প্রাণসহ ১৩ কোম্পানির দুধ বিক্রি বন্ধ। ফাইল ছবি
৩০ জুলাই ২০১৯, মঙ্গলবার, ১১:৩৪

প্রাণসহ ১৩ কোম্পানির দুধ বিক্রি বন্ধ, অভিযানে নেমেছে বিএসটিআই

আজ থেকে বাজার মনিটরিং করবে ভোক্তা অধিদফতর * মিল্কভিটার দুধ বিক্রিতে বাধা নেই * গুঁড়োদুধে কি আছে তাও দেখা দরকার-আদালত

প্রাণসহ ১৩ কোম্পানির পাস্তুরিত দুধ উৎপাদন, সরবরাহ ও বিপণন বন্ধে সোমবার থেকে মাঠে নেমেছে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডাস অ্যান্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশন (বিএসটিআই)। প্রথম দিন প্রতিষ্ঠানটি কোনো ধরনের আইনগত ব্যবস্থা নেয়নি।

এদিকে আজ (মঙ্গলবার) থেকে তদারকি কার্যক্রমে মাঠে নামছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। এছাড়া মাঠে নামতে যাচ্ছে সরকারের অপর সংস্থা নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ।

জানতে চাইলে বিএসটিআইর পরিচালক এসএম ইসাক আলী সোমবার যুগান্তরকে বলেন, ‘হাইকোর্টের আদেশ পাওয়ার পরই আমরা বাজার মনিটরিং করা শুরু করেছি।

প্রথমদিন (সোমবার) রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে প্রাণসহ ১৩ কোম্পানির পাস্তুরিত দুধ বিক্রি বন্ধে তাগিদ দেয়া হয়েছে। এ সময় ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তবে মঙ্গলবার (আজ) বিএসটিআইর পক্ষ থেকে আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’

ক্ষতিকারক কেমিক্যালের কারণে সম্প্রতি প্রাণসহ ১৪টি কোম্পানির পাস্তুরিত দুধ উৎপাদন ও বিক্রি নিষিদ্ধ করেছে উচ্চ আদালত। তবে সোমবার এই দায় থেকে মিল্কভিটাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। ফলে নিষিদ্ধ কোম্পানির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩টি।

নিয়ম অনুসারে আদালতের এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রাথমিক দায়িত্ব সরকারের তিন সংস্থার। এগুলো হল- বিএসটিআই, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। সংস্থাগুলো ইতিমধ্যে তৎপর হয়েছে।

জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক আবদুল জব্বার মণ্ডল বলেন, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি মিল্কভিটা পাস্তুরিত দুধ উৎপাদন ও বিক্রির ওপর হাইকোর্টের জারি করা নিষেধাজ্ঞা আট সপ্তাহের জন্য স্থগিত করেছেন সুপ্রিমকোর্টের চেম্বার আদালত।

তবে সরকারের মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসটিআইয়ের অনুমোদিত প্রাণসহ বাকি ১৩টি কোম্পানির পাস্তুরিত দুধ উৎপাদন, সরবরাহ ও বিপণন হাইকোর্টের আদেশ অনুযায়ী পাঁচ সপ্তাহ বন্ধ থাকছে।

তাই ওইসব কোম্পানি যাতে তাদের পাস্তুরিত দুধ উৎপাদন, সরবরাহ ও বিপণন করতে না পারে এজন্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে মঙ্গলবার (আজ) থেকে বাজার তদারকি শুরু করা হবে। যেখানে এসব কোম্পানির দুধ পাওয়া যাবে, কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। কারণ হাইকোর্ট যে আদেশ দিয়েছেন তদারকি সংস্থা হিসেবে আমাদের সার্বিকভাবে মনিটরিং করা কর্তব্য।’

বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য (অতিরিক্ত সচিব) মো. মাহবুব কবির বলেন, হাইকোর্ট যেসব পাস্তুরিত দুধ উৎপাদন, সরবরাহ ও বিপণন বন্ধ করার আদেশ দিয়েছেন সে সম্পর্কে আমরা অবহিত আছি। তবে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কবে থেকে বাজার তদারকিতে নামবে তা এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। আজ মঙ্গলবার (আজ) এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

