মশা। ফাইল ছবি
২৩ জুলাই ২০১৯, মঙ্গলবার, ১:১৪

ডেঙ্গুর বিস্তার বাড়ছেই, ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত ৪০৩

চলতি মাসে আক্রান্ত ৫০৫০ জন * দুই সিটি কর্পোরেশনের প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তাকে হাইকোর্টে তলব

ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছেই। বাড়ছে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যাও। ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন অন্তত ৪০৩ জন। এর মধ্যে ঢাকা শহরেই ৩৯৯ জন। ডেঙ্গুতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন হবিগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. মো. শাহাদাত হোসেন হাজরা (৫৩)।

তার স্ত্রী-সন্তানও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। রোববার রাতে ডা. শাহাদাতকে ঢাকায় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেয়ার পথেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এদিকে ঢাকায় ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার বিস্তার রোধে মশা নির্মূলে দুই সিটি কর্পোরেশনের নেয়া পদক্ষেপে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট।

বৃহস্পতিবার দুই সিটি কর্পোরেশনের প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তাকে আদালতে হাজির হওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়ে আদালত বলেছেন, পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে হাইকোর্ট মশা মারার জন্য রুল দেয় না।

সোমবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১ থেকে ২২ জুলাই ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৫০ জন, মৃত্যু এক জন। জুনে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৮১৪ জন, মৃত্যু ২ জন। ২৪ ঘণ্টায় শুধু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৮৩ জন।

হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ৪৫ জন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ৩৩ জন, মিডফোর্ড হাসপাতালে ৩৮ জন, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৮ জন ও ঢাকা শিশু হাসপাতালে ১২ জন ভর্তি হয়েছেন। এছাড়া বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন অন্তত ১২৩ জন। ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত ৪০৩ জনের মধ্যে ৪০১ জন ডেঙ্গু ফিবার ও ২ জন ডেঙ্গু হেমরেজিকে ভুগছেন।

প্রস্তুতি না নেয়ায় ডেঙ্গু মহামারী রূপ নিয়েছে -হাইকোর্ট : এদিকে সোমবার হাইকোর্ট বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে কোনো প্রস্তুতি না নেয়ায় এটি মহামারী আকার ধারণ করেছে। মেয়ররা বললেন, মশার ওষুধ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। তাহলে এখন তারা কী ওষুধ ছিটাচ্ছে? ওষুধে কি কাজ হয়?

শুনানি শেষে দুই সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে বৃহস্পতিবার হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন বিচারপতি তারিক উল হাকিম ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ারদীর সমন্বয়ে হাইকোর্ট বেঞ্চ।

আগের দেয়া হাইকোর্টের আদেশের ভিত্তিতে সোমবার ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া রোধে নেয়া ২ সিটি কর্পোরেশনের পদক্ষেপ নিয়ে দুটি প্রতিবেদন দাখিল করেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সায়েরা ফাইরুজ। একপর্যায়ে মশা নিধনে ওষুধ ছিটানোর প্রসঙ্গ এলে আদালত বলেন, কই আমরা তো দেখছি না।

হঠাৎ করে মশার ওষুধ কোথায় পেলেন? ওষুধে কি কোনো কাজ হয়? আইনজীবী তখন বলেন, জনসচেতনতামূলক বিভিন্ন পদক্ষেপও সিটি কর্পোরেশন নিয়েছে। আদালত তখন বলেন, জনসচেতনতা দিয়ে কী হবে? আপনারা সচেতন কি না? এরপর জনগণের সচেতনতার কথা বলবেন। আপনারা যদি না পারেন, তাহলে একটা আবেদন নিয়ে আসেন, সচেতন হওয়ার জন্য জনগণের ওপর রুল জারি করে দিই। আপনাদের তো কাজ নেই।

আগে তো কিছুই করেননি। আর এটা তো বিশ্বাসযোগ্য হবে না যদি মানুষের হাসপাতালে যাওয়া বন্ধ না হয়। আমরা চাই হাসপাতালে যাওয়া বন্ধ হোক। পরে দুই সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে তলবের আদেশ দেন। ১৪ জুলাই হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি রুলসহ আদেশ দেন। ঢাকা মহানগরীতে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়াসহ মশাবাহিত অন্যান্য রোগের বিস্তার রোধে এডিসসহ মশা নির্মূলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পদক্ষেপ নিতে বলা হয় আদেশে।

সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সায়েরা ফাইরুজ সাংবাদিকদের বলেন, ‘দুটি বাস্তবায়ন প্রতিবেদন দিয়েছিলাম। কোর্ট আমাদের প্রতিবেদনে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। এজন্য ২ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের তলব করেছে।’ হবিগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, রোববার রাত ১১টা ৫০ মিনিটে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসকরা ডা. শাহাদাত হোসেনকে মৃত ঘোষণা করেন।

