২৮ জুলাই ২০১৯, রবিবার, ৩:৩১

আস্থার সংকটে শেয়ারবাজার

অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে নিম্নে রয়েছে শেয়ারবাজারের বর্তমান মূল্যস্তর। কিছু কোম্পানি নামমাত্র টিকে আছে। অভিহিত মূল্যের নিচে নেমে এসেছে উল্লেখযোগ্য কোম্পানির শেয়ারের দাম। এসব কারণে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে গত ৫ বছরে লাখো বিনিয়োগকারী পথে বসেছে। ৫০ টাকার শেয়ারের দাম নেমে এসেছে ২ টাকায়। ফলে হাওয়ায় মিশে গেছে বিনিয়োগকারীদের পুঁজি। যারা মার্জিন ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছে, তারা পুঁজি হারানোর পরও বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ঋণগ্রস্ত। শুধু ব্যক্তি বিনিয়োগকারী নয়, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরও রয়েছে এ সমস্যায়। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের ইকুইটি নেতিবাচক। ফলে আর্থিক সংকটে স্টক এক্সচেঞ্জ ও ব্রোকারেজ হাউসে প্রতিনিয়ত জনবল ছাঁটাই হচ্ছে। বেশ কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউস বন্ধ হওয়ার পথে। তবে একক সপ্তাহ হিসেবে গত সপ্তাহে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মূল্যসূচক ৯১ পয়েন্ট কমেছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ সমস্যার জন্য দায়ী বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট। উত্তরণের পথ হল সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে দায়ীদের বিচার করতে হবে। জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, শেয়ারবাজারের সংকট একদিনের নয়। অনেক দিন থেকে চলে আসছে। তিনি বলেন, যে যেভাবেই বিশ্লেষণ করুক, মূল সমস্যা হল এই বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা নেই। এই আস্থা ফিরে আনতে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিচার করার মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের নিশ্চয়তা দিতে হবে, কারসাজির মাধ্যমে কেউ তার পুঁজি হাতিয়ে নিলে তার বিচার হবে।

গত কয়েক বছরে বাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে, এমন ৫০টি কোম্পানিটির শেয়ারের নিয়ে যুগান্তরের পক্ষ থেকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে কোম্পানিগুলো তালিকাভুক্তির পর প্রথম দিনে যে শেয়ার মূল্য ছিল, মঙ্গলবার পর্যন্ত ২৫ ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। ২০১৩ সালে বাজারে তালিকাভুক্ত হয় ফ্যামিলি টেক্সটাইল। লেনদেন শুরুর দিন প্রতিষ্ঠানটির সর্বোচ্চ দাম ছিল ৪৮ দশমিক ৫০ টাকা। মঙ্গলবার তা ২ দশমিক ৮ টাকায় নেমে এসেছে। ২০১৫ সালে তালিকাভুক্ত হয় সিএনএ টেক্সটাইল। এসব শুরুর দিন প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দাম ছিল ২২ টাকা। মঙ্গলবার পর্যন্ত তা ২ টাকায় নেমে এসেছে। টুংহাই নিটিং ২৮ টাকা থেকে ২ টাকায়, ফারইস্ট ফাইন্যান্স ১৯ থেকে ৩ টাকায়, জেনারেশন নেক্সট ৪৪-৪ টাকা, অ্যাপোলো ইস্পাত ৩৯ থেকে ৫ টাকা, জাহিন টেক্সটাইল ৪৬ থেকে ৭ টাকা, জাহিন স্পিনিং ২৫ থেকে ৮ টাকা, খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ৭৭ থেকে ৯ টাকা, অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ ৪৯ থেকে ৯ টাকা, পদ্মা লাইফ ১৬৩ টাকা থেকে ২২ টাকায়, দেশবন্ধু পলিমার ৭৪ টাকা থেকে ১২টাকায়, সলভো কেমিক্যাল ৬৯ থেকে ১৪ টাকায়, ফার কেমিক্যাল ৫৩ থেকে ৯ টাকায়, মোজাফফর স্পিনিং ৪৬ থেকে ১০ টাকা, সাইফ পাওয়ার ৭২-১৬ টাকা, ন্যাশনাল ফিড ৪৩-১০ টাকা, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড ৬৩-১৫, এমারেল্ড ওয়েল ৫০-৯, ওয়াইমেক্স ১১২-২৮, সেন্ট্রাল ফার্মা ৩৮-১০, আর্গন ডেনিম ৮২-২৩, জিএসপি ফাইন্যান্স ৫৩ থেকে ১৫, ফারইস্ট নিটিং ৪৬-১৫, সান লাইফ ইন্স্যুরেন্স ৮৩-২৫, খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং ৩৮-১২, হামিদ ফেব্রিকস ৫৭-১৯, আরডি ফুড ৩৮-১২, আমরা নেটওয়ার্ক ১৩৯-৪৮, ইয়াকিন পলিমার ৩২-১০, গ্লোবাল হেভিকেমিক্যাল ১০০-৩৭, বারাকা পাওয়ার ৭৩-২৬, গোল্ডেন হারভেস্ট ৭৭-২৯, আমান ফিড ৯৯-৪০, ওরিয়ন ফার্মা ৭৫-৩১, এএফসি এগ্রোকেমিক্যাল ৬৫-২৮, ইন্ট্রাকো রিফিউলিং স্টেশন ৪৬-২১, বেঙ্গল উইনসোর ৫৫-২৩, জিপিএইচ ইস্পাত ৭৩-৩৩, আমান কটন ৭৫-৩২, এমআই সিমেন্ট ১৩৩-৬০, এসএস স্টিল ৫১-৩২, ইন্দোবাংলা ফার্মা ৪৫-২২, বসুন্ধরা পেপার মিল ১৩১-৬৪, তসরিফা ইন্ডাস্ট্রিজ ৩৬-১৮, এনভয় টেক্সটাইল ৬২-৩১, বাংলাদেশ বিল্ডিং সিস্টেম ৪৮-২৬, আরএসআরএম স্টিল ৭৮-৪১, প্যাসেফিক ডেনিম ২৭-১৪, ইভিন্স টেক্সটাইল ২২-১১ এবং নাহি অ্যালুমিয়ামের শেয়ারের দাম ৮২ থেকে ৪৮ টাকায় নেমে এসেছে।

