২৮ জুলাই ২০১৯, রবিবার, ৩:২৬

ঢামেক হাসপাতাল মশার আখড়া!

‘আলোর নিচে অন্ধকার’ নয়। এ যেন আলোর ভেতরেই অন্ধকার। বর্তমানে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। অথচ সেই ঢামেক হাসপাতাল মশা প্রজ্বনন আখড়ায় পরিণত হয়েছে। হাসপাতালের নতুন ভবনের দশ তলা থেকে নিচ তলা পর্যন্ত ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে। ভবনের আশপাশে জমে থাকা ময়লা-নোংরা পানি পরিষ্কার করার বিষয়ে কারও মাথাব্যথা নেই।

ঢামেকে গতকাল সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, হাসপাতালের সাত তলায় বারান্দার পাশে জমে আছে পানি। তার পাশেই শুয়ে আছেন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত কয়েকজন রোগী। এদের একজন ২১ বছর বয়সী সুমন আহমেদ। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের পর গত ২৬ জুলাই শুক্রবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তিনি ভর্তি হন। ওয়ার্ডে বিছানা না পাওয়ায় তার আশ্রয় হয়েছে সাততলার বারান্দায়। সুমনের গার্জেন আব্দুল মাজেদ বলেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে শুক্রবার সুমনের লিখিত পরীক্ষা ছিল। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় পড়ে যাওয়ায় সে পরীক্ষা দিতে পারেনি। হাসপাতালে অনেক রোগী থাকায় আমরা কোনো বেড পাইনি। অধিক রোগী আমাদের বেডের সামনে ছাদের ফাঁকা জায়গায় অনেক ময়লা ও পানি জমে আছে। আমরা এখন আতঙ্কে আছি। ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করেছেন নবম শ্রেণীর তরাগ। তরাগের বাবা জানান, ৪শ’ টাকা ঘুষ দিয়ে বেড পেয়েছিলেন। কিন্তু হাসপাতালের ওয়ার্ডেই মশার যন্ত্রণায় রোগীদের অস্থির থাকতে হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাসপাতালের কয়েকজন ওয়ার্ড বয়ও ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। বাদ যাননি হাসপাতালের সেবিকারাও। ঢামেকের আশপাশে আবর্জনা মশার জন্ম নেয়ায় তারাও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন বলে জানান।

দৃষ্টি দিতেই চোখে পড়লো হাসপাতালের নিচতলা থেকে শুরু করে সামনে-পেছনে সব জায়গায় ময়লার ভাগাড়। ঠিক কবে ময়লাগুলো পরিষ্কার করা হয়েছিল তার ঠিক নেই। হাসপাতালে কর্মরত কয়েকজন পুলিশ সদস্য জানান, এই ময়লা অনেকদিনের। কখনও পরিষ্কার করতে দেখিনি। পরিচ্ছন্নতাকর্মীরাও কখনো ময়লায় হাত দিয়েছেন বলে জানা নেই। ফলে মশার যন্ত্রণায় আমরা অতিষ্ট।

ঢামেকে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা নেয়া রোগীর স্বজনরা জানান, হাসপাতালে নিয়োগ পাওয়া চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের কাজ হলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা করা। কিন্তু তারা একটা কাজেও হাত দেয় না। তারা স্পেশাল ওয়ার্ড বয় হিসেবে কাজ করেন। রোগীর কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অপেক্ষায় থাকেন। রোগী এলেই তাদের কাছে বেড বিক্রী করেন। টাকা ছাড়া ঢামেকে রোগীদের বেড পাওয়া কঠিন।

ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ বক্সের সহকারী ইনচার্জ আব্দুল খান অভিযোগ করে বলেন, আমাদের ক্যাম্পে প্রতিদিন অনেক পানি, ময়লা জমে। ৫/ ৭ দিন বলার পরে সে ময়লা নিয়ে যায়। হাসপাতালর অবস্থা তো আরও বেশি খারাপ। আরেকজন রোগীর আত্মীয় বলেন, হাসপাতাল নিজেই ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত। এখানে রোগীরা চিকিৎসা নেবে কি ভাবে?

কথা হয় মশিউর রহমান নামে এক যুবকের সঙ্গে। তার বাড়ি চাঁদপুরে। গত জুন মাসের তার মা মরিয়ম আক্তারকে হাসপাতালে ভর্তি করেন। তার খাদ্যনালীতে টিউমার ছিল। মায়ের সঙ্গে হাসপাতালেই ছিলেন মশিউর। হাসপাতালে থাকতেই গত ২১ জুলাই জ্বর আসে। জ্বর নিয়ে সেদিনই তার এক আত্মীয়ের বাসায় যায়। সেখান থেকে ২৩ জুলাই রক্ত পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পরে। মশিউর বলেন, হাসপাতাল থেকেই তাকে এডিস মশা কামড়ায়।

ঢামেক হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় প্যাথলজি বিভাগ। সেখানে ডেঙ্গু রোগের পরীক্ষাসহ বিভিন্ন রোগের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পাশেই ব্লাড ব্যাংক। সেখানে গিয়ে দেখা যায় বারান্দায় কয়েকটি এয়ার কন্ডিশনার বসানো। সেখান থেকে অনবরত পানি পরছে। যত্রতত্র ময়লা। হাসপাতালের নতুন ভবনের ওয়ার্ড মাস্টার মো. রিয়াজ বলেন, ময়লা পরিষ্কার করার দিনক্ষণ নেই। ময়লা হলেই পরিষ্কার করা হবে। কিন্তু লোকবল কম থাকায় অনেক সময় ময়লা পরিষ্কার করা হয় না। তবে দুই একদিনের মধ্যেই ময়লা পরিষ্কার করা হবে।

হাসপাতালের পুরনো ভবনেও একই চিত্র চোখে পড়ে। ভবনের দ্বিতীয় তলায় নিউরো সার্জারি ওয়ার্ডের বারান্দায় গিয়ে দেখা যায়, কয়েকটি ময়লার ড্রাম পড়ে আছে। তার মধ্যে পানিও জমে আছে। দেখে মনে হয় অনেক দিন ধরে পরিষ্কার করা হয় না। পাশেই লতাপাতা ঘাসের অভাব নেই। তৃতীয় তলায় কেবিনে গিয়ে দেখা যায় আরো ভয়াবহ দৃশ্য। সেখানে ময়লার ড্রাম, ভাঙা বেডসহ অসংখ্য সিরিঞ্জ পড়ে আছে। ভাঙ্গা বেডগুলোতে পানি জমে আছে।

জানতে চাইলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. বিদ্যুৎকান্তি পাল সাংবাদিকদের বলেন, হাসপাতালে প্রতিদিন প্রচুর রোগী ভর্তি হয়। রোগীর স্বজনরা যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলেন। ময়লা বা পানি পরিষ্কার করার কোনো দিনক্ষণ নেই। পানি কিংবা যে ধরনের ময়লা জমুক না কেন যখনই জমবে তখনই পরিষ্কার করা উচিৎ। অনেক সময় পরিষ্কার করা হলেও একদিন যেতে না যেতেই আবার ময়লা জমে যায়।

https://www.dailyinqilab.com/article/223376/