হবিগঞ্জ সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শাহ আলম জানান, রোববার সিভিল সার্জন ডা. শাহাদাত জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় অংশ নেন। দুপুরে জ্বর বেড়ে গেলে তাকে সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি চিকিৎসকদের জানান, ঢাকায় তার স্ত্রী ও ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়–য়া মেয়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত।

সম্ভবত তিনিও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। তাকে ঢাকায় পাঠানোর জন্য চিকিৎসকদের অনুরোধ জানান তিনি। সঙ্গে সঙ্গে তাকে অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে পাঠানো হয়। রাতেই তিনি মারা যান। তার বাড়ি পিরোজপুরে। তিনি এক ছেলে ও এক মেয়ের বাবা। ছেলে মেডিকেল কলেজের ৩য় বর্ষের ছাত্র।

ঝালকাঠি সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা থেকে ৯ জুলাই তিনি হবিগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন হিসেবে পদোন্নতি পান। কিছুদিন ছুটি কাটানোর পর ২০ জুলাই তিনি জ্বর নিয়ে কর্মস্থলে যোগ দেন।

তার পরিবারের সদস্যরা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ডা. শাহাদাতের মৃত্যুর কথা বললেও মৃত্যু যেহেতু হাসপাতালে নেয়ার আগেই ঘটেছে, সেজন্য মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের চিকিৎসকরা।

চট্টগ্রামে ২২ জন শনাক্ত : চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, এ বছর ২২ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছেন। ৩ সপ্তাহেই শনাক্ত হন ১৯ জন। চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র বলছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ৬ জন, বিআইটিআইডি ফৌজদারহাটে ২ জন এবং নগরীর বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে বাকি ১১ জন শনাক্ত হন। বর্তমানে ৩ জন চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

সোমবার সিভিল সার্জন কার্যালয়ের পক্ষ থেকে কর্মচারীসহ প্রায় ১১ হাজার কারাবন্দিসহ নগরবাসীর সুরক্ষায় সিটি কর্পোরেশনকে মশা নিধনে ক্রাশ প্রোগ্রাম গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। সোমবার ডেঙ্গু সম্পর্কিত দিকনির্দেশনা দিতে চট্টগ্রামে এসেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টিম লিডার ডা. হাম্মাম। চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সেমিনারে তিনি বেশকিছু নির্দেশনা দিয়েছেন সংশ্লিষ্টদের।

নড়াইলে গৃহবধূর মৃত্যু : নড়াইলে গৃহবধূ রুখসানা পারভীন (৫২) ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তিনি নড়াইলের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সহসভাপতি ও জেলা শিল্পকলা একাডেমির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আসলাম খানের স্ত্রী। শুক্রবার রাত ২টার দিকে যশোরের ইবনে সিনা হাসপাতালে রুখসানার মৃত্যু হয়। শনিবার বিকালে জানাজা শেষে নড়াইল পৌর কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

কুষ্টিয়ায় প্রথম ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত : কুষ্টিয়া প্রতিনিধি জানান, কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ইসমাইল হোসেন নামে এক যুবককে ডেঙ্গু রোগী হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। ৭ জুলাই জ্বরে আক্রান্ত হয়ে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন। তিনি কুষ্টিয়া সদর উপজেলার বালিয়াপাড়া শাহী জামে মসজিদের ইমাম।

খুলনায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ২০ : খুলনা ব্যুরো জানায়, খুলনা বিভাগে এক মাসে ২০ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছেন। তারা সবাই খুলনার বাইরে থেকে এসে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের মধ্যে মহেশপুর থানার বাসিন্দা এএসআই আছাদ (৩৩) ১৫ জুলাই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

আক্রান্তদের মধ্যে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১১ জন, খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনজন, গাজী মেডিকেল হাসপাতালে তিনজন, কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে দু’জন ও ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে একজনকে চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়।

যশোরে ১২ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত: যশোর ব্যুরো জানায়, যশোরে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ১২ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে নড়াইলে একজনের মৃত্যু হয়েছে। যদিও স্বাস্থ্য বিভাগের দাবি, ৮ জন ডেঙ্গু রোগীর সন্ধান মিলেছে। ঢাকায় থাকতে তারা আক্রান্ত হয়েছেন। যশোরের বিভিন্ন হাসপাতালে তারা চিকিৎসাধীন। ১৯ জুলাই যশোর ইবনে সিনা হাসপাতালের আইসিইউ থেকে ঢাকা নেয়ার পথে একজন ডেঙ্গু রোগী মারা যান।

তিনি নড়াইল সদর উপজেলার কুড়িগ্রামের আবদুর রাজ্জাকের মেয়ে। যশোরের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. হারুন অর রশিদ বলেন, যশোর জেনারেল হাসপাতালে দুইজন এবং একটি বেসরকারি হাসপাতালে ছয়জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। তাদের বাড়ি যশোরসহ বিভিন্ন জেলায়। তারা ঢাকায় থাকতেন। আক্রান্ত হয়েছেন ঢাকায়, চিকিৎসা নিচ্ছেন যশোরে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/202156