২৫ জুলাই ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১১:৪৬

সুখী-পরিবার কল্যাণময় সমাজ এবং শান্তিপূর্ণ বিশ্বের রোডম্যাপ

মহাবিশ্বের ছোট্ট একটি গ্রহ আমাদের এই পৃথিবী। এই গ্রহটি আমাদের কাছে খুবই প্রিয়, কারণ আমাদের প্রিয় মানুষগুলো এখানেই বসবাস করে। এই যে বসবাসের কথা বললাম, এর সাথে কিন্তু জড়িয়ে আছে অনেক বিষয়। আমাদের দৃষ্টির সীমানায় যেমন আকাশ আছে, তেমনি আছে আবার আঙ্গিনাও। আকাশ নিয়ে কবিরা অনেক কাব্য রচনা করেছেন, জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা করেছেন গবেষণা। গ্রহ-নক্ষত্র সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের বিজ্ঞানের দ্বারস্থ হতে হয়। আঙ্গিনার রহস্যও কম নয়। ফলমূল, পত্র-পল্লব তো আমাদের প্রিয় বিষয়। আছে আরো খাল-বিল, নদীনালা। বাতাস আমাদের অক্সিজেন দেয়, এর গুরুত্বও কম নয়। জীববৈচিত্র্যে আমাদের বিস্মিত করে। আকাশ আর আঙ্গিনা নিয়ে এই যে জীবন, তা আমাদের কাছে খুবই প্রিয়। তাইতো কবি বলেন, মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভূবণে।

মহান আল্লাহ তো মানববান্ধব করে এই পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন। সভ্যতার এই পর্যায়ে এসে এখন প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে, মানুষ এই পৃথিবীর সাথে বন্ধুর মত আচরণ করছে কী? ইতোমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে আরো বহু প্রশ্ন। মানুষ কি নিজের প্রতি সঠিক আচরণ করছে? পরিবারের প্রতি, সমাজের প্রতি?

মানুষ নিজের প্রতি তখনই সঠিক আচরণ করতে সক্ষম হবে, যখন সে নিজেকে জানতে পারবে। বর্তমান সময়ে মানুষের আচরণ দেখে অনেক সময় মনে হয়, সে যেন নিজেকে শুধু জৈবিক সত্ত্বা হিসেবেই বিবেচনা করে থাকে। এমন খ-িত ভাবনায় ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও বিশ্ব কাক্সিক্ষত মানে বিকশিত হতে পারে না। কারণ মানুষের মন ও আত্মা ওই ভাবনায় উপেক্ষিত হয়েছে। আসলে শরীর, মন ও আত্মা নিয়েই তো মানুষ। মানুষ যখন তার পরিপূর্ণ সত্ত্বা নিয়ে ভাববে, চর্চা করবে তখন সে কাক্সিক্ষত উন্নত মানুষ হিসেবে বিকশিত হতে পারবে। এমন মানুষরা সৃষ্টি তত্ত্ব নিয়ে ভাবে, মানব-মানবীর রহস্য নিয়ে ভাববে, ভাববে জীবনের লক্ষ্য নিয়েও। এমন দার্শনিক ভাবনায় যারা সমৃদ্ধ হবেন, তারা সহজেই উপলব্ধি করতে পারবেন কেন স্রষ্টা সবকিছু জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। এভাবে যারা নর-নারীর সম্পর্কসূত্র আবিষ্কারে সক্ষম হবেন, তাদের কাছে অনিবার্য হয়ে ধরা দেবে পরিবার গঠনের যৌক্তিকতা।

পৃথিবীর প্রথম পুরুষ হযরত আদম (আ.) এবং প্রথম নারী বিবি হাওয়া গঠন করেছিলেন প্রথম পরিবার। স্রষ্টা তাঁদের পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন এবং উপহার দিয়েছেন জীবনযাপনের বিধিমালা। সেই বিধিমালার আলোকেই পুষ্ট হয়েছে তাঁদের মানস জগৎ, শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়েছে যৌনজীবন এবং অর্জিত হয়েছে আত্মিক পরিশুদ্ধি। আমরা জানি, সেই ধারাবাহিকতায় মানবজাতির সংখ্যাবৃদ্ধি হয়েছে। মানুষ সমাজ গঠন করেছে, গঠন করেছে রাষ্ট্র। বর্তমান সময়ে আমরা লক্ষ্য করছি, বিশ্ব-ব্যবস্থা ও বিশ্ব-সভ্যতা। তবে এই বিশ্বব্যবস্থা, এই বিশ্বসভ্যতা কতটা মানবিক, কতটা ন্যায়সঙ্গত এবং কতটা মানববান্ধব, সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে।