সামগ্রিক বিবেচনায় দেখা গেছে অধিকাংশ মৌলভিত্তি উপেক্ষা করে অতিমূল্যায়িত হয়ে এসব কোম্পানির বাজারে এসেছিল। কোম্পানিগুলো ইস্যু ম্যানেজারকেন্দ্রিক একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজারে আসে। বাজার থেকে বেশি টাকা নেয়ার জন্য শুরুতে শেয়ার পেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি করে। এরপর মূলধন বাড়িয়ে বাজার থেকে বেশি টাকা নেয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেয়া হয় মাত্রাতিরিক্ত প্রিমিয়াম। নিয়ম অনুসারে তালিকাভুক্তির পর পেসমেন্টের শেয়ারে এক বছরে লকইন (বিক্রি নিষিদ্ধ) দেয়া থাকে। এই সময়ের মধ্যে পেসমেন্টের শেয়ার বিক্রি করা যায় না। কিন্তু এক্ষেত্রে ইস্যু ম্যানেজার সাধারণত কিছু ব্রোকারেজের সঙ্গে চুক্তি করে, অন্তত এক বছর শেয়ারটির দাম ধরে রাখতে হবে। এরপর লকইনের সময় শেষে শেয়ার ফ্রি হলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে সিন্ডিকেট কেটে পড়ে। এভাবে দুর্বল কোম্পানির মাধ্যমে বাজার থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। এছাড়া ব্যাংক ও আর্থিক খাতের নেতিবাচক অবস্থা শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে বিভিন্ন কারণে সৃষ্ট দূরত্বের প্রভাব পড়েছে বাজারে। এসব কারণে সক্রিয় ১৩ লাখ বিও (বেনিফিশারি ওনার) অ্যাকাউন্টের মধ্যে বর্তমানে কয়েক লাখ বিনিয়োগকারীর অ্যাকাউন্ট নেতিবাচক। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বাজারের সাম্প্রতিক পতনের পেছনে বড় কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউসের সংশ্লিষ্টতার প্রাথমিক তথ্য পেয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। বড় মূলধনের ৫টি কোম্পানির শেয়ার বেশি বিক্রি করা হয়েছে। এসব তথ্য খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এসব তথ্য সঠিক হলে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/economics/204089