মিল্কভিটার দুধ উৎপাদনে বাধা নেই : মিল্কভিটার পাস্তুরিত দুধ উৎপাদন ও বিক্রির ওপর হাইকোর্টের জারি করা নিষেধাজ্ঞা আট সপ্তাহের জন্য স্থগিত করেছেন চেম্বার আদালত। মিল্কভিটার এক আবেদনের শুনানি করে চেম্বার বিচারপতি মো. নুরুজ্জামান সোমবার এই আদেশ দেন। এর ফলে বাজারে আপাতত মিল্কভিটার দুধ বিক্রিতে কোনো বাধা থাকছে না।

তবে সরকারের মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসটিআইয়ের অনুমোদিত প্রাণসহ বাকি ১৩টি কোম্পানির পাস্তুরিত দুধ উৎপাদন, সরবরাহ ও বিপণন হাইকোর্টের আদেশ অনুযায়ী পাঁচ সপ্তাহ বন্ধই থাকছে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। চেম্বার আদালতে মিল্কভিটার পক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। সঙ্গে ছিলেন মহিউদ্দিন মো. হানিফ ফরহাদ।

আদেশের পর মহিউদ্দিন মো. হানিফ বলেন, মাথাব্যথার জন্য আমরা মাথা কেটে ফেলতে পরি না। হাইকোর্ট রোববার যে আদেশ দিয়েছেন, তাতে খামারিরা ও উৎপাদকরা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বেন, বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বেন। আমরা মিল্কভিটার ক্ষেত্রে হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত চেয়েছিলাম। আমরা বলেছি, দুধে অ্যান্টিবায়োটিক বা অন্য সমস্যা থাকলে তা গ্র্যাজুয়ালি দূর করতে হবে।

মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর উপাদান থাকায় রোববার প্রাণসহ ১৪ কোম্পানির পাস্তুরিত দুধ উৎপাদন ও বিপণন পাঁচ সপ্তাহের জন্য বন্ধের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে এসব দুধ ক্রয় ও মজুদ করা থেকেও বিরত থাকতে বলা হয়। বিএসটিআইয়ের লাইসেন্সধারী এই ১৪ কোম্পানির উৎপাদিত দুধে মানবদেহের জন্য ক্ষতির অ্যান্টিবায়োটিক ও ধাতব উপাদানের (সিসা) উপস্থিতি থাকায় আদালত এ নিষেধাজ্ঞা দেন।

বাজারে থাকা পাস্তুরিত দুধ চারটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে পরীক্ষার প্রতিবেদন আমলে নিয়ে রোববার বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুলসহ এ আদেশ দেন।

হাইকোর্টের নির্দেশে যে ১৪টি কোম্পানির দুধ উৎপাদন বন্ধ করা হয়, সেগুলো হল- ১. আফতাব মিল্ক অ্যান্ড মিল্ক প্রডাক্ট লিমিটেডের আফতাব, ২. আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের ফার্মফ্রেশ মিল্ক, ৩. আমেরিকান ডেইরি লিমিটেডের মো, ৪. বাংলাদেশ মিল্ক প্রডিউসারস কো অপারেটিভ উইনিয়ন লিমিটেডের মিল্ক ভিটা, ৫. বারো আউলিয়া ডেইরি মিল্ক অ্যান্ড ফুডস লিমিটেডের ডেইরি ফ্রেশ, ৬. ব্র্যাক ডেইরি অ্যান্ড ফুড প্রজেক্টের আড়ং ডেইরি, ৭. ড্যানিশ ডেইরি ফার্ম লিমিটেডের আয়রান, ৮, ইছামতি ডেইরি অ্যান্ড ফুড প্রডাক্টের পিউরা, ৯. ইগলু ডেইরি লিমিটেডের ইগলু, ১০. প্রাণ ডেইরি লিমিটেডের প্রাণ মিল্ক, ১১. উত্তরবঙ্গ ডেইরির মিল্ক ফ্রেশ, ১২. শিলাইদহ ডেইরির আল্ট্রা, ১৩. পূর্ববাংলা ডেইরি ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের আরওয়া, ১৪. তানিয়া ডেইরি এন্ড ফুড প্রডাক্টস সেইফ।

এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ১৪ জুলাই বাজারে থাকা বিএসটিআই অনুমোদিত সব কোম্পানির পাস্তুরিত দুধ পরীক্ষার নির্দেশ দেন। এসব কোম্পানির দুধে অ্যান্টিবায়োটিক, ডিটারজেন্ট, ফরমালিন, ব্যাকটেরিয়া ও ফরমালিন আছে কিনা তা পরীক্ষা করে চারটি গবেষণাগারকে এক সপ্তাহের মধ্যে আলাদাভাবে প্রতিবেদন দিতে বলেন আদালত।

