২৫ জুলাই ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১১:৩৭

বাংলাদেশের বদনাম করে বাংলাদেশীরাই

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল : ২০০৬ সালের দিকে একজন মার্কিন কংগ্রেসম্যান বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের শত্রু বাংলাদেশীরাই’। তার মতে-বাংলাদেশীরাই বাংলাদেশের বদনাম করে। বাংলাদেশীরাই যে বাংলাদেশের বদনাম করে তার প্রমাণ আবারো পাওয়া গেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান ঐক্যপরিষদের কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেত্রী প্রিয়া সাহা গত ১৭ই জুলাই হোয়াইট হাউসে বাংলাদেশের ৩ কোটি ৭০ লক্ষ ধর্মীয় সংখ্যালঘু নিখোঁজ থাকার একটি মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে। সেখানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে তিনি বলেন, বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা মৌলবাদীদের নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। প্রিয়া সাহা সেখানে বলেন, প্লিজ আমাদের সাহায্য করুন। আমরা আমাদের দেশে থাকতে চাই। এখনও সেখানে ১ কোটি ৮০ লক্ষ সংখ্যালঘু মানুষ রয়েছেন। আমার অনুরোধ, আমাদের সাহায্য করুন। আমরা দেশ ছাড়তে চাই না। তারা আমার বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে, আমার জমি কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু বিচার হয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একই ধরনের মিথ্যা অভিযোগ এর আগেও করেছিল বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রীষ্টান ঐক্যপরিষদের নেতারা। ১৯৯২ সালে ১৮ই এপ্রিল হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান ঐক্যপরিষদের নরসিংদীর জনসভা এবং পরে ঢাকা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে তারা বলে, ‘অত্যাচারের মুখে তিন কোটি সংখ্যালঘু প্রতিবেশী দেশ ভারতে পালিয়ে গেছে’। সংখ্যালঘু এই সংগঠনের নেতাদের বক্তব্য যে ডাহা মিথ্যা তা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যেই দেখা গেছে। এছাড়া প্রতিবেশী দেশ ভারতের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ যে বক্তব্য দিয়েছে তাতে তারা বলেছে, তাদের দেশে স্বাধীনতা পরবর্তীতে তেমন অনুপ্রবেশ ঘটেনি। কিছু লোক কলকাতায় আসে কাজের সন্ধানে। আবার তারা নিজ দেশেই চলে যায়।

সূত্র মতে, প্রিয়া সাহা বা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্যপরিষদের দেয়া তথ্য যে সঠিক নয় সেটি খোদ ভারতীয় কতৃপক্ষের দেয়া বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নব্বইয়ের দশকে সংখ্যালঘুদের এমন অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন আইজি শংকর সেন বলেন, ‘বাংলাদেশ ইসলামী রাষ্ট্র হওয়ায় সংখ্যালঘুদের অনুপ্রেবেশ বাড়েনি’ (আনন্দবাজার, ৫ জুলাই ১৯৮৮)। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বুটাসিং বলেন, ‘জন্মহার বাড়ার কারণে পরিশ্চমবঙ্গ সীমান্তে জনসংখ্যা বাড়তে পারে’ (আনন্দবাজার, ২১ মে ১৯৮৭)। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবসু বলেন, ‘ বাংলাদেশ থেকে কিছু লোক আসে বটে, তবে তা তেমন মারাত্মক কিছু নয়’ (আনন্দবাজার, ২১ মে ১৯৮৭)। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবসু ১৯৯১ সালে পুনরায় এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ঢালাও অনুপ্রবেশ ঘটনা সত্য নয়। বাংলাদেশ থেকে কিছু লোক আসে যা হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের। এদের মধ্যে অবাঙ্গীরাও আছেন। তারা আসেন কাজের সন্ধানে। আবার ফিরেও যান। পৃথিবী ব্যাপী বিভিন্ন দেশের মধ্যে যেখানে অভিন্ন সীমান্ত আছে, সেখানেও এধরণের ঘটনা স্বাভাবিক’ (দৈনিক বাংলা, ১৮ই জুন ১৯৯১)।

উপরের কয়েকটা উদাহরণেই পরিষ্কার যে, বাংলাদেশ থেকেই যে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। বিশেষ করে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান ঐক্যপরিষদের দেয়া বক্তব্য বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ থাকে। বাংলাদেশী হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান ঐক্যপরিষদের নেতারা বলছে ৩ কোটি বাংলাদেশী গেছে ভারতে। অন্যদিকে ভারতীয় ব্যক্তিত্ব পশ্চিমবঙ্গের আইজি বিশেষ করে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবসু, যিনি তিন দশক ধরে পশ্চিবঙ্গের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তারা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ তেমন ধর্তব্য নয়। 

