২৩ জুলাই ২০১৯, মঙ্গলবার, ১:২৩

৭ সহস্রাধিক কেন্দ্রে ৯০% থেকে ১০০% এবং ২২৭ কেন্দ্রে ১০০% ভোট

সরদার আবদুর রহমান : একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলের সুরতহাল রিপোর্টে দেখা যায় সহস্রাধিক কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৯০ ভাগ থেকে শতভাগ পর্যন্ত। এমনকি প্রবাসী আর মৃত ব্যক্তিও সিল মেরেছেন ব্যালট পেপারে।

নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী সংসদ নির্বাচনের কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলে দেখা যায়, অন্তত ২২৭টি কেন্দ্রে ১০০% ভাগ ভোট পড়েছে। এ ছাড়াও ৯০ শতাংশ থেকে ৯৯.৯৯ শতাংশ পর্যন্ত ভোট পড়েছে অন্তত সাড়ে ৭ হাজারের বেশি কেন্দ্রে। আর ৮০ থেকে ৮৯% ভোট পড়েছে- এমন কেন্দ্রের সংখ্যা ১৫ হাজার ৭১৯টি। অর্থাৎ ৮০ থেকে ১০০ ভাগ পর্যন্ত ভোট পড়েছে এমন কেন্দ্রের সংখ্যা ২৩ সহস্রাধিক। অন্যদিকে শতভাগ ভোট কাস্ট হওয়া কেন্দ্রগুলোর মধ্যে রয়েছেন মৃত ভোটাররা। আছেন দীর্ঘদিন যাবত প্রবাসীরাও- যারা ভোট দিতে দেশে ফেরেননি। লক্ষণীয় বিষয় হলো, শতভাগ ভোট পড়া কেন্দ্রের মধ্যে এগিয়ে রয়েছে চট্টগ্রাম ও রংপুর বিভাগ। রংপুর-৫ আসনে সর্বোচ্চ ৯টি ভোটকেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে ৮টি, চট্টগ্রাম-৮ ও রংপুর-২ আসনে ৭টি করে, লালমনিরহাট-৩ ও রংপুর-৬ আসনে ৬টি করে, চট্টগ্রাম-৫, কক্সবাজার-৩, ময়মনসিংহ-২, ময়মনসিংহ-১০, দিনাজপুর-১, গাইবান্ধা-৪, নওগাঁ-৩ ও সিলেট-৪ আসনে চারটি করে কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে।

ভোটবন্যার কিছু নমুনা : গোপালগঞ্জ-১ আসনে কেবল নৌকাকে বিজয়ী করার জন্যই যেন ভোটের ‘ঢল’ নামে। এই আসনের ১৩৩টি কেন্দ্রের ২টি বাদে সবক’টিতেই ৯১% থেকে ৯৭% ভাগ পর্যন্ত ভোট প্রদান করা হয়েছে বলে দেখানো হয়। বাকি দু’টিতেও ভোটের হার ৮৫% থেকে ৮৯% ভাগ। শুধু তাই নয়, মাত্র ৯টি কেন্দ্রে ধানের শীষের ভাগ্যে ১-২টা করে ভোট জুটেছে। তবু সাকুল্যে মোট প্রাপ্ত ভোট ২১টি। অন্য কোনো প্রতীকের ঘরে যে এসব ভোট গেছে তাও নয়, সেগুলোতেও ২/১টা করে ভোটের দেখা মেলে। সবমিলিয়ে নৌকার ভোট প্রাপ্তি ৩ লাখ ৩ হাজার ৯৪২ ভোট। আর দ্বিতীয় স্থান অধিকারী হাতপাখা প্রতীকের ভোট মাত্র ৭০২টি। আরেকটি ভোট বন্যার নমুনাতে দেখা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ আসনে মোট কেন্দ্র ৯১টি। এর মধ্যে ৯টি কেন্দ্রে ৭১% থেকে ৮৯% ভাগ ভোট পড়ে। বাকি ৮২টি কেন্দ্রেই ৯০% থেকে প্রায় শতভাগ ভোট কাস্ট হয়েছে বলে দেখানো হয়। এর মধ্যে কেবল একটি কেন্দ্রে ধানের শীষের ভোট দেখা যায় সর্বোচ্চ ৬৩৮টি। বাকিগুলোতে শূন্য থেকে ২/৩টি করে ভোট দেখা যায়। অন্য প্রতীকেরও একই দশা। বাকি সব ভোট প্রতিটি কেন্দ্রে ১২শ’ থেকে ৪ হাজার করে কেবল নৌকাতেই পড়েছে বলে দেখানো হয়েছে।