জনস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর), ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডাইরিয়াল ডিজিজ রিসার্চ, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) ও সাভারের বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইন্সটিটিউটের গবেষণাগারে বাজারের এসব দুধ স্বাধীনভাবে পরীক্ষা করতে বলা হয়।

সেই সঙ্গে দুধে অ্যান্টিবায়োটিক বা ডিটারজেন্ট আছে কিনা তা পরীক্ষার সক্ষমতা অর্জন করতে বিএসটিআইয়ের ল্যাবরেটরির কত সময় ও অবকাঠামো প্রয়োজন সে বিষয়ে একটি কর্মপরিকল্পনা আদালতে জমা দিতে বলা হয়।

সেই প্রতিবেদন রোববার আদালতে জমা পড়লে দেখা যায়, একটি পরীক্ষায় ১৪ কোম্পানির দুধেই মানবদেহের জন্য সহনীয় মাত্রার সিসা পাওয়া গেছে। আরেকটি পরীক্ষায় ১৪ কোম্পানির দুধেই পাওয়া গেছে অ্যান্টিবায়োটিক।

বিএসটিআইয়ের পক্ষ থেকে আদালতকে জানানো হয়, দুধে অ্যান্টিবায়োটিক বা ডিটারজেন্ট আছে কিনা তা তাদের ল্যাবে পরীক্ষার সক্ষমতা অর্জন করতে জানুয়ারি মাস পর্যন্ত সময় লাগবে। এরপর আদালত ১৪ কোম্পানির পাস্তুরিত দুধে পাঁচ সপ্তাহের নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রুল জারি করেন।

‘গুঁড়োদুধে কি আছে তাও দেখা দরকার’ : এদিকের হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ বলেছেন, আমরা শুধুই তরল দুধ নিয়ে ব্যস্ত আছি। গুঁড়োদুধে কি আছে তা দেখা দরকার। আমরা চাই না, দেশীয় দুধ বন্ধ হওয়ার কারণে বিদেশি গুঁড়োদুধে বাজার সয়লাব হয়ে যাক। বিদেশি গুঁড়োদুধ বাংলাদেশের বাজার দখল করুক এটা আমাদের কাম্য নয়। বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কেএম হাফিজুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ সোমবার এই মন্তব্য করেন।

আদালত বলেন, দেশীয় খামারিদের দুধ বন্ধ হোক, এটা চাই না। আমাদের চাওয়া, দেশীয় খামারিদের দুধের উৎপাদনের বিস্তার আরও বাড়ুক। তবে সেটা হতে হবে নিরাপদ ও মানসম্পন্ন। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করতে হবে। কোনোভাবেই তা জনস্বাস্থ্যের জন্য অনিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ না হয়।

আমাদের চাওয়া, দেশে মানুষ যেন ভালো থাকে। এ সময় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার ফরিদুল ইসলাম বলেন, গুঁড়োদুধ পরীক্ষার নির্দেশ দিতে পারেন আদালত। আদালত বলেন, এটা দেখার দায়িত্ব আপনাদের ও বিএসটিআইর। আদালতের কেন আদেশ দিতে হবে? আইনে আপনাদেরই তো ক্ষমতা দেয়া আছে।

আপনারা কেন সেটা পরীক্ষা করছেন না? জবাবে এ আইনজীবী বলেন, আমরা পরীক্ষা করতে গেলে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যবসায়ীরাই প্রশ্ন তুলবে যে কেন আমরা তা পরীক্ষা করছি। আদালত আদেশ দিলে সেই প্রশ্ন তোলার সুযোগ থাকবে না।

শুনানিতে বিএসটিআইয়ের আইনজীবী ব্যারিস্টার সরকার এম আর হাসান দুধের মান তদারকি করতে বিশেষজ্ঞ কমিটি বা কমিশন গঠন করা যেতে পারে বলে মত দেন।

রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক বলেন, দুধ নিয়ে গবেষণা করায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আ ব ম ফারুককে হুমকি দিয়েছে কোম্পানিগুলো। তারা লিগ্যাল নোটিশও দিয়েছে বলে আদালতের নজরে আনেন তিনি। পরে আদালত আগামী ২০ অক্টোবর আদেশের দিন নির্ধারণ করেন।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/204773/