দেশে থেকেই আবারো দেশ বিরোধী বক্তব্য দিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব অ্যাডভোকেট গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক। গোবিন্দ গত কয়েকদিন যাবত অনলাইনে ভিত্তিহীন প্রোপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রামানিকের দাবী সরকারী বিভিন্ন দলিলেই নাকি ৩ কোটি ৭০ লক্ষ হিন্দু নিখোঁজের তথ্য রয়েছে। এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি সরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। যেখানে প্রিয়া সাহার বক্তব্যে ক্ষোভে পুড়ছে পুরো দেশ, সেখানে তিনি বলছেন, হিন্দু নেত্রী প্রিয়া সাহা বাংলাদেশের ৩ কোটি ৭০ লক্ষ ধর্মীয় সংখ্যালঘু নিখোঁজ থাকার যে অভিযোগ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে করেছেন তা সঠিক। গত সোমবার ভারতীয় সংবাদমাধ্যম “দৈনিক যুগশঙ্খ” নামক এক পত্রিকার সাক্ষাৎকারে গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক বলেন, আজ সারা বাংলাদেশে প্রিয়া সাহার বক্তব্য নিয়ে ঝড় উঠেছে। কিন্তু সরকারের ‘ক’ ও ‘খ’ তফশিলের তালিকা দেখলে আপনি বুঝতে পারবেন, প্রিয়া সাহার দেওয়া তথ্যে ভুল নেই। গোবিন্দ বলেন, আসামে প্রকাশিত নাগরিক তালিকায় বাদ পড়া প্রায় ৪০ লক্ষ নাগরিক তো বাংলাদেশ থেকে নিখোঁজ হওয়া মানুষই। তারা বিভিন্ন সময়ে আশ্রয় নিয়েছেন। শুধু আসামেই নয়, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরাসহ উত্তর-পূর্ব ভারতসহ পুরো ভারতেই বাংলাদেশ থেকে নিখোঁজ ৩ কোটি ৭০ লক্ষ নাগরিকদের অধিকাংশই রয়েছেন। তিনি বলেন, বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুসহ অনেক নেতা-মন্ত্রী, বর্তমান ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারসহ অনেক কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক ব্যক্তিই বাংলাদেশের ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে তারা ভারতে চলে যান। তারা সবাই ৩ কোটি ৭০ লক্ষ নিখোঁজদের মধ্যে পড়েন। তিনি বলেন, ১৯০১ সালে বাংলা ভূখন্ডে মুসলিম ছিল ১ কোটি ৯১ লক্ষ ১৩ হাজার। আর হিন্দু ছিল ৯৫ লক্ষ ৪৫ হাজার। অর্থাৎ মুসলমান জনসংখ্যার অর্ধেক হিন্দু। ২০০১ সালে মুসলমান জনসংখ্যা ১১ কোটি ১০ লক্ষ ৭৯ হাজার এবং হিন্দু জনসংখ্যা ১ কোটি ১৩ লক্ষ ৭৯ হাজার। সম্প্রীতির হিসেব অনুসারে হওয়া উচিত ছিল সাড়ে ৫ কোটি। সরকারি হিসেব মতে, ৪ কোটি হিন্দু নিখোঁজ।