ধানের শীষের ঘাটি বলে পরিচিত বগুড়া অঞ্চলের মধ্যে বগুড়া-১ আসনের চিত্রও অনুরূপ। এখানে ১২২টি আসনের মধ্যে ৪২টিতে ৮০% থেকে ৮৯% ভোট কাস্ট হয়। বাকি ৮০টি কেন্দ্রে ৯০% থেকে ১০০% পর্যন্ত ভোট পড়েছে বলে দেখানো হয়েছে। এই আসনেও ধানের শীষের ভোট শূন্য থেকে ডাবল ডিজিটের এবং কয়েকটি কেন্দ্রে তিন ডিজিটের ভোট দেখা যায়। আর চার ডিজিটের হাজার হাজার ভোট কেবল নৌকায় গিয়ে জমা হয়েছে। নৌকার ভোট দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৬৮ হাজার প্রায়। আর ধানের শীষের ভোট মাত্র ১৬ হাজার ৬৯০। এভাবে অধিকাংশ আসনেই একদিকে দেখা যায় ভোটের প্লাবন, সঙ্গে এই প্লাবনের একতরফা ফায়দা জমা হয়েছে কেবল নৌকার বাক্সে।

মৃত ও প্রবাসীর ভোট প্রদানের নমুনা : একটি জাতীয় দৈনিকের সরেজমিন রিপোর্টের সূত্রে জানা যায়, ‘শতভাগ’ ভোট দেয়া এলাকায় মৃত এবং প্রবাসে থাকা ব্যক্তিদের ভোট দেয়ার প্রমাণ মেলে। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা হয়, বগুড়ার চিকাশি মোহনপুর গ্রামের হজরত আলীর স্ত্রী জাহেদা খাতুনের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৩ মার্চ। তার ভোটার নম্বর ১০১৪৮২২২৪৯৬৭ (ক্রমিক নম্বর: ২৩৩)। জাহেদার ছোট ছেলে আকবর আলী (৪০) জানান, ২০১৮ সালের জুনে তার মা পারিবারিক কলহের জেরে তার এক প্রতিবেশী আত্মীয়ের হাতে নিহত হন। এই হত্যার পর মামলার প্রধান আসামী মেহের আলী কারাগারে রয়েছেন। অথচ এই কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে।

হত্যার দায়ে অভিযুক্ত মেহের আলীর বাবা ইউসুফ আলী জানান, তিনি ও তার স্ত্রী মেহেরুন্নেসা এবং মেহের আলীর স্ত্রী আরজিনা বেগম ১১তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেননি। চিকাশি মোহনপুর গ্রামের মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলামের ছেলে মালয়েশিয়া প্রবাসী মোহাম্মদ মইনুল হাসান (ভোটার নম্বর: ১০১৪৮২০০০২৮৪) ভোট দিয়েছেন বলেও ভোটার তালিকার মাধ্যমে জানা যায়। মইনুলের মা সালেহা বেগম বলেন, তার ছেলে মালয়েশিয়ায় গিয়েছে প্রায় ১ বছর হলো। বিষয়টি দাঁড়ালো এমন, যিনি নিহত হয়েছেন ২০১৮ সালের জুন মাসে, তিনি ভোট দিয়েছেন ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর। হত্যাকারী জেলে, অথচ তিনিও ভোট দিয়েছেন।

এই শতভাগ ভোট পড়া কিংবা মৃত ব্যক্তির ভোট প্রদানের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কিছুই করণীয় নেই বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন সিইসি। এই অস্বাভাবিক ভোট পড়ার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের নির্লিপ্ততাকে উদ্বেগজনক আখ্যা দেন নির্বাচন পর্যবেক্ষণের সঙ্গে যুক্ত বেসরকারি সংস্থা ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্স-ফেমা’র প্রেসিডেন্ট মুনিরা খান। তাঁর মন্তব্য, বাংলাদেশের বাস্তবতায় কোথাও ৭০ শতাংশের বেশি ভোট পড়লেই সেখানে কমিশনের আলাদা নজর দেয়া উচিৎ।

https://www.dailysangram.com/post/383799