যায়, গত অর্থবছরে দুই সিটি কর্পোরেশনে মশক নিধন ওষুধ সরবরাহ করেছে সিন্ডিকেটভুক্ত কোম্পানি লিমিট অ্যাগ্রো প্রডাক্ট এবং ‘নোকন’। ঢাকা দক্ষিণে সরবরাহ করেছে ‘লিমিট অ্যাগ্রো প্রডাক্ট’। এই কোম্পানিটি ১৮ বছর ধরে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনে গড়ে প্রতি বছর প্রায় ৪০ কোটি টাকার মশার ওষুধ সরবরাহ করেছে। আর ‘নোকন’ গত অর্থবছরে উত্তর সিটিতে ওষুধ সরবরাহ করেছে। ইতিমধ্যেই ১১ কোটি টাকার ওষুধ সরবরাহ করেছে নোকন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন মশক নিধনে ভেজাল ওষুধ সরবরাহের অভিযোগে লিমিট অ্যাগ্রো প্রডাক্ট কোম্পানিকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি)। ফলে প্রয়োজনেই সিন্ডিকেটের খপ্পরে থাকা অন্য কোম্পানি ‘নোকন’ থেকে মশক নিধন ওষুধ কিনতে হয়েছে ডিএনসিসিকে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে ডিএনসিসির কালো তালিকাভুক্ত লিমিট অ্যাগ্রো প্রডাক্ট কোম্পানির ‘ভেজাল ওষুধ’ ক্রয় করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি)। আর এ ওষুধ ক্রয়ের ক্ষেত্রে ডিএনসিসি উন্মুক্ত দরপত্র আহবান করলেও ডিএসসিসি সেটা করছে না।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৫ সালের ৫ অক্টোবর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের এক বিজ্ঞপ্তিতে দেশে ওষুধ আমদানির বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়। পেস্টিসাইড কারিগরি উপদেষ্টা কমিটি (পিটাক) সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক কৃষিকাজে ব্যবহার্য ও জনস্বাস্থ্যে ব্যবহার্য বালাইনাশক দ্রব্যাদির নতুন রেজিস্ট্রেশনের জন্য কিছু নির্দেশনা প্রদান করা হয়। এখানে প্রডাক্টের তথ্য-উপাত্ত, কারিগরি মূল্যায়ন, মিশ্রণের পরিমাণ এবং মূল্যায়ন, ভ্যাট সার্টিফিকেট, কোম্পানি মালিকের জাতীয় পরিচয়পত্র, ব্যাংকের সচ্ছলতা সনদ, এনওসি প্রডাক্ট নমুনা মূল্যায়ন এবং বাংলাদেশ ক্রপ প্রটেকশন অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিপিএ) নতুন নিবন্ধন থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়। কিন্তু এই বিজ্ঞপ্তিকে বিধিমালা হিসেবে প্রচার করে সিন্ডিকেটে জিম্মি করে ফেলা হয়েছে দেশের কীটনাশক আমদানি খাতকে। উল্লিখিত দুই আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের হাতে রয়েছে ওষুধ আমদানির চাবিকাঠি। নতুন কোনো কোম্পানিকে এ ধাপগুলো পার করে ওষুধ আমদানির সুযোগ দেয় না এই সিন্ডিকেট।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, এ মুহূর্তে যে ওষুধগুলো ছিটানো হচ্ছে, সেগুলো আইসিডিডিআর,বি ঘোষিত অকার্যকর ওষুধ। নতুন ওষুধ কেনার আগ পর্যন্ত এগুলো ব্যবহার করা হবে। এ মুহূর্তে কোনো বিকল্প না থাকায় সংশ্লিষ্টরা ওষুধগুলোকে কার্যকর প্রমাণের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। যদিও এখন পর্যন্ত কোনো পরীক্ষায় এ ওষুধ কার্যকর বা মানসম্পন্ন প্রমাণিত হয়নি।

জানা যায়, ১৯৯০-৯৫ সালে অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনে মশার ওষুধ সরবরাহ করত এসিআই। ২০০০ সালের পর ওষুধ সরবরাহকারী হিসেবে দরপত্র জমা দেয় লিমিট এগ্রো প্রডাক্ট। এসিআইয়ের সরবরাহ করা ওষুধের মূল্যের অর্ধেকে দরপত্র জমা দিয়ে কাজ পায় প্রতিষ্ঠানটি। এরপর টানা ১৮ বছর ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনেই মশার ওষুধ সরবরাহ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৮ সালে লিমিট অ্যাগ্রো প্রডাক্টের সরবরাহ করা ওষুধের মান পরীক্ষা করা হয়। মানে উত্তীর্ণ হতে না পারায় ওই বছরই কালো তালিকাভুক্ত করে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন। এরপর ওষুধ সরবরাহের কাজ পায় পাকিস্তানভিত্তিক কোম্পানি নোকন। এক বছর ধরে এ প্রতিষ্ঠানটিই মশার ওষুধ সরবরাহ করছে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে। তবে এ প্রতিষ্ঠানের সরবরাহ করা মশার ওষুধের মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

