২৬ জুলাই ২০১৯, শুক্রবার, ৪:৫৩

ধরন পাল্টেছে ডেঙ্গুর

বাড়ছে মৃতের সংখ্যা বিশেষজ্ঞরা উদ্বিগ্ন

জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর গত ১৫ জুলাই ৯ বছর বয়সী তাহমিদকে ঢাকা শিশু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। একদিন পরই তার মৃত্যু হয়। ২৬ বছর বয়সী সেঁজুতি নামে এক নারী ১২ জুলাই জ্বর নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি হন। তিন দিন পর মৃত্যু হয় তার। একইভাবে এক বছর সাত মাস বয়সী আরিয়ানকে ১২ জুলাই সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তারও মৃত্যু হয় তিন দিন পর।

হাসপাতালে ভর্তির আগে তারা বুঝতে পারেননি যে ডেঙ্গু হয়েছে। ভর্তির পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাদের ডেঙ্গু শনাক্ত করা হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্নিষ্ট চিকিৎসক-কর্মকর্তারা। কিন্তু এসব রোগীর কারও শরীরে কোনো র‌্যাশ ছিল না। এমনকি ব্যথাও ততটা প্রকট ছিল না। এ কারণে আক্রান্ত ব্যক্তি কিংবা তাদের স্বজনরা ডেঙ্গু হওয়ার বিষয়টি আগেভাগে জানতে পারেননি।

আগেভাগে কেন ডেঙ্গুর লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে না? চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার ডেঙ্গু ধরন পাল্টেছে। আগে ডেঙ্গু জ্বরের অন্যতম লক্ষণ ছিল শরীরে র‌্যাশ থাকা। কিন্তু চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের শরীরে র‌্যাশ দেখা যাচ্ছে না। জ্বর হওয়ার পরও চিকিৎসকরা বুঝতে পারছেন না। হেমোরেজিক ডেঙ্গু এবার বেশি হচ্ছে। রক্তের প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে। রক্তপাতের ঝুঁকি বেশি থাকায় বেশি মৃত্যু হচ্ছে।

রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিনই হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর ভিড়। অনেক বেসরকারি হাসপাতালে শয্যা ফাঁকা না থাকায় রোগী ভর্তি করা সম্ভব হচ্ছে না। সরকারি হাসপাতালে নির্দিষ্ট ওয়ার্ডের বাইরে বিকল্প ব্যবস্থায় রোগী ভর্তি করা হচ্ছে। ডেঙ্গু রোগী সামলাতে হাসপাতালগুলো হিমশিম খাচ্ছে। সব মিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।

সরকারি হিসাবেও গত পাঁচ বছরের মধ্যে এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ সবচেয়ে বেশি বলে জানানো হয়েছে। গত বছরের জুলাই মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ছিল ৯৪৬ জন। এবার চলতি মাসে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৭ হাজার ১১২ জন আক্রান্ত হয়েছে। গতবার জুন মাসে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ২৯৫। কিন্তু এবার জুন মাসে এক হাজার ৮২৯ জন আক্রান্ত হয়েছে। আগামী আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাস ভয় জাগাচ্ছে। সামনের এই দুই মাস ভরা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্টরা। ডেঙ্গুতে চলতি বছর এ পর্যন্ত ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, মৃতের সংখ্যা ৮।

ডেঙ্গুর ধরন নিয়ে যা বললেন বিশেষজ্ঞরা :এবারের ডেঙ্গুর ভয়াবহতা নিয়ে খোদ বিশেষজ্ঞরাও উদ্বিগ্ন। এই রোগ নিয়ে নতুন করে তারা গবেষণার তাগিদ দিয়েছেন। বিশেষ করে চার ধরনের সেরোটাইপ ডেঙ্গুর (ডিইএনভি-১, ডিইএনভি-২, ডিইএনভি-৩ এবং ডিইএনভি-৪) মধ্যে কোনটির প্রকোপ দেশে বেশি কিংবা কোনটি বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, তা খতিয়ে দেখা জরুরি বলে মনে করছেন অনেকে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (সংক্রামক ব্যাধি) অধ্যাপক ডা. বে-নজীর আহম্মেদ জানান, জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির পর পরীক্ষায় শনাক্ত হলে রোগী কিংবা তার স্বজনকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত বলে জানানো হয়, কিন্তু কোন টাইপের, সেটি শনাক্ত করা হচ্ছে না। গুরুত্বপূর্ণ হলেও এর ধরন নির্ধারণ অত্যন্ত জটিল এবং সব প্রতিষ্ঠানে তা করাও সম্ভব নয়। তবে ধরন নির্ধারণ জরুরি। অন্যথায় রোগীর চিকিৎসাবঞ্চিত হওয়ার ঝুঁকি থাকবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ডেঙ্গু রোগীদের শারীরিক অবস্থা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন অঙ্গ যেমন কিডনি, লিভার, ফুসফুস ও হার্ট আক্রান্ত হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা অকার্যকরও হয়ে পড়ছে। ডেঙ্গুবাহিত এডিস মশা শরীরে কামড় দেওয়ার পর রক্তের মনোসাইটে অনিয়ন্ত্রিতভাবে জীবাণু বংশবিস্তার করে। প্রবহমান রক্তের মাধ্যমে জীবাণু হার্ট, লাং, লিভার ও কিডনিতে প্রবেশ করে অধিক হারে বংশবিস্তার করে এসব গুরুত্বপূর্ণ কোষের কার্যকারিতা নষ্ট করে। বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কোষঝিল্লিতে আক্রমণ করে প্রদাহের সৃষ্টি করে। কিডনির মূত্র উৎপাদনের কার্যকারিতা হ্রাস পায় এবং লিভার অকার্যকর হয়।

ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ আরও বলেন, ডেঙ্গু হার্টের মাংশপেশির বলয় ভেঙে সেখানে আক্রমণ করে কার্যকারিতা হ্রাস করে। এ ছাড়া সেরোটাইপ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ব্যক্তির মস্তিস্কে তীব্র প্রদাহের সৃষ্টি করে। এসব রোগী যথাসময়ে চিকিৎসা না পেলে তাদের মৃত্যু হতে পারে। থেমে থেমে বৃষ্টিপাত হওয়ায় ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বাড়ছে। আগামী দুই মাস তা আরও বাড়তে পারে। তাই শরীরে কোনো ধরনের জ্বর অনুভব করলে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ওষুধ সেবন করতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মাহমুদুর রহমান বলেন, সেরোটাইপ ডেঙ্গু এবং বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি গত বছর থেকেই লক্ষ্য করা গেছে। এবার তা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। তবে বিষয়টি এখনও নতুন, তাই স্বচ্ছ ধারণার জন্য অধিকতর গবেষণা প্রয়োজন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, দ্বিতীয়বারের মতো কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে তার ঝুঁকি বেড়ে যায়। প্রাথমিক ইনফেকশন ডিইএনভি-১ এর মাধ্যমে হলে তা মারাত্মক নয়। তবে সুস্থ হওয়ার পর ডেঙ্গু ভাইরাসের অ্যান্টিবডি দেহে থেকে যায়। পরে ডিইএনভি-২, ডিইএনভি-৩ এ আক্রান্ত হলে সেটিকে সেকেন্ডারি ইনফেকশন বলা হয়। এ ধরনের ইনফেকশন বর্তমানে মারাত্মক হচ্ছে। ফলে এবারে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বেশি দেখা যাচ্ছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এটিকে 'ডেঙ্গু শক সিনড্রোম' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এটি ডেঙ্গুর মডিফায়েড (পরিবর্তিত) রূপ। এতে শরীরের তাপমাত্রা তুলনামূলক কম, অর্থাৎ ১০১ থেকে ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইটের মতো থাকে। হাড় কিংবা শরীরের সংযোগস্থলে কোনো ব্যথা হয় না। ফলে অনেকেই বুঝতে পারে না।

রোগী বাড়ছেই :স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত ২৫ দিনে ৭ হাজার ১১২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। গত ২৪ ঘন্টায় নতুন করে ৫৪৭ জন আক্রান্ত হয়েছে। গত ১৯ জুলাই থেকে প্রতিদিনই আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। গত এক সপ্তাহ ধরে প্রতি ঘণ্টায় ১৮ জন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে।

ঢাকার বাইরেও ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। গত মঙ্গল ও বুধবার ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলা ও সিটি করপোরেশন এলাকায় রোগীর সংখ্যা ছিল ৩৭ ও ৪২। গতকাল বৃহস্পতিবার তা বেড়ে ৫৫ জনে দাঁড়িয়েছে। চট্টগ্রামে ৮ ও ৭১ থেকে বেড়ে ৮১ জনে দাঁড়িয়েছে। খুলনায় ৪১ ও ৪৫ জন থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৯ জনে।

সারাদেশে এ পর্যন্ত ৯ হাজার ২৫৬ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে ঢাকায় ৯ হাজার ৩৬ জন এবং ঢাকার বাইরে ২২০ জন। রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ২ হাজার ২৬৭ জন রোগী ভর্তি আছে। ঢাকার বাইরে আছে ৫৫ জন। হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিয়েছে ৬ হাজার ৯২৬ জন।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও মেয়র যা বললেন :আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লেও তা মানতে নারাজ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র। গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজে এক সেমিনারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই। ডেঙ্গু রোগে বাংলাদেশেই মৃত্যুহার সবচেয়ে কম। তিনি বলেন, এডিস মশার প্রজনন অনেক বেশি। রোহিঙ্গা জনসংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, সেভাবেই এই মশাও বেড়েছে। তবে মশা নিধন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। এটি সিটি করপোরেশনের কাজ। তাই সিটি করপোরেশনকে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

অপরদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ছেলেধরা নিয়ে গুজবের মতো ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের নিয়েও গুজব ছড়ানো হচ্ছে। ডেঙ্গু পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও গণমাধ্যমে এটা বেশি করে দেখানোর চেষ্টা চলছে।

https://samakal.com/bangladesh/article/19072202