মানবজাতির দীর্ঘ ইতিহাসে আমরা নানা বৈচিত্র্য লক্ষ্য করেছি। লক্ষ্য করেছি মানুষের, পরিবারের এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের উত্থান-পতনের চিত্র। মানুষের সমাজ যখন অন্যায়-অবিচার, জুলুম-নির্যাতন ও জাহেলিয়াতের অন্ধকারে বিপর্যস্ত হয়েছে, তখন মহান স্রষ্টা মানব সমাজকে পথপ্রদর্শনের জন্য যুগে যুগে প্রেরণ করেছেন নবী-রাসূলদের। অভ্রান্ত ওহীজ্ঞানের আলোকে নবী-রাসূলগণ প্রথমে আলোকিত মানুষ তৈরি করেছেন, তারপর গঠন করেছেন সমাজ ও রাষ্ট্র। শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সা.) এক্ষেত্রে রেখে গেছেন শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। তিনি এমন একজন নবী ছিলেন, যিনি শুধু মানবজাতির জন্য নয়, ছিলেন সমগ্র সৃষ্টি জগতের জন্য রহমতস্বরূপ। তাঁর শিক্ষার আলোকে মানুষ শুধু পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের বন্ধু নয়, বন্ধু হতে পারে প্রাণী জগৎ, প্রকৃতি জগৎ ও সৌরজগতেরও। তাঁর শিক্ষা থেকে দূরে অবস্থানের কারণেই আজ আমরা লক্ষ্য করছি জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে বিপর্যয় এবং এই বিপর্যয়ের জন্য আমরা মানুষরাই দায়ী। এটা আমাদেরই অর্জন। তাই বলতে হয়, আলো ঝলমলে এক জাহেল-সভ্যতায় এখন আমাদের বসবাস। বিজ্ঞান প্রযুক্তির এত উন্নতির পরও বর্তমান সভ্যতা মানবজাতিকে কাক্সিক্ষত শান্তিময় বিশ্ব উপহার দিতে সক্ষম হয়নি।

মানবজাতি এমন ব্যর্থতার মুখোমুখি হলো কেন? এই সংকটের মূল কোথায়? কেউ বলছেন এটা রাজনৈতিক সংকট, কেউ বলছেন সভ্যতার সংকট। আরো ব্যাখ্যা আছে। নবী-রাসূলদের ইতিহাসের আলোকে অনেকে বলছেন, মূল সংকট জ্ঞানের এবং মানুষের। ¯্রষ্টা প্রেরিত অভ্রান্ত জ্ঞানচর্চা থেকে আমরা এখন দূরে। ফলে বিভ্রান্তির নানা সড়কে পরিভ্রমণরত ক্লান্ত মানুষ এখন দিশেহারা। মানুষ এখন নিজেকে গঠন করতেই ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। নিজেকে পরিগঠনে ব্যর্থ মানুষ পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা কাক্সিক্ষত পৃথিবী পরিগঠনে সফল হবে কেমন করে?

এখন প্রশ্নের জবাব খুঁজতে আমরা ক’জনা প্রস্তুত আছি? জবাব খুঁজতে গেলে তো আমাদের স্মরণ করতে হবে আদি অঙ্গীকারের কথা। পৃথিবীতে প্রেরণের আগে তো রূহের জগৎ ‘আলমে আরোয়ায়’ আল্লাহ আমাদের প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আলাসতু রাব্বিকুম’ (আমি কি তোমাদের রব নই?)আমরা সেখানে বলেছিলাম, ‘বালা’। হ্যাঁ, আপনিই আমাদের রব। এমন অঙ্গীকারের মাধ্যমে আমরা নিজেদের আল্লাহর বান্দা হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছিলাম। আসলে নিজেদের বান্দা হিসেবে তৈরি করতে পারলেই প্রকৃত মানুষ হওয়ার কাজটি সম্পন্ন হয়ে যায়।
মানুষের লক্ষ্য তো সুখী পরিবার, কল্যাণময় সমাজ এবং শান্তিপূর্ণ বিশ্ব। অথচ আমার বক্তব্য এখনো মানুষকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে। এর সঙ্গত কারণ রয়েছে। পরিবার, সমাজ ও পৃথিবীকে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাবার দায়িত্ব কার? আসমান থেকে ফেরেশতা এসে তো এই দায়িত্ব পালন করবেন না। দায়িত্ব পালন করতে হবে মানুষকেই। পরিবার, সমাজ ও পৃথিবীর কার্যক্রমে সক্রিয় আছে মানবজাতির সদস্যরাই। এরাই ওই প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে পারে, আবার অসুন্দরের কারিগরও হতে পারে মানুষই। বর্তমান সভ্যতাই তার বড় প্রমাণ।