সূত্র মতে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে একটি ভয়াবহ ষড়যন্ত্র চলছে সেটি বাংলাদেশে এবং এর বাইরের কিছু প্রপাগান্ডা থেকে ক্রমশ: স্পষ্ট হয়ে উঠছে। পশ্চিমবঙ্গের এক লেখকের সাম্প্রতিক গবেষণায় উল্লেখিত হয়েছে যে, কেবল ১৯৪৭ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত সময়ে পূর্ববঙ্গ থেকে ২ কোটি ২২ লক্ষ ৫৩ হাজার ১৬৪ জন হিন্দু ভারতে/পশ্চিমবঙ্গে চলে গেছে। রেফারেন্স হিসেবে লেখক সরকারী ত্রাণ ও পূনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের দলিল উল্লেখ করেছেন। কিন্তু একই সময় ঐ গবেষক দেখতে ভুলে গেছে বা খোঁজ নেয়নি, এত সংখ্যার হিন্দু পশ্চিমবঙ্গের সামগ্রিক জনসংখ্যায় কত সংখ্যা যোগ করে। ১৯৫১ সালের ভারতীয় পরিসংখ্যান বলছে, পশ্চিমবঙ্গের টোটাল জনসংখ্যাই ছিল ২ কোটি ৬২ লক্ষ ৯৯ হাজার। পশ্চিমবঙ্গের সামগ্রিক জনসংখ্যার পরিসংখ্যান মতে, ১৯৪১ থেকে ১৯৫১ সালে সর্বমোট জনসংখ্যা বেড়েছে মাত্র ৩০ লক্ষ ৭০ হাজার ৪২৮। যদি ২ কোটি লোক পূর্ববঙ্গ থেকেই যেত তাহলে পশ্চিমবঙ্গের টোটাল সংখ্যা কত দাঁড়াত? সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এভাবেই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু নির্যাতন বা তাদের তাড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ করা হচ্ছে। শুভাষ ঘোষ নামের ঐ গবেষক খোঁজ নেয় নাই, সারা পূর্ববঙ্গে হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কত ছিল। ১৯৬১ সালে প্রকাশিত পাকিস্তান পরিসংখ্যান মতে ১৯৪১ সালে পূর্ববঙ্গে হিন্দু ছিল ১ কোটি ১৭ লক্ষ ৪৭ হাজার।

সম্প্রতি বিবিসি বাংলা প্রিয়া সাহা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে সেদেশের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে যে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ করেছে সে বিষয়ে একটি প্রতিবেদন করেছে। সেখানে বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংখ্যাগত চিত্রটা আসলে কেমন? আর প্রিয়া সাহার বক্তব্য কতটা বাস্তবসম্মত সেটি তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে তারা ব্রিটিশ আমলের পূর্ববঙ্গ, পাকিস্তান আমলের পূর্ব পাকিস্তান আর বর্তমান বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে জনসংখ্যার একটা হিসাব তুলে ধরে। যা পাওয়া যায় বিভিন্ন সময়ে হওয়া আদমশুমারিতে। সেখানে আদমশুমারির তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ৪৭ এর ভারত ভাগের পর থেকে এ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আর এখনকার বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা কখনোই দেড় কোটি ছাড়ায়নি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৫১ সালের আদমশুমারিতে দেখা যায়, সেসময় পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিলো ৯৭ লাখ ৬ হাজার। ১৯৬১ সালের আদমশুমারিতে এ সংখ্যা ৯৯ লাখ ৫০ হাজার। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে এ সংখ্যা হয় ১ কোটি চার লাখ ৩৯ হাজার। আর সর্বশেষ ২০১১ সালের আদমশুমারিতে এই সংখ্যা ১ কোটি ৩৮ লাখ। অর্থাৎ এই ভূখন্ডে ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কখনোই ৩ কোটি ৭০ লাখ বা এর অর্ধেকও ছিলো না। আদমশুমারিতে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমে যাওয়ার কোন তথ্য পাওয়া যায় না।
ভারত-ভাগের পর ১৯৫১ সালে ৯৭ লাখ ৬ হাজার থেকে ২০১১ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ৩৮ লাখে। কিন্তু মোট জনসংখ্যায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আনুপাতিক হার অবশ্য কমেছে। তবে এই কমে যাওয়ার পরিসংখ্যান শুধু পাকিস্তান আমলে কিংবা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরই যে দেখা যাচ্ছে তেমন নয়। বরং ব্রিটিশ আমলেও এই অঞ্চলে সংখ্যালঘুদের আনুপাতিক হার কমে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। সেসময় শুমারিতে অবশ্য মূলত: হিন্দুদের সংখ্যাই দেয়া হয়েছে। ১৯১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, সেসময় পূর্ব বাংলায় হিন্দু জনগোষ্ঠীর আনুপাতিক হার ছিলো ৩১ শতাংশ। ১৯৪১ সালে ২৮ শতাংশ। অর্থাৎ ২০ বছরে হিন্দু জনগোষ্ঠীর আনুপাতিক হার কমেছে ৩ শতাংশ।