সোমবার সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, ১৭ কোটি মানুষের দেশে দুটি কোম্পানি ওষুধ আনবে, বাকিরা কেন পারবে না? একটি বা দুটি কোম্পানির সিন্ডিকেটের কারণে আজ পুরো জাতির কাছে আমরা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছি। আমদানিকারক থাকলেও তারা ওষুধ আমদানি করতে পারছে না। দুটি কোম্পানি পুরো সিস্টেমকে ম্যানেজ করে রেখেছে। এভাবে চলতে পারে না।

তিনি আরও বলেন, একটা বিজ্ঞপ্তিকে বিধি বানিয়ে এতদিন ওষুধ আমদানিতে সিন্ডিকেট তৈরি করা হয়েছে। আমরা এই সিন্ডিকেট ভাঙব। জরুরি প্রয়োজনে সরাসরি ওষুধ আমদানি করবে সিটি কর্পোরেশন। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় না গিয়ে ইনডেমনিটির মাধ্যমে এই সিদ্ধান্ত যদি গ্রহণ করতে হয় তবে আমরা সে চেষ্টাও করব।

এদিকে মঙ্গলবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন সাংবাদিকদের বলেছেন, বর্তমানে মশার যে ওষুধ রয়েছে, সেটি শতভাগ অকার্যকর এমন নয়, এটারও কার্যকারিতা রয়েছে। কিছু অংশ অকার্যকর। তাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে নতুন ওষুধ আমদানি করা হবে।

এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোস্তাফিজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন কোনো মশক নিধন ওষুধ ক্রয়ের ক্ষেত্রে কোনো সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি নয়।’ তাহলে অকার্যকর ও কালো তালিকাভুক্ত ওষুধ কেনা হল কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘ডিএসসিসি কোনো অকার্যকর ও এ সংস্থার কালো তালিকাভুক্ত কোম্পানির ওষুধ কেনেনি। আর ডিএসসিসির বর্তমান ব্যবহৃত ওষুধ কার্যকর।’ সিন্ডিকেটের দাপট না থাকলে ডিএসসিসি মশক নিধন ওষুধ ক্রয়ের ক্ষেত্রে উন্মুক্ত দরপত্র আহবান করেনি কেন- এমন প্রশ্নের জবাব দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন এই কর্মকর্তা।

এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম সোমবার যুগান্তরকে বলেন, ‘ঢাকা উত্তর সিটি কোনো কোম্পানির ওষুধ নিুমানের পেলে তারা সেই প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করতে পারে। কিন্তু ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ওই কোম্পানি নিুমানের ওষুধ না দিলে ওই প্রতিষ্ঠানের ওষুধ নিতে তো কোনো সমস্যা নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘দুই সিটি কর্পোরেশন মশক নিধনে যেসব ওষুধ ব্যবহার করছে, সেসব অকার্যকর বলে যে কথা বলা হচ্ছে সেটা সঠিক নয়। দুই সিটির ব্যবহৃত ওষুধে মশা মরছে বলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের চিত্র এখনও অনেকাংশে ভালো।’

অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে ‘নোকন’ লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার মো. খালিদ হোসেন মঙ্গলবার সকালে টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, আমাদের সরবরাহ করা ওষুধ ভালো। আইসিডিডিআর,বি উদ্দেশ্যমূলকভাবে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এ ব্যাপারে তদন্ত হওয়া উচিত। আরেক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমরা কোনো সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত নই। সরবরাহকৃত ওষুধ নিরপেক্ষভাবে পরীক্ষা করলে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে।

আরেক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান লিমিট অ্যাগ্রো প্রডাক্ট লিমিটেডের পরিচালক মিজানুর রহমানের বক্তব্য নিতে তার মোবাইল ফোন নম্বরে মঙ্গলবার একাধিকবার ডায়াল করা হলেও তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পাশাপাশি একই নম্বরে এসএমএস (ক্ষুদে বার্তা) পাঠানো হলেও রাত ৮টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/205169