নানা উপাদানে মানুষ গঠিত। এর মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো কল্্ব। যাকে আমরা হার্ট বা হৃদয় নামেও অভিহিত করে থাকি। কল্্বের রয়েছে আবার দু’টি বিষয়। একটি ‘অরগানিক’, অপরটি ‘মরাল’।
অর্থাৎ কলবের সাথে জড়িত রয়েছে জৈব বা জীবতাত্বিক বিষয় এবং নৈতিক বিষয়। ‘অরগানিক’ বিষয় নিয়ে কাজ করছেন ডাক্তাররা, আর ‘মরাল’ বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন নবী-রাসূলরা, এখন করছেন বিজ্ঞ আলেমরা। মানুষ যখন নৈতিক দিক দিয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন মন্দ-প্রবৃত্তির সাথে তার শুরু হয় দ্বন্দ্ব। এমন দ্বান্দ্বিক অবস্থা মানুষকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। তবে মানুষের অভীষ্ট লক্ষ্য হবে নফসে-মুতমায়িন্ন বা প্রশান্তি-আত্মা। নবী-রাসূলরা ছিলেন প্রশান্ত-আত্মার অধিকারী। মানুষকে হতে হবে এ পথের সাধক। আসলে আত্মিক পরিচর্যা বা সংশোধনের কাজটি মানবজাতির জন্য খুবই মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এ কাজে পিছিয়ে থাকলে মানুষ কখনো লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে না। আর এ কথাটিও এখানে স্পষ্ট করে বলে রাখা প্রয়োজন যে, বনে-জঙ্গলে গিয়ে নয় বরং সমাজ-সংসারে সক্রিয় থেকে এবং প্রতিদিনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই আমাদের আত্মিক উন্নয়নের কাজটি সম্পন্ন করতে হবে। নবী-রাসূলরা আমাদের জন্য তেমন উদাহরণই রেখে গেছেন। আমরা তো একথা জানি যে, সুখী-পরিবার কল্যাণময় সমাজের ভিত রচনা করতে পারে। আর জনপদের সমাজগুলো মিলেই তো প্রতিষ্ঠা করবে শান্তিপূর্ণ বিশ্ব। এমন রোডম্যাপে চলতে গেলে আমাদের যেমন সুখী পরিবার গঠনের শর্ত পালন করতে হবে, তেমনি কল্যাণময় সমাজ প্রতিষ্ঠার গুরুদায়িত্বও আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। আর বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা ও সভ্যতার দিকে তাকালে খুব সহজেই আমরা উপলব্ধি করতে পারবো, বিশ্বশান্তির পথে অন্তরায়গুলো কী। আমরা জানি পরিবার, সমাজ, বিশ্ব এক বিষয় নয়; আবার বিচ্ছিন্ন বিষয়ও নয়। এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কাজ করতে গেলে জ্ঞান-অভিজ্ঞান ও পর্যবেক্ষণসহ নানাবিধ দায়িত্ব এসে যায়। আর সেই দায়িত্ব পালনে তো এগিয়ে আসতে হবে পরিবার, সমাজ ও বিশ্ব-সমাজের মানুষদের। আকাশ থেকে ফেরেশতারা এসে তো এই দায়িত্ব পালন করবেন না। তবে মানুষ যথাযথভাবে এগিয়ে গেলে প্রয়োজনে মহান আল্লাহ ফেরেশতা পাঠিয়ে সাহায্য করতেও পারেন, যেমনটি অতীতে করা হয়েছে। প্রসঙ্গত এখানে একটি বিষয় প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, সুখী পরিবার, কল্যাণময় সমাজ এবং শান্তিপূর্ণ বিশ্ব বিনির্মাণের পথে বাধার অভাব হবে না। আর সেই বাধা আসবে জিন-শয়তান ও মানব শয়তানের পক্ষ থেকে। তাই এ পথে অটল থেকে লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে প্রয়োজন হবে প্রশান্ত-আত্মার সাধকদের। আসলে মানসম্পন্ন কাজের জন্য প্রয়োজন হয় মানসম্পন্ন মানুষদের। এর কোনো বিকল্প আছে কী? বিকল্প নেই বলেই রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সা.) প্রথমে মানসম্পন্ন মানুষ তৈরির কাজটিই করেছেন। এমন রোডম্যাপেই রয়েছে সুখী পরিবার, কল্যাণময় সমাজ ও শান্তিপূর্ণ বিশ্ব বিনির্মাণের বার্তা।

https://www.dailysangram.com/post/384034