তবে এরপরই হিন্দু জনগোষ্ঠীর আনুপাতিক হার দ্রুত গতিতে আরো কমতে থাকে। ১৯৪১ থেকে ১৯৭৪ এই ৩৩ বছরে হিন্দু জনগোষ্ঠীর আনুপাতিক হার কমে যায় প্রায় ১৫ শতাংশ। ১৯৪৭ এর ভারত-ভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাসহ বিভিন্ন কারণে সেসময় অবশ্য পূর্ব বাংলা থেকে হিন্দু জনগোষ্ঠীর অনেকেই ভারতে চলে গিয়েছিলেন। একইভাবে ভারত থেকেও অনেক মুসলমান পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিলেন। আবার বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও অনেক হিন্দু দেশান্তরি হয়েছিলেন। ভারত রাষ্ট্রের দলিল মতে তারা সকলেই ফিরে এসেছে।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মোট জনসংখ্যায় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর কমে যাওয়ার হারে আবারো ধীরগতি দেখা যায়। ১৯৭৪ সালের প্রথম আদমশুমারিতে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর হার ছিলো ১৪.৬ শতাংশ। ২০১১ সালে সেটি কমে আসে ৯.৬ শতাংশে। অর্থাৎ বাংলাদেশ আমলে ৩৭ বছরে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর হার ক্রমঃহ্রাসমান হারে বেড়েছে। আদমশুমারিতে অবশ্য সবসময়ই মুসলিম জনগোষ্ঠীর মোট সংখ্যা এবং আনুপাতিক হার দুটোই বেড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ আমলে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর হার ক্রমঃহ্রাসমান হারে কমে যাওয়া কতটা অস্বাভাবিক?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের চেয়ারপার্সন মোহাম্মদ মইনুল ইসলাম অবশ্য একে অস্বাভাবিক মনে করেন না। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেছেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হার কমলেও আকার কিন্তু কমছে না, বরং বাড়ছে। কিন্তু ক্রমঃহ্রাসমান হারে কেন কমছে এমন প্রশ্নে তিনি বলছেন, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সঙ্গে যদি মুসলিম সম্প্রদায়ের তুলনা করি তাহলে দেখা যাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে জন্মহার কিংবা সন্তান বেশি নেবার প্রবণতা বেশি। এটা বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক গবেষণাতেও দেখা গেছে যে মুসলমানদের মধ্যে জন্মহার বেশি। বাংলাদেশেও আমরা ছোট আকারে বিভিন্ন গবেষণায় এটা দেখেছি। তিনি বলেন, একদিকে মুসলিম জনসংখ্যা অনেক বেশি। অন্যদিকে তাদের মধ্যে জন্মহারও বেশি। ফলে তাদের আকার যেমন দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি মোট জনসংখ্যায় আনুপাতিক হারেও এটা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আকার বাড়লেও ক্রমঃহ্রাসমান হারে বাড়ছে। তিনি বলেন, সংখ্যালঘুরা সরকারিভাবে ভালোই পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন এর উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে সরকারী কর্মচারীদের ২৫ শতাংশ হচ্ছে ধর্মীয়ভাবে সংখ্যালঘু, যদিও তারা মোট জনসংখ্যার ১২ শতাংশ। মন্ত্রী বলেন, প্রিয়া সাহার বক্তব্য যে অন্তঃসারশূন্য এবং বিশেষ উদ্দেশ্যে জঘন্য মিথ্যাচার, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওগ্রাফির প্রফেসর ড. এ এফ এম কামাল উদ্দিনের একটি গবেষণা প্রবন্ধে দেখা যায়, ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৫১ সালের মধ্যে প্রায় ৭ লক্ষ ভারতীয় বর্তমান বাংলাদেশে রিফিউজি হিসেবে এসেছে। ১৯৫১ সালের আদমশুমারিতে সেটা উল্লেখিত হয়েছে। এরপর ১৯৫০ সালের কলকাতা দাঙ্গায়, ১৯৬১ সালের মধ্যপ্রদেশ ও উত্তর প্রদেশে মুসলিম নিধন, ১৯৬২ সালে আসামে মুসলিম বিরোধী দাঙ্গা, এবং ১৯৬৪ সালে কলকাতা দাঙ্গায় লক্ষ লক্ষ ভারতীয় মুসলিম আমাদের এখানে চলে আসে। কেবল ১৯৬৪ সালের কলকাতা দাঙ্গায় ৮ লক্ষ মুসলমান পূর্বপাকিস্তানে পালাতে বাধ্য হয়। ১৯৬৭ সাল নাগাদ আরো ৫ লক্ষ ৪০ হাজার রিফিউজি আসে, যাদের অধিকাংশই পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা। যারা টাকা পয়সা, শিক্ষা, চাকুরী এবং নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে কোন রকমে রিফিউজি ক্যাম্পে যাওয়া থেকে বেঁচেছেন তারা উপরোক্ত সংখ্যার বাহিরে। সে হিসেবে ভারত থেকে আগত মানুষের সংখ্যা আরো অনেক বেশিই হবে। বাংলাদেশের নামকরা শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, একাডেমিক, সাহিত্যিক ও শিল্পীদের একটা অংশ পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা। তাদেরকে রিফিউজি ধরা হয় না।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৫১ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে নির্যাতন ও দাঙ্গার কারণে তাদের সংখ্যা ১৫-২০ শতাংশ মুসলমান ভারত থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। আর অন্যদিকে নাগরিকত্বের জন্য তাদের সংখ্যার ভারতে ১২% হিন্দু বাংলাদেশ থেকে চলে যায়। এদের অধিকাংশই স্বেচ্ছায় জমি জমা বিক্রি করে চলে গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের যে অভিযোগ আনা হয়েছে সেটিও মনগড়া, মিথ্যা, বানোয়াট। দেশ স্বাধীন হবার পর থেকে বাংলাদেশে অবস্থানরত সংখ্যালঘুদের বিষয়ে এমন অভিযোগ প্রায়শ: শোনা যেত। তবে এর ব্যাপক ব্যাপ্তি ঘটেছিল ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত চার দলীয় জোট সরকারের সময়ে। এই সময়ে জমি-জমা বা ব্যক্তিগত কোনো বিষয়ে ঝগড়া বিবাদ হলেও সেটিকে সংখ্যালঘু নির্যাতন হিসেবে চালিয়ে দেয়া হতো। বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগের প্রতিবাদ জানানো হতো।

