২৯ জুলাই ২০১৯, সোমবার, ১২:২২

নিরাপদ সড়ক এখনও সুদূরপরাহত

মীম রাজীবের মৃত্যুর ১ বছর

আজ ২৯ জুলাই। এক বছর আগে এই দিনে রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বেপরোয়া বাসের চাপায় প্রাণ হারায় দুই কলেজ শিক্ষার্থী রাজীব ও মীম। তাদের মৃত্যুর প্রতিবাদে ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে সারাদেশে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। ওই আন্দোলনের মুখে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ পাস হলেও ১০ মাসেও তা কার্যকর হয়নি। পরিবহন খাতসংশ্নিষ্টরা বলছেন, নজিরবিহীন ওই আন্দোলনের পরও সড়ক নিরাপদ হয়নি। বলার মতো পরিবর্তন আসেনি। সড়কে নিরাপত্তা সুদূর পরাহত রয়ে গেছে।

৯ দফা দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিলেন শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি ছিল- সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রেখে সড়ক পরিবহন আইন করা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল বন্ধ করা এবং লাইসেন্সবিহীন চালক গাড়ি চালাতে পারবে না। যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেছেন, শেষের দুই দাবিও পূরণ হয়নি। সড়কে ৩৮ লাখ গাড়ি থাকলেও লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালকের সংখ্যা এখনও অর্ধেক।

পাঁচ লাখের বেশি গাড়ির ফিটনেস সনদ নেই।

পরিবহন খাতসংশ্নিষ্টরা বলছেন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল প্রায় আট বছর ঝুলে থাকা সড়ক পরিবহন আইন পাস। আন্দোলনের প্রথম সপ্তাহেই মন্ত্রিসভার অনুমোদন পায় সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮। সংসদে পাসের পর গত বছরের অক্টোবরে গেজেট হয়। কিন্তু বিধিমালা না হওয়ায় সড়কে অপরাধের জেল-জরিমানা বাড়িয়ে করা আইনটি কার্যকর হয়নি।

সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রের খবর, পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের চাপের কারণে বিধিমালা হচ্ছে না। পরিবহন নেতারা চান, জেল-জরিমানা কমিয়ে আইনটি শিথিল করা হোক। সড়কে ইচ্ছাকৃত দুর্ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডের সাজার পরিবর্তন চান তারা।

গত ১৭ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে প্রধান করে সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়নে তিন মন্ত্রীকে নিয়ে কমিটি হয়। কিন্তু ছয় মাস পরও বলা যাচ্ছে না, কবে আইনটি বাস্তবায়ন হবে। কমিটির সদস্য রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন জানিয়েছেন, তারা ইতিমধ্যে দুটি বৈঠক করেছেন। আরও বৈঠক করতে হবে। অংশীজনদের (স্টেকহোল্ডার) মতামত নেওয়ার পর কমিটি সিদ্ধান্ত নেবে, কীভাবে আইনটি বাস্তবায়ন করা হবে। পরিবহন নেতাদের দাবি অনুযায়ী আইনে পরিবর্তন আসবে কিনা- এ প্রশ্নে রেলমন্ত্রী বলেন, যে কোনো সিদ্ধান্তের আগে সবার মতামত নেওয়া হবে।

পরিবহন খাতসংশ্নিষ্টরা বলছেন, সবার মতামত নিয়েই আইনটি করা হয়েছিল। সংসদে পাস হয় আলোচনার পর। আট বছরে আইনটির চার দফা খসড়া হয়। নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের কারণে পাসের সময় বাধা দিতে পারেননি পরিবহন নেতারা। এখন পরিস্থিতি শান্ত হওয়ায় বাধা দিচ্ছেন। বিআরটিএ সূত্র জানিয়েছে, বিধিমালা প্রণয়নে আরও বছরখানেক লাগবে। পরিবহন নেতাদের সঙ্গে সমঝোতার আগে বিধিমালার আলোর মুখ দেখার সম্ভাবনা নেই।

সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি আবদুর রহিম বক্স দুদু বলেছেন, আইনের কিছু দিক খুব কঠোর। এত কঠোর সাজার বোঝা মাথায় নিয়ে শ্রমিকরা গাড়ি চালাতে পারবেন না। সড়কে আইন ভঙ্গে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। একজন শ্রমিকের পক্ষে তা দেওয়া সম্ভব নয়। তাই তারা চান জেল-জরিমানা কমিয়ে বাস্তবসম্মত করা হোক।

রাজধানীতে বেপরোয়া বাস চলাচলের প্রধান কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা চিহ্নিত করেছেন চুক্তিতে বাস চালানোকে। আন্দোলনের সময় বেপরোয়া চলাচল বন্ধে বাস চুক্তিতে চালানো বন্ধের ঘোষণা দিয়েছিলেন পরিবহন মালিকরা। কিন্তু এক বছর পরেও এ ঘোষণা বাস্তবায়ন হয়নি। প্রায় শতভাগ বাস এখনও চুক্তিতে চলছে। ফলে যাত্রী পেতে প্রতিযোগিতাও চলছে সড়কে। সরেজমিন দেখা যায়, কাউন্টার সার্ভিস ছাড়া আর সব বাস চুক্তিতে চলে। সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেছেন, অনেক বাস চুক্তি ছাড়াই চলছে। কিন্তু বহু দিন থেকে চলে আসা ব্যবস্থার বদল একদিনেই সম্ভব নয়।

আন্দোলনের দাবি অনুযায়ী, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচলও বন্ধ হয়নি। সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) এখনও চোখের দেখায় ফিটনেস সনদ দেয়। সংস্থাটির একাধিক কর্মকর্তা সমকালকে বলেছেন, মোটরযান পরিদর্শকস্বল্পতার কারণে একটি গাড়ির ফিটনেস সনদ দিতে এক মিনিটের মতো সময় পাওয়া যায়। এই সময়ের মধ্যে গাড়ি পরীক্ষার সুযোগই পাওয়া যায় না।

সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্য কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেছেন, এত বড় একটি আন্দোলনের পর সড়কে যতটা পরিবর্তন আসা উচিত ছিল, তার কিছুই আসেনি। সড়কের নিরাপত্তায় বহু সুপারিশ করা হলেও তা কার্যকর হয়নি।

আন্দোলনের পর সড়কের নিরাপত্তায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ১৭ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু যত্রতত্র যাত্রী তোলা, স্টপেজ ছাড়া অন্যত্র বাসের দরজা বন্ধ রাখার নির্দেশনা কাজে আসেনি। গত বছরের ১৮ আগস্ট জারি করা নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, মহাসড়কে চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট পরতে হবে। এক মাসের মধ্যে রাজধানীর সব মোড়ে জেব্রা ক্রসিং চিহ্নিত করা ও ট্রাফিক সিগন্যাল কার্যকর করার নির্দেশনা থাকলেও এক বছরেও তা হয়নি।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেছেন, আন্দোলনে মোটরসাইকেল চালক ও আরোহীর হেলমেট পরা ছাড়া আর কোনো দৃশ্যমান উন্নতি নেই। অন্যান্য ক্ষেত্রে পরিস্থিতি যা ছিল তাই আছে।

সড়কের নিরাপত্তায় গত ফেব্রুয়ারিতে সাবেক নৌমন্ত্রী শাজাহান খান এমপির নেতৃত্বে কমিটি করা হয়। এ কমিটি গত এপ্রিলে ১১১ দফা সুপারিশ করেছে। চার মাস হতে চললেও সেগুলো বাস্তবায়নের খবর নেই। আন্দোলনের পর গত বছরের সেপ্টেম্বরে ১৯ দফা সিদ্ধান্ত হয় সড়ক নিরাপত্তা উপদেষ্টা কাউন্সিলে। সেগুলোও বাস্তবায়ন হয়নি।

গত বছর ২৯ জুলাই দুপুরে বিমানবন্দর সড়কে পাল্লা দিয়ে যাত্রী ওঠানোর সময় রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের ১৪ শিক্ষার্থীকে চাপা দেয় জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাস। এতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন আবদুল করিম রাজীব ও দিয়া খানম মীম। আহত হন ১২ জন।

https://samakal.com/capital/article/19072439/