যে এলাকায় ঘটনা ঘটতো, সেই এলাকার মানুষও ঘটনার প্রতিবাদ জানাতো। বিরোধী রাজনীতিক দল ও সরকারপন্থী সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে বারবার অভিযোগ করার প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশ ও মানবাধিকার সংস্থা তদন্ত দল পাঠায়। তারা অভিযোগকৃত এলাকায় গিয়ে সরেজমিনে তদন্ত শেষে যে সব রিপোর্ট দিয়েছিল তাতে সংখ্যালঘু নির্যাতন বা হামলার কোনো সত্যতাই পাননি। তারা রিপোর্টে বলেছে, যেভাবে ঢালাওভাবে অভিযোগ করা হয়েছে সেরকম কোনো ঘটনাই ঘটেনি। ২/১টি ঘটনা যেগুলো ঘটেছে, সেগুলো হচ্ছে ব্যক্তিগত আক্রোশ বা জমি-জমা সংক্রান্ত বিরোধের জের। এগুলোকে কোনভাবেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে তুলনা করা চলেনা।

সূত্র মতে, পারিবারিক ও জমি জমা সংক্রান্ত বিরোধকে সাম্প্রদাািয়ক রুপ দেয়ার প্রয়াস তীব্র হয়েছিল ২০০১ সালের পর থেকে। নির্বাচিত পরাজিত দল বর্তমানে ক্ষমতাসীণ আওয়ামী লীগ প্রতিশোধ হিমেসবে সংখ্যালঘু নির্যাতনের শ্লোগানকে একটা ট্রাম্প কার্ড হিসেবে সামনে নিয়ে আসে। এই অস্ত্র প্রয়োগের প্রধান বাহন হিসেবে এগিয়ে আসে তথাকথিত এই হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান পরিষদ। প্রতিমাসে তারা একটি বুলেটিন বের করে তাতে সত্য-মিথ্যার প্রলেপ দিয়ে সংবাদ প্রচার করতো।

এই বুলেটিনে তারা হিন্দুদের সাথে মুসলিম প্রতিবেশীদের ঝগড়া-ঝাটি, মারামারি, মামলা-মোকদ্দমার যে ঘটনা এবং হিন্দুদের বাড়িতে যেসব চুরি ডাকাতি হতো সেগুলো মানবাধিকার লংঘন বলে তুলে ধরে গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিত। হিন্দুদের উপর এইসব ঘটনার ফলাও করে তুলে ধরতো তথাকথিত সুশীল সমাজ। বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনার ফলাও করে প্রচার পেত ভারতের মিডিয়াগুলোতে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালের ৫ই জুর ভারতের জনৈক লেখক ড. আনন্দ কুমার তার নিবন্ধে লিখেছিলেন, বাংলাদেশে সংখ্যলঘুরা ইসলামপন্থীদের আক্রমণের শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশী সংখ্যালঘুরা তাদের সম্পদ ও সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রায় একই সময়ে বাংলাদেশী লেখক প্রফেসর আবুল বারাকাত তার এক নিবন্ধে লিখেছেন, প্রায় দুই লাখ হিন্দু পরিবার তাদের বসতবাড়ি, হাজার হাজার বিঘা জমি-জমা হারিয়েছে। ২০০১ থেকে ২০৬ সালের মধ্যে চারদলীয় জোট সরকারের রাজনৈতিক ক্ষমতাবানরা এসব জমি-জমা দখল করে নিয়েছে। বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে তখনকার বামপন্থী সুবিধাভোগী সুশীল সমাজের বিপদগামী কিছু লোক যেভাবে দেশের অন্নে প্রতিপালিত হয়েবিদেী প্রপাগান্ডিষ্টদের হাতে দেশকে ষংকটে ফেলবার মিথ্যা তথ্য তুলে দিয়েছিল, ঠিক একই কায়দায় প্রিয়া সাহারাও বাংলাদেশে ব্যাপক সংখ্যালঘু নির্যাতন হচ্ছে বলে মিথ্যা সংবাদ গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিচ্ছে।

জানা গেছে, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা নির্যাতনের যে অভিযোগ বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ও তাদের দোসরদের পক্ষ থেকে আনা হয়েছিল তা সরেজমিনে তদন্তে বাংলাদেশে এসেছিলেন তৎকালীন মার্কিণ কংগ্রেসের প্রতিনিধি নিউইয়কস্থ জন যে কলেজ অব ক্রিমিনাল জাস্টিসের অধ্যাপক ও মার্কিন অপরাধ এবং মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ ম্যাকেল গোমেজ। তিনি দীর্ঘ ২৫ দিন ধরে বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে, বিশেষ করে অভিযোগের স্পট গুলোতে ব্যাপক সফর করেন। এর ভিত্তিতে তিনি একটি দীর্ঘ রিপোর্ট তৈরী করেন। তিনি রিপোর্টের সার সংক্ষেপে লিখেছিলেন, ২৫ দিন ধরে আমি বাংলাদেশে অবস্থানকালে প্রত্যন্ত অঞ্চলের তৃণমূল পর্যায়ের গ্রামবাসীদের কাছে পৌছে তাদের সাথে কথা বলি। আমি বরিশাল,পটুয়াখালী, বাকেরগঞ্জ, ঋষিপুর, খুলনা, যশোর, কুমিল্লা, চান্দিনা, ইকরাশি, হাসনাবাদ, দোহার, কালিগঞ্জ, আড়িখোলা, নোয়াখালী, চট্গ্রাম-ওইসব শহর এবং গ্রামে গিয়েছি। নির্যাতিত হিসেবে প্রচারিত হিন্দু, খ্রীষ্টান এবং বৌদ্ধ পরিবারগুলোর কাছে পৌছে এ ব্যাপারে তাদের বক্তব্য উদ্ধার করাই ছিল আমার লক্ষ্য। মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি আদৌ সত্য কিনা, নাকি অতিরঞ্জিত- সেটাই ছিল মুখ্য। তাদের বেশীর ভাগের কথোপকথনই আমি ভিডিও টেপে ধারণ করি। ছব্রি তুলি অনেকের। তাদের কেউই খুন, ধর্ষণ, গুম, আঘাত, বাড়িঘরে আগুন দেয়া কিংবা লুটতরাজের মতো বড় কোন ঘটনার কথা বলেন নি, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের পর্যায়ে পড়ে। তাদের বক্তব্য থেকে আমার মনে হয়েছে তা হলো, নাম ধরে কাউকে গালি দেয়া, বাড়িতে ঢিল মারা, জমি জমা সংক্রান্ত মামলা, ব্যক্তিগত বিরোধী, ব্যবসায়ীক কোন্দল, আগে থেকে চলে আসা বংশানুক্রমিক দ্বন্ধ ইত্যাদিকে নির্যাতন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, এ জাতীয় ঘটনা যখনই মুসলমান ও হিন্দুর মধ্যে সংঘটিত হয়েছে, তখনই এটিকে ধর্মীয় নির্যাতন এবং সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের নামে অতিরঞ্জন করা হয়েছে। (মানবজমিন, ২ সেপ্টেম্বর, ২০০২)

https://www.dailysangram.com/post/384054